মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল দারুণ। সৌমিত্রর ওপর একটা শ্রদ্ধামিশ্রিত স্নেহ ছিল তাঁর। এর প্রথম এবং প্রধান কারণ দুজনেই নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির অন্ধ ভক্ত। এছাড়া দুজনেই ব্রিটিশ বিদ্বেষী। আর একটি কারণ হল সৌমিত্রর শিক্ষাগত যোগ্যতা, ফিল্ম সম্বন্ধে অগাধ জ্ঞান। অভিনেত্রী সংঘ ভেঙে যখন শিল্পী সংসদ তৈরি হল তখন বাংলা ছবির সংকটময় পরিস্থিতি। সেইসময় ভানু একজনকে বলেছিলেন,‘সৌমিত্র তো প্রফেসরি কইর্যা সংসার চালাইয়া লইব। কিন্তু তুই তো লেখাপড়া জানস না। তুই অখন কী করবি ভাইব্যা দ্যাখ।’
এমনও হয়েছে, সবে হার্ট অ্যাটাক থেকে উঠেছেন। ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেছে। এদিকে রঙ্গনায় শো। ভানু কিছুতেই শুনবেন না। নাছোড়, যাবেনই। বেগতিক দেখে সৌমিত্রকেই ফোন করেন স্ত্রী নীলিমাদেবী। তাঁর ফোন পেয়ে ছুটে আসেন সৌমিত্র। ওঁর কথাই তখন একমাত্র শুনতেন। সৌমিত্র বারণ করলেন। নিজে ফোন করে রঙ্গনার মালিক হরিদাস সান্যালকে শো ক্যানসেল করতে বললেন। তাতে ভানুকে দমানো গেল।
তবে শুধু উত্তমকুমার-সৌমিত্র বা জহর রায় নন, রবি ঘোষ-অনুপকুমাররাও খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন ভানুর। বাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা চলত। ভানু মদ্যপান করতেন। কিন্তু স্ত্রী নীলীমাদেবীকে এতটাই শ্রদ্ধা করতেন যে, ওঁর পছন্দ নয় বলে কোনওদিন বাড়িতে মদ ঢোকেনি। আসলে বাড়িতে তিনি ছিলেন একদম বিপরীতধর্মী মানুষ। পর্দার সঙ্গে সেখানে সাদৃশ্য খুঁজতে গেলে মুশকিল। আদর্শ, মূল্যবোধ, ভ্যালুজ শব্দগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর কাছে। তাঁর কন্যা বাসবী বলছিলেন, ‘সিনেমা টিনেমা নিয়ে কোনও কথাই হতো না বাড়িতে। সাংঘাতিক সব নিয়মকানুন ছিল বাবার। রাস্তায় আলো জ্বলার আগে সকলকে বাড়ি ফিরতে হতো। বাড়ির সকলে মিলে রাত ৯টায় খেতে বসা ছিল মাস্ট।’
সংসারে সময় দিতে পারেননি সেভাবে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, কেরিয়ার নিয়েও কোনওদিন মাথা ঘামাননি। পরিবার নিয়ে দূরে বেড়াতে যাওয়াও হয়ে ওঠেনি। তবু মুম্বইয়ের অফার নিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন। গুরু দত্তের ‘পিয়াসা’র অফার ছেড়েছেন। ছেড়েছেন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুসাফির’। বন্ধুদের আব্দারে কোনওরকমে পরিচালক সত্যেন বসুর ‘বন্দিশ’, দুলাল গুহর ‘এক গাঁও কি কাহানি’ আর তপন সিংহর ‘সাগিনা’ ছবি করেছেন। কিন্তু ফিরিয়ে দিয়েছেন বিমল রায়, শক্তি সামন্ত, প্রমোদ চক্রবর্তীর মতো পরিচালকদের। সবই এই বাংলার টানে, পরিবারের থেকে দীর্ঘদিন দূরে গিয়ে থাকতে হবে, এই আশঙ্কায়।
তাঁর বঙ্গপ্রেমের আর একটা ঘটনার উল্লেখ না করেও পারছি না। সেই ঘটনার কথা ‘সাতরঙ’ বইয়ে লিখেছেন ভানু ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক রবি বসু। সরোজিনী নাইডুর কন্যা পদ্মজা নাইডু তখন পশ্চিমবঙ্গের নতুন রাজ্যপাল হয়ে এসেছেন। রবি একদিন ভানুকে বলেন, ‘আমাদের নতুন রাজ্যপাল তো তোমার আত্মীয়। চলো না একদিন ওর অতিথি হয়ে রাজভবনে রাত্রিবাস করে আসি।’ শুনে ভানু খুব গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, ‘যে বাঙালি মায়ের মেয়ে বাংলা ভাষা জানে না, তার বাড়িতে আমি রাত্রিবাস করি না।’ আসলে পদ্মজা নাইডু বিদুষী হলেও প্রবাসে মানুষ হয়েছিলেন। দক্ষিণ ভারতই ওঁর মাতৃভূমি। তাই বাংলা ভাষাটা উনি জানতেন না। এই একটা অপরাধেই তিনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে অপরাধী হয়ে গিয়েছিলেন।
তবে অন্যকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজের কেরিয়ারের ক্ষতিও করেছেন ভানু। অনেককে চান্স করে দেওয়ার জন্য সিনেমা, থিয়েটার, ফাংশন, রেকর্ড কোম্পানি এমনকী বোম্বেতেও দরবার করেছেন। আর এটা করতে গিয়ে জীবনে অনেক ভালো ভালো রোল হাত থেকে চলে গিয়েছে। কারণ ভানুর পছন্দের আর্টিস্ট নিতে তাঁরা রাজি নন। এছাড়া ভাগ্যও অনেকসময় তাঁর বিরুদ্ধে গিয়েছে। ৫৪ থেকে ৬০ তাঁর পরপর ছবি হিট। ‘পুষ্পধনু’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘ডাক্তারবাবু’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, ‘ছেলে কার’, ‘গৃহপ্রবেশ’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘টনসিল’, ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’। এইসময় ভানুর বাড়িতে সকাল থেকে প্রোডিউসার, ডিরেক্টরের ঢল লেগে থাকত। এরপর তাঁকে হিরো বানিয়ে পরপর কয়েকটি ছবি সুপারহিট হল। ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, ‘ভানু পেল লটারি’, ‘কানামাছি’, ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট’। কিন্তু বাড়িতে প্রোডিউসার ও ডিরেক্টরদের আসা কমে গেল। কারণ, এক তো ভানু ছোট পার্টের অফার আর নিচ্ছিলেন না, তারপর এতগুলো ছবি হিট হওয়াতে তিনি কী রেট চাইবেন, সেই ভয়ে আর কেউ আসত না। ভানু একসময় গর্ব করে বলতেন, ‘ওরা থাকে ওধারে ছবিতে ছবিদা (বিশ্বাস) ও সুচিত্রা ১ হাজার ৫০০, আমি ও উত্তম ১ হাজার টাকা নিয়েছিলাম।’
তখন ভানু আর ছোট পার্ট নিতেই চাইতেন না। একবার এক পরিচালক এসে বললেন,‘ভানুদা আপনার জন্য একটা খুব ভালো রোলের অফার নিয়ে এসেছি।’ ভানু জিজ্ঞেস করলেন,‘কদ্দিনের শ্যুটিং?’
উনি বললেন, ‘পার্টটা ছোট কিন্তু রোলটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট, অনেক কষ্ট করে তিনদিনের কাজ বের করেছি।’ শুনে ভানুর উত্তর, ‘যেখান থিক্যা বাইর করস হেইখানেই ঢুকাইয়া দাও।’ ১৯৬৩-৬৪ সালে একবার কিশোরকুমার বেশ কয়েকজনকে নিয়ে ভানুর বাড়িতে এলেন, ‘ছদ্মবেশী’ নামে একটা বাংলা ছবির অফার নিয়ে। তখন গায়ক-নায়ক হিসেবে কিশোরকুমারের খুব নাম। দু’আড়াই ঘণ্টা ধরে আড্ডা চলল। কিশোর সায়গলের অনেক গান আর একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনালেন এবং বললেন, ‘আমি গুনে গুনে সাতটি রবীন্দ্র সঙ্গীত জানি।’ ভানু রঞ্জিত রায়ের প্যারোডি গানের ভক্ত ছিলেন। কিশোরকে প্যারোডি গান শোনাতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে কিশোর গেয়ে উঠলেন,‘অনেক দুঃখে বলছি আমি, হাসলে পরে হেসো, ভূতপূর্ব বাবা আমার বর্তমানে মেসো।’ এইসব আড্ডা, হাসিঠাট্টা করে তারপরে স্ক্রিপ্ট শুনে ভানু বললেন, ‘কিশোরবাবু, আপনার সঙ্গে গল্প করে আমার খুব ভালো লাগল, কিন্তু কমেডি ছবিতে সেকেন্ড লিড রোল করব না।’ শুনে কিশোরকুমার একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। ‘তার চেয়েও আমাদের বেশি দুঃখ হল এই ভেবে নিশ্চয়ই এটাও ‘লুকোচুরি’র মতো আর একটা মজার ছবি হতো। তাছাড়া কিশোরকুমারের গান, মজার মজার কথাও মাঝে মাঝে শোনা যেত’, বলছিলেন ভানুপুত্র গৌতম।
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: চন্দন পাল