বিদ্যায় অধিক পরিশ্রম করতে হবে। ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তির পক্ষে দিনটি শুভ। প্রেম-প্রীতিতে আগ্রহ বাড়বে। নতুন ... বিশদ
জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক
সমুখে সুউচ্চ হিমালয় পর্বত আর নীচে রামগঙ্গা নদী। উত্তরভারতের কুমায়ুন অঞ্চলে এমনই পটভূমিতে গড়ে উঠল ভারতের প্রাচীনতম অভয়ারণ্য। ১৯৩৬ সালে যখন অভয়ারণ্যটি তৈরি হয় তখন তার নাম দেওয়া হয়েছিল হেলি ন্যাশনাল পার্ক। পরে অবশ্য নাম বদলে রামগঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক রাখা হয়। কিন্তু সেই নামটাও টিকল না। আপাতত জঙ্গলটি যে নামে পরিচিত সেই নাম তোমাদের সকলেরই চেনা। জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক। কুমায়ুনে এসে এই জঙ্গলটি দারুণ পছন্দ হয়ে যায় ইংরেজ লেখক জিম করবেটের। জঙ্গলের বাঘেদের নিয়ে তাঁর রচনার শেষ নেই। ম্যান ইটারস অব কুমায়ুন, জঙ্গল লোর, ম্যান ইটিং লেপার্ড সর্বত্রই এই জঙ্গলের চিত্রপট।
২০০ বর্গ মাইলের সামান্য বেশি অঞ্চল জুড়ে করবেট ন্যাশনাল পার্কের অবস্থান। হিমালয়ের পাদদেশে পাহাড়ি এই অরণ্য নাকি বাঘ বাঁচানোর জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। ভারতে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা যখন ক্রমশ কমতে শুরু করল তখনই তাদের সুরক্ষিত বনভূমির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আর সেই বনভূমি তৈরি করা হয় কুমায়ুন অঞ্চল জুড়ে। রামগঙ্গা নদীটিতে বাঁধ দিয়ে একটা জলাশয়ও তৈরি করা হয়েছে এই অরণ্যের মাঝখানে। পশুপাখিরা দল বেঁধে জল খেতে আসে এই জলাশয়ে। শুধু তাই নয়, জলাশয়ের খানিকটা অংশ আবার স্পোর্ট ফিশিংয়ের জন্যও কাজে লাগানো হয়েছে। ট্যুরিস্টদের খুব প্রিয় এই মাছধরা খেলা। আওয়াজ নেই, দূষণ নেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিরিবিলিতে প্রকৃতির সঙ্গে আলাপ জমানো আর মাছ ধরা। এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়?
যাই হোক, পশুপাখি, পোকামাকড়, মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণী ছাড়াও জঙ্গলে নানারকম ছোট বড় গাছের ঠিকানা। শাল, টিক, ফার, ওক, স্পার্স, সাইপ্রাস, পাইন কী নেই। আর আছে বাঁশ গাছ। জঙ্গলের ভল্লুকদের আবার কচি বাঁশ বিশেষ পছন্দ কিনা। বাঘ বাঁচানোর জন্য জঙ্গল গড়ে উঠলেও বাঘ ছাড়াও নানারকম পশুর খোঁজ পাওয়া যায় এখানে। এক ভল্লুকেরই তো কতরকম প্রজাতীর দেখা মিলবে। স্লথ বিয়ার, এশিয়াটিক ব্ল্যাক বিয়ার আরও কতসব গালভারী নাম। এছাড়াও নানা রকম বাঁদর, হনুমান, বন বেড়াল, হাতি, হরিণ এমনকী নীল গাইয়েরও সন্ধান মিলবে জিম করবেট অভয়ারণ্যে।
আর পাখি? মোট ৬০০ প্রজাতীর পাখি আসে এখানে। কেউ সুদূর বিদেশ থেকে শীতের সময় উড়ে আসে, কারও বা স্থায়ী ঠিকানা এই জঙ্গল। গল্প শুনে বুঝি জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক ঘুরে দেখার শখ জেগেছে মনে? তাহলে বলি শোনো, জঙ্গলে ঘোরার জন্য দিনে দুটো সাফারি পাওয়া যায়। সকালে আর দুপুরে। হাতির পিঠে চড়ে দুলকি চালে সাফারি করতে পারো, আর নয়তো গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়তে পারো জিপসি গাড়ি চড়ে। জঙ্গলের নিরিবিলি পরিবেশের স্বাদ পেতে চাইলে থাকতে হবে জঙ্গলের ভেতরে ফরেস্ট বাংলোয়। ঘন অরণ্যে ঘেরা সেইসব বাংলোয় একটা গা ছমছমে ভাব রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। করবেট সাহেব তো বাঘ দেখার জন্য রাতের পর রাত গাছেই থাকতেন মাচা বেঁধে। একবার একটি বাঘ তাঁকে ধরবে বলে মাচার ঠিক নীচে এসে বসল। নড়েও না চড়েও না। এদিকে করবেট সাহেবও মাচা থেকে নামতে পারছেন না। মাচায় বসে মুখে নানারকম শব্দ করছেন বাঘ তাড়ানোর জন্য কিন্তু বাঘ ভোলার পাত্রই নয়। গ্যাঁট হয়ে বসে আছে সে শিকারের আশায়। এরকম দিন দুয়েক কাটার পর বাঘটি বিরক্ত হয়ে চলে যায়। আর করবেট সাহেবও মাচা থেকে নামতে পারেন অবশেষে।
পাহাড়ি এলাকা তাই শীত একটু বেশিই পড়ে এখানে। শীতে বেড়াতে এলে ভারী গরম জামা অবশ্যই আনা চাই। নভেম্বর মাসের ১৬ তারিখ থেকে জুন মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত খোলা থাকে জঙ্গল। পুজো অথবা গরমের ছুটি যে কোনও সময়ই ঘুরে আসতে পারো জিম করবেট অভয়ারণ্যে বাঘের সঙ্গে মোলাকাত করার জন্য।
জলে কুমির ডাঙায় বাঘ
জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। অর্থাৎ যেদিকেই যাও না কেন বিপদ ওত পেতে আছে। সুন্দরবনে কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। আর ঠিক এই কারণেই সুন্দরবনের জঙ্গল আর সব জঙ্গলের থেকে আলাদা। আমাদের দেশের অন্য যে কোনও জঙ্গলে গেলে গাড়ি নিয়ে অথবা পায়ে হেঁটে (সাহস থাকলে) ঘোরা যায়। সুন্দরবনে কিন্তু তা সম্ভব নয়। এখানে ঘুরতে গেলে লাগবে নৌকো কিংবা লঞ্চ কিংবা ভুটভুটি (মোটর লাগানো দিশি নৌকো)। শুধু ঘোরার জন্যই নয়। এখানকার অধিবাসীরাও তাঁদের নিত্যদিনের কাজের জন্য অনেকটাই নির্ভর করেন নৌকো কিংবা ভুটভুটির ওপর।
সুন্দরবনে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকরা বাঘ দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকলেও সুন্দরবনের বাসিন্দারা কিন্তু মোটেই বাঘের দেখা পেতে চান না। কারণ, বাঘ মানেই তাঁদের কাছে সাক্ষাৎ যম। তাঁরা তো পর্যটকদের মতো মাঝ-নদীতে নিরাপদ দূরত্বে লঞ্চের ডেকে বসে বাঘ দর্শন করেন না। তাঁরা জীবিকার তাগিদে জঙ্গলে যান মধু ও মোম সংগ্রহ করতে কিংবা নদীর খাঁড়িতে কাঁকড়া ও চিংড়ির মীন ধরতে। সেখানে বাঘের মুখোমুখি হওয়া মানেই মৃত্যু। তোমরা খবরের কাগজে নিয়মিত চোখ রাখলে দেখতে পাবে প্রতিবছরই বাঘের আক্রমণে সুন্দববনের অনেক মানুষ মারা যান। আবার অনেকে বেঁচেও ফিরে আসেন। যাঁরা বেঁচে ফিরে আসেন তাঁরা জীবনভর সেই আতঙ্ক বুকে বয়ে বেড়ান। এমনই এক মহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ট্রেনে। নদীর খাঁড়িতে মীন ধরতে গিয়ে তিনি বাঘ দেখেছিলেন। তাঁর এক সঙ্গীর ঘাড় কামড়ে ধরেছিল বাঘ। এই মহিলা সঙ্গে সঙ্গে নৌকোর লগি দিয়ে বাঘের মাথায় আঘাত করেন। বাকি সঙ্গীসাথীরাও চিৎকার করে যে যা পারেন তাই দিয়ে বাঘকে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকায় বাঘটি শিকার ছেড়ে পালিয়ে যায়। আহত লোকটিকে ক্যানিং হাসপাতালে নিয়ে আসা হলেও
তিনি বাঁচেননি। ঘটনার বর্ণনা দিতে দিতে মহিলা শিউরে উঠছিলেন। আসলে সুন্দরবনের বাঘ অত্যন্ত চতুর হয়। তারা কখনওই মানুষকে দেখা দেয় না। একমাত্র শিকারকে অসতর্ক অবস্থায় পেলে তবেই বেরিয়ে আসে। এরা চলাফেরা করে নিঃশব্দে। কখন যে পিছনে এসে দাঁড়াবে কেউ টের পাবে না। এরা পিছন থেকেই আক্রমণ করে। তাই বাঘকে ধোঁকা দিতে জঙ্গলে ঢোকার সময় এলাকার মানুষরা মাথার পিছন দিকে একটি মানুষের মুখোশ পরে নেয়। যাতে বাঘ বুঝতে না পারে কোনটা মানুষের পিছনদিক। শুধু বাঘই নয়, সুন্দববনের আতঙ্ক কুমিরও। তাছাড়া রয়েছে হরিণ, বাঁদর মিলিয়ে মোট ৪২ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী। ২৯০ রকমের পাখি, ১২০ ধরনের মাছ, ৩৫ রকমের সরীসৃপ ও আট রকমের উভচর প্রাণী। ইউনেসকোর ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ও ‘রামসার সাইট’ তকমা পাওয়া সুন্দরবনের জঙ্গলের মোট আয়তন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। তারমধ্যে অবশ্য বেশিরভাগটাই বাংলাদেশের অন্তর্গত। চার হাজার বর্গ কিলোমিটারের মতো আমাদের পশ্চিমবঙ্গে পড়ে।
সুন্দরবন আসলে অনেকগুলি দ্বীপের সমষ্টি। যাকে বলে বদ্বীপ বা ডেল্টা। গঙ্গা এখানে এসে সাগরে মেশার আগে অনেকগুলি উপধারায় বিভক্ত হয়ে এই বদ্বীপগুলির সৃষ্টি করেছে। সুন্দরবনের মূল কয়েকটি নদীর নাম হল মাতলা, বিদ্যাধরী, হেড়োভাঙা প্রভৃতি। নদীগুলি থেকে ছোট ছোট খাঁড়ি ঢুকে গিয়েছে দ্বীপের ভিতর। এই খাঁড়িতেই বাঘের উপদ্রব বেশি। বাঘ অবশ্য নদী সাঁতরে এপার ওপার করতেও ওস্তাদ। নদী সাঁতরে এরা অনেক সময়েই লোকালয়ে ঢুকে পড়ে খাদ্যের সন্ধানে। গৃহস্থের গোরু, ছাগল থেকে শুরু করে মানুষও তুলে নিয়ে যায়।
অনেকে বলেন সুন্দরবন নামটা এসেছে সুন্দরী গাছ থেকে। এখানে সুন্দরী গাছ ভর্তি। তাছাড়া রয়েছে গেঁয়ো, হেতাল, গরান প্রভৃতি গাছ। হেতাল গাছগুলির রং হয় হলদেটে। আধো আলোয় এই হেতালের ঝোপেই লুকিয়ে থাকে হলুদ কালো ডোরাকাটা বাঘ। হেতালের হলদেটে রঙের সঙ্গে মিশে যায় তাদের শরীরের রং। সুন্দরবন এক রহস্যে ঘেরা জঙ্গল। একসময়ে এখানে আস্তানা গেড়েছিল মগ, পর্তুগিজ জলদস্যুরা। এখানেই ছিল প্রতাপাদিত্যের রাজত্ব। তাছাড়া মুঘল সৈন্যদলও এসেছিল সুন্দরবনে। তারও আগে কথিত আছে চাঁদ সদাগরের জমিদারি ছিল এই অঞ্চলে। নেতি ধোপানির ঘাট নাকি সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। তবে এ বিষয়টির ঐতিহাসিক প্রমাণ সেরকম কিছু নেই। যাবে নাকি সুন্দরবনে?
জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট
বেড়াতে যেতে তো সবারই ভালো লাগে। আমার অনেকদিন ধরে ইউরোপের কয়েকটি জায়গা দেখতে যাবার ইচ্ছে ছিল। এর মধ্যে জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট অন্যতম। গত বছর গরমকালে আমরা এই উদ্দেশে বেরিয়েছিলাম। দু’দিন প্যারিসে কাটিয়ে তৃতীয় দিন সকালে আমরা জার্মানির দিকে যাত্রা করলাম, গন্তব্য জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে আল্পস পর্বতমালায় অবস্থিত ব্ল্যাক ফরেস্ট বা কালোবন। শুনেছিলাম, রোমান সম্রাট কারাকাল্লা ও তার সেনাবাহিনী ১৯ শতকের আগে এখানে অনেকটা বন কেটে বসতি স্থাপন করেছিলেন, পরে আবার রোপণের মাধ্যমে বনটি ভরাট হয়। এর পরেও ১৯৯০-এর হ্যারিকেন ঝড়ে এই বনভূমির প্রচুর ক্ষতি হয়, তা সত্ত্বেও যে বিশাল এলাকা জুড়ে এই বনভূমি রয়েছে তা বিস্ময়কর। যেন মনে হয় জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এটি সীমানা নির্দেশ করছে। এই জঙ্গলের গাছগুলি প্রধানত মিশ্র পর্ণমোচী বৃক্ষ।
সকালে প্যারিস থেকে বেরলেও যেহেতু অনেক দূরের পথ তাই পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। রাস্তা এত ভালো আর গাড়িগুলো এত সুশৃঙ্খলভাবে চলে যে পথশ্রমের ক্লান্তিও সেভাবে মনে হল না। আমরা সময় নষ্ট না করে তখনই জঙ্গলটি ঘুরে ঘুরে দেখার জন্য বেড়িয়ে পড়লাম। তবে পায়ে হেঁটে নয়। আমাদের গাড়িটি-পাহাড়ি পথে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুন্দরভাবে জঙ্গলটি দেখাতে লাগলো। এখানে সূর্যাস্ত হয় রাত সাড়ে ন’টায়, ফলে অনেকক্ষণ আমরা দিনের আলো পেলাম। বন এত গভীর যে একদম আলো প্রবেশের পথ পায় না, আল্পস পর্বতমালার এই অংশে গাছগুলি এত লম্বা যে মনে হয় তারা যেন রেশারেশি করে সূর্যের কাছে পৌঁছাতে চাইছে। কিন্তু ভিতরে আলো প্রবেশ করাতে পারেনি। জঙ্গলের এই অন্ধকার বা কালিমার জন্য এর নাম ব্ল্যাক ফরেস্ট। যতক্ষণ সূর্যালোক ছিল ততক্ষণ আমরা বনপথে ঘুরলাম। এরপর হোটেল। হোটেলটির নাম ‘টিটিসি’ (Titisee) আসলে ব্ল্যাক ফরেস্টের মধ্যে একটা অসাধারণ লেক আছে, সেই লেকের ধারেই এই হোটেল। তাই লেকের নামেই নাম। বারান্দায় বেরলেই দেখা যাচ্ছে টলটলে লেকের জল, চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা, বড় বড় গাছের ছায়ায় লেকের জলে হালকা সবুজ আভা। কিছু কিছু নৌকা ভাসছিল, কিন্তু আমাদের আর নৌকাবিহার হয়নি এই লেকে। রাতের খাবারের সঙ্গে এখানকার বিখ্যাত ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক দিয়েছিল, এর স্বাদ এবং গুণাগুণ তো সকলেই জানেন।
পরদিন সকালে গেলাম জার্মানির রাইন নদীর ঝর্ণা দেখতে, এ এক অনবদ্য দৃশ্য। পাহাড়ের মধ্যে থেকে ছোট ছোট ধাপে চওড়া ভাবে নেচে নেচে নামছে, সঙ্গে উচ্ছ্বসিত কলতান। ছোট ছোট ঢেউ তুলে যেন পরের সিঁড়ির দিকে ছুটে চলেছে। এই ঝর্ণা দেখার জন্য আমাদের রাস্তা থেকে অনেকটা নীচে নামতে হয়েছিল, তবে এত সুন্দর ব্যবস্থা করা আছে যে কারুর তেমন কষ্ট হয়নি। এরপর আসি ব্ল্যাক ফরেস্টের বিখ্যাত কুক্কু ঘড়ির কথায়, গেলাম সেখানকার কারখানা ও দোকানে। এখানে প্রধানত কাঠের ওপর খোদাই-এর কাজ হয়। বিভিন্ন রকম কারুকাজ করা ছোট ছোট কুঁড়েঘর ধরনের বানায় এবং তাতে ঘড়ি বসিয়ে দেয়, কোনটায় উপরে একটি জানলা থাকে সেটি খুলে যায় প্রতি ঘণ্টায় এবং একটি পাখি বেরিয়ে এসে ডাকে এবং আবার জানলা বন্ধ করে ঢুকে যায়। কাজের সূক্ষ্মতার উপর ঘড়ির দাম। আমাদের দলের প্রায় সকলেই এই অভিনব ঘড়ি একটি করে সংগ্রহ করেছিল। এই দিনই ব্ল্যাক ফরেস্টে বাস আমাদের শেষ হল এবং আমরা সুইজারল্যান্ডের এনজেলবার্গ শহরের দিকে যাত্রা করলাম।
হলুদ পাখির পালক
হলুদ পাখির পালক। আকাশপথে পাখির চোখে দেখলে তেমনই মনে হয় বটে! আর ডাঙায় নেমে দেখলে মালুম হয়, আসলে বহুরূপ তার। কত রং, কত বাহার, কত রহস্য, কত রোমাঞ্চ, কত রোমান্স, আর কী দুর্গমতা! বড় মিষ্টি নামটি তার, ‘হলুদ পাথর’! এ হল আমেরিকার ইয়োলো স্টোন ন্যাশনাল পার্ক। তবে আর পাঁচটা পার্কের মতো সবুজ গাছগাছালিতে ভরা নয় সে। কারণ তার মাটির নীচে আগুনের আঁচ। তার আনাচেকানাচে ফুটন্ত লাভার চোরাস্রোত। তাই তার মানচিত্র জুড়ে যেদিকে দুই চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। কোথাও ইয়া বড়া বড়া শুকনো পাতার মতো ঘাস, কোথাও গন্ধক রংঙের হলদেটে পাথর, কোথাও ঈষৎ হলুদাভ বেলেমাটি! আর এই সবের ভিতর দিয়ে বটগাছের শাখাপ্রশাখার মতো রাস্তা।
এটাই কিন্তু পৃথিবীর প্রথম জাতীয় উদ্যান। আর কী প্রকাণ্ড বপু তার। তার সীমানার ভিতর দিব্য ঢুকে যাবে পাঁচ পাঁচটা কলকাতা শহর। মার্কিনদেশের তিনটা রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই পার্ক। মন্টানা, ইয়োমিং, আর আইডাহো। আমেরিকার এক্কেবারে উত্তর পশ্চিমে তো, তাই এই পার্কের শরীর জুড়ে সব সময় শীতের শিরশিরানি! খানিক দূরে বেড়া পেরলেই তো আরেক দেশ, কানাডা। পার্কের এপারে ওপারে ঘুরে বেড়ানো মানে, সে বেশ সময় সাপেক্ষ লং ড্রাইভ! এই স্থল তো এই জল, এই মরুভূমি তো সেই মরূদ্যান, এই পাহাড়পর্বত তো সেই সমতল! তবে একটু আনমনা হয়ে চোখ ফেরালেই নিশ্চিত ফসকে যাবে কোনও বিরল দৃশ্য! উদ্যানের ভিতরেই যত রাজ্যের আধোঘুমের আগ্নেয়গিরি, উষ্ণ প্রস্রবণের মতো জলস্তম্ভের ওঠানামা, উত্তপ্ত কাদামাটি। আর তাদের সঙ্গে প্রায় হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে সুশীতল হ্রদ, ঠান্ডা ঠান্ডা জলপ্রপাত, আর কুয়াশার মতো আবছা ধূম্রজাল! তাই এখানে নিজেদের আপন দেশ ভেবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় বাইসন, ভালুক, বুনো কুকুর, এল্ক আর হরিণের দল। ছোট বড় সব গিরিখাত পেরিয়ে, উঁচু নিচু অজস্র টিলার এধারে ওধারে উড়ে বেড়ায় ঈগল আর নানা বর্ণের সারস। তাদের পিছু পিছু গেলেই দেখা যাবে গাছে গাছে ফুটে আছে হলদে গোলাপ, সূর্যমুখী আর লিলি!
সব মিলিয়ে ওই হলুদ পাথরের যে কত শোভা চারপাশে! তবে শুধু দেখলে হবে না, প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হবে। খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশে আচমকা গাড়ির সামনে চলে আসতে পারে যে কোনও জানোয়ার। মাটি ফুঁড়ে হঠাৎ বেরিয়ে আসতে পারে গগনচুম্বী গরম জলের ফোয়ারা, কিংবা তপ্ত বাষ্পের ঝাপসা মেঘ। ইয়োলো স্টোনে পর্যটনের সেরা আকর্ষণ অবশ্যই ‘ওল্ড ফেথফুল’, যেটা আদতে একটা চোখ ধাঁধানো গেজার বা জলস্তম্ভ। কী গর্জন আর কী দাপট তার। তার সঙ্গে সব সময় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কথা বলে চলেছে দুই জলপ্রপাত, রোডসাইড আর ব্যাককান্ট্রি! তাদের পায়ের তলায় বিছিয়ে আছে গরম কাদামাটি। আর ভূগর্ভে চুপটি করে শুয়ে আছে ভয়াল আগ্নেয়গিরি, যার মাত্র একটি থেকে অগ্নুৎপাত হলেই এক পলকে পুড়ে খাক হয়ে যাবে গোটা আমেরিকাটা!
এই হলুদ পাখির পালকের অবশ্য দিনে রাতে দুই রূপ! দিনের বেলায় সে হল যেন কোনও খ্যাপা বিজ্ঞানী। কখন যে তাকে কেমন দেখাবে তার ঠিক নেই। আর দুপুরের কড়া রোদের এই রাগী রাগী ব্যাপারটা হাপিস হয়ে গেলে, রাতের বেলায় সে হয়ে যাবে শান্ত শিষ্ট কবিটি। কখনও জোছনায়, কখনও অন্ধকারে সে এক্কেবারে রাতপরীর ওড়না! মাঝরাতে মাটি আর আকাশের মাঝে সেতু হয়ে দেখা দেবে সেই আশ্চর্য ছায়াপথ। এমন স্পষ্ট মিল্কিওয়ে অন্য কোথাও কম দেখা যায়। নীরব উদ্যানে তখন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ছায়াপথ বেয়ে নেমে আসবে লক্ষ কোটি তারার দল। তাদের কাছে রূপকথার গপ্পো শুনতে শুনতে রাত শেষ হয়ে যাবে। আকাশে সোনার মতো হলুদ আবির ছড়িয়ে দিয়ে উঁকি মারবে সুযিমামা। আর অমনি ঘুমের থেকে জেগে রাজকন্যার নূপুরের মতো ডেকে উঠবে অযুত নিযুত হলুদ পাখি!