কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে শহিদ ক্ষুদিরামের নাম অমর হয়ে আছে। ফাঁসির মঞ্চে যাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে প্রথম বিপ্লবী ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। আজ তোমাদের শোনাব তাঁর ছেলেবেলার কথা, কেমন করে তিনি হয়ে উঠলেন বীর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। ১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর মেদিনীপুরের হাবিবপুর গ্রামে ত্রৈলোক্যনাথ ও লক্ষ্মীদেবীর ঘরে জন্ম হয়েছিল ক্ষুদিরামের। ক্ষুদিরামের নাম কেন ‘ক্ষুদিরাম’ হয়েছিল জানো? ক্ষুদিরামের জন্মের ঠিক আগে তাঁর দুই দাদা শিশু অবস্থাতেই মারা যান। সেই সময় মানুষের মনে একটা সংস্কার ছিল যে, যদি শিশুর জন্মের পর কোনও আত্মীয় তাকে কিনে নেন ‘কড়ি’ অথবা ‘খুদ’-এর বিনিময়, তাহলে সেই শিশুর অকাল মৃত্যু হবে না। তাই ক্ষুদিরামের মা ছেলের জীবন বাঁচাতে নিজের মেয়ে অপরূপার কাছে তিন মুঠো খুদের বিনিময় তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এই জন্যই তাঁর নাম হয় ‘ক্ষুদিরাম’। মাত্র দু’বছর বয়সেই মাকে হারালেন ক্ষুদিরাম। বাবাকে হারালেন সাত বছর বয়সে। দিদি অপরূপা নিজের শ্বশুরবাড়ি দাসপুরের হাটগাছা গ্রামে তাঁকে নিয়ে এলেন। ক্ষুদিরাম বড় হতে লাগলেন দিদির বাড়িতেই। জামাইবাবু অমৃতলাল রায় বদলি হয়ে গেলেন তমলুকে। ক্ষুদিরাম তাঁদের সঙ্গে তমলুকে চলে এলেন। ভর্তি হলেন তমলুকের হ্যামিলটন স্কুলে। পড়াশুনোয় কিন্তু একদম মন ছিল না তাঁর। মন পড়ে থাকত নানান রকম দুরন্তপনার দিকে। যদিও তিনি খুব একগুঁয়ে ছিলেন, কিন্তু তাঁর স্বভাবটি ছিল খুব মিষ্টি। তাই মাস্টারমশাইরা তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। জামাইবাবু অমৃতলাল আবার বদলি হলেন। এবার মেদিনীপুর শহরে। ক্ষুদিরামও এসে ভর্তি হলেন মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে। তখন দেশে স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ার বয়ে চলেছে চারদিকে। এই মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ক্ষুদিরাম শিক্ষক হিসেবে পেলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। গুরুশিষ্যর এখানেই হল প্রথম দেখা।
মেদিনীপুরের কাঁসাই নদীর ধারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছিল এক ভাঙা মন্দির। সেই মন্দিরের দেবতা বুড়ো শিব নাকি খুব জাগ্রত। ভক্তের প্রার্থনা অপূর্ণ রাখেন না তিনি। ক্ষুদিরাম গুটি গুটি পায়ে একদিন এসে দাঁড়ালেন সেই মন্দিরের দরজায়। তাঁর মনের ইচ্ছের কথা জানালেন বুড়ো শিবকে। এমন সময় হঠাৎ শোনেন তাঁর নাম ধরে কেউ ডাকছে। দেখেন মাস্টারমশাই সত্যেন্দ্রনাথ। চমকে গেলেন ক্ষুদিরাম। সত্যেন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এখানে? কেন এসেছ?’ ক্ষুদিরাম বললেন, ‘বর চাইতে’। সত্যেন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন, ‘কী বর চাইলে?’ ক্ষুদিরাম বললেন, ‘দেশের মুক্তি। দেশের স্বাধীনতা।’ অবাক হয়ে গেলেন মাস্টারমশাই! বললেন, ‘দেশকে তুমি এত ভালোবাসো? নিজের জন্য কিছু না চেয়ে ভগবানের কাছে দেশের স্বাধীনতা চাইতে এসেছ?’ ক্ষুদিরাম বললেন, ‘দেশকে যে আমি খুব ভালোবাসি মাস্টারমশাই!’ মাস্টারমশাই বোধহয় এইটুকু শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, ‘পারবে প্রয়োজন হলে দেশের জন্য প্রাণ দিতে?’ ক্ষুদিরাম নির্ভীক কণ্ঠে বললেন, ‘পারব মাস্টারমশাই।’ সত্যেন্দ্রনাথ বললেন, ‘দেশের জন্য তোমার প্রাণ উৎসর্গ করতে হবে। দেশের মুক্তির জন্য তোমায় দীক্ষা নিতে হবে।’ ক্ষুদিরাম ব্যাকুল হয়ে বললেন, আমায় দীক্ষা দিন মাস্টারমশাই! দেশের জন্য আমি প্রাণ বিসর্জন দেব!’ তাঁর ব্যাকুলতা দেখে তিনি বললেন, ‘বেশ। আজ থেকে তুমি হবে আমাদের গুপ্ত সমিতির সদস্য।’
এই গুপ্ত সমিতিতে ছেলেদের লাঠিখেলা, তলোয়ার চালানো, কুস্তি করা, বন্দুক চালানো, ঘোড়ায় চড়া, সব কিছু শেখানো হতো। অল্প ক’দিনের মধ্যেই ক্ষুদিরাম সব কিছুতেই পারদর্শী হয়ে উঠলেন।
দিদির নিরাপদ আশ্রয় এবার ছাড়লেন ক্ষুদিরাম। পুরোপুরি দেশের কাজে নিজেকে সঁপে দিলেন। এই সময় থেকে তাঁর কাজ হল বিলিতি কাপড়ের গাঁট লুঠ করা, বিলিতি কাপড় পোড়ানো, বিলিতি লবণের নৌকা ডুবিয়ে দেওয়া। পাশাপাশি পিস্তল ছোঁড়াও অভ্যাস করতেন তিনি।
পরের দুঃখ দেখলে ক্ষুদিরাম আর নিজেকে স্থির রাখতে পারতেন না। জীবন পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়তেন সমস্যা সমাধানের জন্য। একবার কাঁসাই নদীর বন্যায় গ্রাম ভেসে গেল। ক্ষুদিরাম ‘রণ-পা’ পরে সেখানে ছুটে গেলেন ত্রাণ কাজ করার জন্য। গ্রামে কোনও কারণে আগুন লাগলে, কিংবা ওলাওঠা বা বসন্তের মতো রোগের মহামারী শুরু হলে ক্ষুদিরাম তাঁদের সমিতির ছেলেদের নিয়ে নিজের জীবন তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়তেন মানুষের সেবায়।
১৯০৬ সালে মেদিনীপুরের মারাঠা কেল্লা অর্থাৎ পুরোনো জেলখানার মাঠে ‘কৃষিশিল্প প্রদর্শনী ও মেলা’ বসেছে। প্রচুর লোক এসেছে সেই মেলায়। বিপ্লবী দলের পত্রিকা ‘সোনার বাংলা’ বিলি করছেন ক্ষুদিরাম। পুলিস হঠাৎ শুরু করল স্বদেশিদের ধরপাকড়। ক্ষুদিরাম পুলিসকে মেরে সেখান থেকে পালালেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা উঠল আদালতে। বয়স কম বলে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হল না।
এর কিছুদিন পরই ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য নির্বাচিত হলেন ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী। বিপ্লবী দলের আদেশে তাঁরা দু’জন ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল কিংসফোর্ডের ঘোড়ার গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়লেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সে গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না, ছিলেন দু’জন নিরীহ স্ত্রীলোক মিসেস এবং মিস কেনেডি। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী সেখান থেকে পালালেন।
সারারাত রেললাইন ধরে হেঁটে পরদিন ভোরে চব্বিশ মাইল দূরের ওয়াইনি স্টেশানে পৌঁছলেন ক্ষুদিরাম। খিদে তেষ্টায় বাধ্য হয়ে একটি মুদির দোকানে যখন খাবার কিনে খাচ্ছেন, তখন তাঁকে দেখতে পেয়ে গেল দু’জন কন্সটেবল ফতে সিং আর শিবপ্রসাদ মিশ্র। ক্ষুদিরাম কোমরে গোঁজা পিস্তল বার করবার আগেই তারা দু’জন দু’পাশ থেকে জাপটে ধরে ফেলল তাঁকে।
পয়লা মে ধরা পড়লেন তিনি। কোর্টে মামলা উঠল। বিনা পারিশ্রমিকে আইনজীবী কালিদাস বসু, সতীশ চক্রবর্তী, নৃপেন লাহিড়ী মামলা লড়লেন। কিন্তু তবু বাঁচাতে পারলেন না তাঁকে।
১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসির দিন ধার্য হল তাঁর। ভারত মায়ের সোনার ছেলে ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে নিজেই এগিয়ে গেলেন ফাঁসির মঞ্চের দিকে। সোজা দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের অমূল্য প্রাণ-বিসর্জন দিলেন তিনি। অমর হয়ে রয়ে গেলেন শুধু ইতিহাসেই নয়, প্রতিটি ভারতবাসীর মনের মধ্যেও। দেশের পথে প্রান্তরে বাউল, ফকিরদের কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়ল ক্ষুদিরামকে নিয়ে পল্লীকবির বাঁধা সেই
চিরন্তন গান —
‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি—
হাসি হাসি পরব ফাঁসি
দেখবে ভারতবাসী।’
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে