সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনি প্রচেষ্টায় সাফল্যের সম্ভাবনা। ন্যায্য অর্থ সঠিক সময়ে নাও পেতে পারেন। অর্থপ্রাপ্তির যোগ ... বিশদ
১২ ডিসেম্বর দরবারের তারিখ। মহা আয়োজন। মহা ধুমধাম। যেমন হওয়ার কথা তার থেকেও অনেক বেশি উজ্জ্বলতা দেখা গেল। কিন্তু প্রাথমিক সব অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পর, হঠাৎ রাজা পঞ্চম জর্জ একটি বোমা ফাটালেন। অর্থাৎ একটি ঘোষণা। যা শুনে গোটা দরবার স্তব্ধ। অবশ্যই ব্রিটিশ প্রশাসনের একটি বিশেষ অংশের অফিসাররা আগে থেকেই জানেন। তবে তাঁরা সম্পূর্ণ মুখ বন্ধ রেখেছিলেন। কারণ আগে থেকেই প্ল্যান ছিল যে, ঘোষণাটি করবেন রাজা স্বয়ং। ঘোষণাটি কী হয়েছিল? রাজা বললেন, আমরা আমাদের প্রিয় জনসাধারণের উদ্দেশ্যে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার নতুন রাজধানী হবে দিল্লি। কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী সরিয়ে আনা হবে। আর একইসঙ্গে তৈরি করা হবে নতুন করে প্রেসিডেন্সি অব বেঙ্গলের জন্য নতুন গভর্নরের পদ। ভারতের উন্নতির জন্য, আরও সুশাসনের জন্য এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা প্রয়োজন।
ঘোষণা শুনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হল ভারতজুড়ে। কেউ কেউ খুশি। আবার কিছু অংশের মধ্যে প্রবল আপত্তি। যাদের আপত্তি তাদের সেই প্রতিবাদ আরও জোরদার হয়ে গেল একটি আকস্মিক দুর্ঘটনায়। যেদিন রাজা পঞ্চম জর্জ কলকাতা থেকে রাজধানীকে দিল্লি সরিয়ে আনার ঘোষণা করলেন, অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর, ১৯১১, ঠিক পরদিন সকালে ১৩ ডিসেম্বর দিল্লি থেকে অনেক দূরে ঘটছিল এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। ঘটনাস্থল আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী জিব্রাল্টার প্রণালী। কী ঘটল?
পঞ্চম জর্জের বোন রাজকুমারী লুইজি খুব খুবই অন্তর্মুখী। তিনি বেশি কথা বলতে অথবা নিজের রাজকুমারী পরিচয়ে রাজবংশের আতিশয্য দেখানোর মোটেই পক্ষপাতী নন। সারাক্ষণই নিজেকে আড়ালে রাখেন। বিয়েটাও করেছেন সেভাবেই। আলেকজান্ডার ডাফ বয়সে অনেক বড় প্রিন্সেস লুইজির থেকে। তাঁকেই বিবাহ করতে সম্মত হয়েছেন লুইজি। তাঁকে করা হয়েছিল ডিউক অব ফাইফ। মহাধুমধাম তো নয়ই। বরং খুবই ক্ষুদ্র পারিবারিক একটা অনুষ্ঠানে সেই বিবাহ হয়েছিল।
দুই মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে নিজস্ব একটা ব্যক্তিগত জীবন কাটান প্রিন্সেস লুইজি। এই পরিবারটির একটিই শখ। তাঁরা মাঝেমধ্যেই দেশবিদেশে ভ্রমণ করেন। দাদা পঞ্চম জর্জ নতুন রাজা হয়েছেন। তাঁর অভিষেক উপলক্ষ্যে দিল্লিতে দরবার ডাকা হয়েছে। সেখানেই সপারিষদ গিয়েছেন রাজা জর্জ। এই সময়টুকুতে তাহলে ভ্রমণে যাওয়া যায়। অতএব এই ডাফ রয়্যাল পরিবার আবার বেরিয়ে পড়ল। ১৯১১ সালের ৮ ডিসেম্বর। যাওয়া হবে মিশর। পেনিনসুলার অ্যান্ড ওরিয়েন্ট কোম্পানির জাহাজের নামটি একটু চেনা চেনা। এস এস দিল্লি। লুইজি ভাবছিলেন এটা বেশ কাকতালীয় বিস্ময়কর ঘটনা। দাদা রাজা জর্জ এবং তাঁর স্ত্রী কুইন কনসর্ট মেরি গিয়েছেন দিল্লিতে দরবারে হাজির হতে। আর তাঁরা যে জাহাজে চড়লেন, সেটার নামও এস এস দিল্লি!
১৩ ডিসেম্বর রাত একটায় জিব্রাল্টার প্রণালীতে যখন জাহাজ ঢুকছে তখন চারদিকে ঘোর কুয়াশা। হঠাৎ কুয়াশার মধ্যেই প্রবল বেগে জাহাজ দুলতে শুরু করল। জাহাজে যত যাত্রী সকলেই রাতের পোশাক পরেই ডেকে হাজির। আতঙ্ক শুরু হল তখন, যখন হঠাৎ একইসঙ্গে প্রবল হাওয়া এবং উন্মত্ত স্রোত। নাবিক ও ক্যাপ্টেনরা দিশাহারা। তারা দ্রুত মেসেজ পাঠাল অন্য একটি জাহাজ আনতে হবে, যেটা অনেক বড়। এসেও গেল। এইচ এম এস ডিউক অব এডিনবার্গ। সমুদ্র সামান্য শান্ত হলে, কিছু মহিলা আর শিশুদের সেখানে পাঠানো হল। ছোট ছোট বোটে করে। কিন্তু আবার যখন সেই বোটগুলি ফিরে আসছে, তখনই ফের ঝড়।
সবেমাত্র প্রিন্সেস লুইজি আর তাঁর পরিবারকে সরিয়ে দেওয়া হবে বোটে চাপিয়ে, কিন্তু সেই সুযোগ পাওয়া গেল না। আচমকা একটি পাহাড়প্রমাণ স্রোত এসে চোখের সামনে দুটো বোটকে ডুবিয়ে দিল সমুদ্রে। তিন নাবিকের সলিল সমাধি। চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকঘণ্টা পর যখন সমুদ্র সামান্য শান্ত, তখন ডাফ পরিবারের সকলেই অচেতন হয়ে পড়েছে। কোনওমতে তাঁদের নিয়ে উপকূলে ফিরল সেই জাহাজ।
আর সেই খবর যখন এসে পৌঁছল দিল্লিতে, ম্লান ও বিবর্ণ হয়ে গেল পঞ্চম জর্জের মুখ। ব্রিটিশ অফিসারদেরও। কারণ অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, যেদিন কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের ঘোষণা হল, তার কিছু ঘণ্টা পর এভাবে সমুদ্রে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন স্বয়ং রাজকুমারীর পরিবার, যে রাজকুমারী পঞ্চম জর্জের সবথেকে আদরের বোন। এটা কিন্তু একটি অভিশাপেরই পূর্বাভাস! তাহলে কি রাজধানী স্থানান্তর সর্বশক্তিমান ঈশ্বর অথবা নিয়তি চাইছেন না? জোরদার চর্চা এবং জল্পনা শুরু হল। কিন্তু এই কারণ দেখিয়ে তো আর এত বড় সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা যায় না! অতএব সিদ্ধান্ত কার্যকর করা শুরু হল। সেই দরবারের জমিতে এই ঘোষণার পর একটি পাথর বসানো হয়েছিল। যেখানে লেখা ছিল, দ্য ট্রান্সফার অব দ্য সিট অব গভর্নমেন্ট ফ্রম ক্যালকাটা টু দিল্লি... ইত্যাদি।
পাথর জোগাড় হয়েছিল তাড়াহুড়ো করে। জানা গেল, যে পাথর দরবারস্থলে বসানো হয়েছিল নতুন রাজধানীর শিলান্যাস হিসেবে, সেটি আসলে সমাধি কিংবা কবরে ব্যবহার করা হয়! তাহলে কি ডাবল অভিশাপ? কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী সরানোই কি শেষের শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের? কোথায় হয়েছিল সেই বিখ্যাত দিল্লি দরবার? সেটাই আজকের করোনেশন পার্ক! দিল্লির এক প্রান্তে বুরারি রোডে যে পার্ক আজ রাজধানীর মহা ব্যস্ততার ভিড় থেকে অনেক দূরে একাকী নির্জনতায় নিমগ্ন হারানো ইতিহাস নিয়ে!