অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
এক বিরাট জাহাজ। মহাসাগরের বুক চিরে নিজস্ব ছন্দে হেলতে দুলতে এগিয়ে চলছে। যাত্রীরা অনেকেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন জাহাজের ডেকে। তাঁদের চোখ সাগর পানে। সামনে শুধুই জল আর জল। যেন তার কোনও শেষ নেই। এমনই সময় ঘটে গেল এক বিস্ময়কর ঘটনা। জাহাজের অদূরেই ভেসে উঠল এক বিশালাকায় মাছ। মাছটির মাথার উপর থেকে ফোয়ারার মতো জল বেরচ্ছে। চারদিকে তখন চিল চিৎকার। এ ওকে ডেকে দেখাচ্ছে। দেখ দেখ সামনে কী! কিছুটা সময় ভেসেই সেই বিশাল মাছ ডুবে গেল সাগরের অতলে। উপস্থিত সকলেই তখন বাকরুদ্ধ। যেন নিজের চোখকেই কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। আর সত্যিই তো তাই, এই বিরল দৃশ্য দর্শন করার সৌভাগ্য ক’জনেরই বা হয়। কারণ যাত্রীদের সামনে যে প্রাণীটি ছিল তার আকার, আয়তন পৃথিবীর যে কোনও প্রাণীর তুলনায় বেশি। নাম তার নীল তিমি।
তবে বন্ধুরা একবার ভেবে দেখ তো, এমনই একটা জাহাজে তোমরা থাকলে কেমন শিহরণ জাগত!
সাগরের নীল জলে সাঁতরে চলা এই বিশালাকার জীবকে নিয়ে সকলের মনেই কৌতূহল রয়েছে। পৃথিবীর তাবড় জীববিজ্ঞানীরা নীল তিমির জীবনের নানা পর্যায়ের বিশ্লেষণে লেগে রয়েছেন। এখানে বন্ধুরা প্রথমেই বলে রেখে, নীল তিমিকে যতই মাছ বলা হোক না কেন বা এই প্রাণীকে দেখতে যতই মাছের মতো মনে হোক না কেন, এরা কিন্তু মাছ নয়। নীল তিমি আসলে স্তন্যপায়ী প্রাণী!
জলের উপরেই শ্বাস
নীল তিমি যে মাছ নয়, তা আগেই বলেছি। ফলে জল থেকে এই প্রাণী অক্সিজেন সংগ্রহ করতে পারে না। তার বদলে আমার-তোমার মতো বায়ুমণ্ডল থেকেই নীল তিমিকে শ্বাস গ্রহণ করতে হয়। তবেই মেলে বাঁচার মূলধন অক্সিজেন।
নীল তিমির মাথার উপরে রয়েছে ব্লো হোল। মাথার উপরের এই অংশটি থেকেই ফোয়ারার মতো জল বেরয়। এক্ষেত্রে এই অংশটিই শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রাণীটি জলের উপরে ভেসে উঠলে এই ব্লো হোল-এর মাধ্যমেই বায়ু থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে। তারপর ফের সমুদ্রের তলায় পাড়ি জমায়।
আহার তেমন রাজকীয় নয়
এতবড় প্রাণীর নিজের অতিকায় শরীর ধরে রাখার জন্য রোজ ব্যাপক পরিমাণে খাবারের প্রয়োজন। তবে সেই নিয়ে নীল তিমিকে খুব একটা বেশি চিন্তা করতে হয় না। কারণ বিশাল সমুদ্র গর্ভে এই প্রাণীর খাবারের কোনও অভাব নেই।
তোমরা নিশ্চয়ই অনেকেই ভাবছ, নীল তিমি আকারে এত বড়। তাই এই প্রাণী নিশ্চয়ই সাগর তলে বড় বড় সব প্রাণী শিকার করে বেড়ায়। এই ধারণা থাকলে কিন্তু বড় ভুল করে ফেলবে। নীল তিমির খাবার হল চিংড়িজাতীয় প্রাণী ক্রিল। এক্ষেত্রে ক্রিলের মতো ছোট প্রাণী খেয়ে এই বিপুল আকারের প্রাণীর প্রাণ বাঁচাতে গেলে রোজ বিশাল পরিমাণ ক্রিল খেতে হয়। জানলে অবাক হবে, বছরের কোনও কোনও সময় একটা প্রাপ্তবয়স্ক নীল তিমি রোজ ৪ টন ক্রিল খেয়ে ফেলে। ভাবা যায়!
নীল তিমির খাবার খাওয়ার ধরনও কিন্তু আশ্চর্যরকম। এখানে প্রথমেই বলতে হবে, নীল তিমিকে বলা হয় ব্যালিন হোয়েল। ব্যালিন হল মুখের ভিতর ছাঁকনির মতো অংশ। দাঁতের বদলে এই তিমির রয়েছে ব্যালিন। এই ছাঁকনি প্রাণীটির উপরের চোয়ালে থাকে।
এই বৃহদাকার প্রাণীটি প্রথমে প্রচুর পরিমাণে জল মুখে প্রবেশ করায়। জলের সঙ্গে প্রচুর ক্রিল মুখে ঢুকে যায়। এরপর নীল তিমি জিভের চাপে জলকে মুখের থেকে বাইরে বের করে দেয়। মুখের ভিতরে ব্যালিনের মধ্যে হয়ে জল বাইরে বেরিয়ে আসে। আগেই বলেছি ব্যালিন ছাঁকনির মতো কাজ করে। ফলে ব্যালিন থেকে জল বেরিয়ে আসলেও জলের সঙ্গে চলে আসা ক্রিল ছাঁকনিতেই ধরা পড়ে যায়। এরপর নীল তিমি সেই ধরা পড়া ক্রিল গিলে নেয়। এভাবেই খুবই সহজে নিজের খাবার সংগ্রহ করে চলে নীল তিমি।
শরীরের রং
ভাবছ নিশ্চয়ই, নামেই যখন নীল বলা রয়েছে তখন আর রং নিয়ে কথা বলার কী রয়েছে। আছে বন্ধু, তাই তো বলা। আসলে সাগরের জলের তলায় নীল তিমিকে একদম নীলই দেখতে লাগে। কিন্তু জলের উপরে ভেসে উঠলে নীল তিমিকে দেখে সম্পূর্ণ নীল মনে হবে না। জলের উপরে ভাসমান অবস্থায় এদের গায়ের রং নীলাভ এবং ধূসর মিশ্রিত মনে হয়। আর নীল তিমির পেটের কাছে হালকা হলুদ রং দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য এই হলুদ রং এই বিশাল প্রাণীর আপন নয়। অসংখ্য অণুজীব নীল তিমির পেটের ত্বকের উপর বাসা বাধে। তারা সেখানেই বেঁচে থাকে। আর এই অণুজীবগুলির জন্যই এই প্রাণীর পেটের অংশ হলুদ দেখায়।
তিমি আসলে কতটা বড়?
নীল তিমির বিশালত্ব নিয়ে আশ্চর্যের শেষ নেই। এই প্রাণীটি ১০০ ফিট লম্বা হতে পারে। আর এদের ওজন হতে পারে ২০০ টনেরও বেশি। দৈর্ঘ্যে যা তিনটি বাসের সমান এবং বেশ কতকগুলি লরির থেকেও ভারী। তোমরা হয়তো জানলে অবাক হবে যে নীল তিমির জিভের ওজনই হতে পারে একটি হাতির সমান। আর তাদের হৃৎপিণ্ডের ওজন হয় একটা গাড়ির মতো। এই বৃহদাকার প্রাণীটি মোটামুটি ৮০ থেকে ৯০ বছর বাঁচে।
সাঁতার কাটা
সাধারণত একা বা এক বন্ধুকে সঙ্গে করেই এই মাছ একটি জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সাঁতরে বেড়ায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছোট ছোট দলেও এই প্রাণীকে সাঁতার কাটতে দেখা গিয়েছে। সাধারণত ঘণ্টায় চার মাইল গতিবেগে এই বৃহদাকার তিমি সাঁতার কাটে। তবে রেগে গেলে এদের গতিবেগ অনেকটাই বেড়ে যায়। তখন প্রায় ঘণ্টায় ২০ মাইল গতিবেগেও এরা সমুদ্র সফর করতে পারে।
কোথায় দেখা মেলে?
পৃথিবীর সমস্ত মহাসাগরেই নীল তিমির দেখা মেলে। তবে পৃথিবীর উত্তর মেরু প্রদেশের হাড় কাঁপানো বরফ জলে এই তিমিকে দেখতে পাওয়া যায় না।
গলার জোর
তোমরা ভাব কেবল তোমরাই চিৎকার করতে পারো? কোনও দিন নীল তিমির আওয়াজও শুনে দেখ, নিজের ভুল ভেঙে যেতে বাধ্য। পৃথিবীতে জোরে আওয়াজ করা প্রাণীদের মধ্যে নীল তিমির নাম অনায়াসে প্রথম সারিতে চলেই আসবে। জলের তলায় এই প্রাণীর আওয়াজ কয়েকশো কিমি পর্যন্ত শোনা যায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শুধুমাত্র একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য নীল তিমি আওয়াজ বের করে না। বরং এই আওয়াজের মাধ্যমে তারা সমুদ্রের গভীরতাও বুঝে নেয়। এক্ষেত্রে মুখের আওয়াজ এবং দারুণ শ্রবণ ক্ষমতার মিলিত কার্যকলাপেই এই দুর্গম কাজটি সম্পন্ন হয়।
শিশু নীল তিমি
জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই এদের ওজন এবং আকার সকলকে অবাক করে। নীল তিমি জন্মের সময় প্রায় ৮ মিটার লম্বা এবং ওজন প্রায় ৪ হাজার কিলো হয়ে থাকে। প্রথম সাত থেকে আট মাস এই শিশু প্রাণীটি খুব দ্রুত বড় হয়। আরও আশ্চর্যের কথা হল, এই নির্দিষ্ট সময়ে কেবল মাতৃদুগ্ধ পান করেই রোজ প্রায় ৯০ কেজি ওজন বাড়িয়ে নেয়। সত্যিই আশ্চর্য না হয়ে উপায় নেই!
নীল তিমিকে বাঁচাতে হবে
মানুষের নির্মম লোভ নীল তিমির উপরও এসে পড়ে। অত্যধিক শিকারের কারণে এই প্রাণী সমুদ্রের বুক থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। ১৯০০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে প্রায় ৩ লক্ষ ৬০ হাজার নীল তিমি শিকার করা হয়। এই অবস্থার উন্নতিতে ১৯৬৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল হোয়েলিং কমিশন নীল তিমির শিকার বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। অবশ্য তাতেও সমুদ্রে এই প্রাণীর তেমন সংখ্যা বৃদ্ধি হয়নি। অপরদিকে গত ১৫০ বছরে নীল তিমির সংখ্যা ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ কমেছে। ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে আজ সমুদ্রের এই নীল জীবটি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর আখ্যা পেয়েছে। তাই ব্লু হোয়েলকে বাঁচিয়ে রাখতে, তাঁদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সকল স্তর থেকেই আরও সচেষ্ট হতে হবে। কারণ সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতে এই প্রাণীর বেঁচে থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। তবেই বজায় থাকবে খাদ্য-খাদকের সম্পর্কের শৃঙ্খল। আর সবথেকে বড় কথা, নীল তিমি বেঁচে থাকলেই তো আগামী প্রজন্ম জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে এই বিশালাকার প্রাণীকে দেখতে পারবে। শিহরিত হতে পারবে।