কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
এর ষাট বছর পরে (২০১২) কচ্ছ প্রদেশে আমি আর এক দেবীর দর্শন পাই। তিনি হলেন আশাপুরা মাতা। আশাভূরি থেকেই আশাপুরা কিনা তা জানি না। ভুজ থেকে ৯০ কিমি দূরে ‘মাতা-নো-মঢ়’ নামক স্থানে এই দেবীর অধিষ্ঠান। মঢ় কথাটির অর্থ হল মঠ, আশ্রয় বা অধিষ্ঠান। মায়ের অধিষ্ঠান এখানে, তাই মাতা-নো-মঢ়।
আশাপুরা দেবী হলেন কচ্ছের রাজাদের কুলদেবী। সারা রাজ্যে এই দেবীর মান্যতা খুব। সৌরাষ্ট্রের রাজাদেরও কুলদেবী ইনি। গুজরাতের সর্বত্র অদ্যাবধি শক্তি পূজার প্রচলন আছে। রাও খেঙ্গারজি (১৫১০-১৫৮৬) এ দেশের প্রথম রাজপুত রাজা যিনি সারা কচ্ছে তাঁর রাজ্যবিস্তার করেন। তখন থেকেই এই দেবী ছিলেন মহারাওদের আরাধ্যা দেবী। জাতিধর্ম নির্বিশেষে এই মন্দিরের দ্বার সবার জন্যই উন্মুক্ত।
ছোট্ট জনপদে এই দেবীস্থান। এখানকার দেবী সকলের আশা ও মনোবাসনা পূর্ণ করেন বলেই এর আশাপুরা নাম। প্রতিদিন বহু যাত্রী এই মরুময় প্রান্তরে দূরদূরান্ত থেকে এসে দর্শন করেন মাতাকে।
এখানকার এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেন, খ্রিস্টিয় নবম শতাব্দীতে এখানে প্রথম মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। তাহলে এর নির্মাণকাল ১২০০ বছর আগে। কারও মতে, দেবীর প্রতিষ্ঠাকাল ৭০০ বছর আগে চতুর্দশ শতাব্দীতে। তবে বর্তমান মন্দিরটি ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের। কেননা প্রাচীন মন্দির ১৭৯৯-এর ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়।
মন্দির প্রাঙ্গনে প্রবেশ করে দেখলাম প্রশান্ত চত্বর। একপাশে বিশাল ধর্মশালা, ভোগমণ্ডপ, মধ্যস্থলে আশাপুরা মাতার মন্দির। কথিত আছে, সিন্ধের শাসন কর্তা খির গুলাম ১৭৬২-তে এখানে আক্রমণ ও লুণ্ঠন চালালে সসৈন্য গুলাম শা দেবীর প্রকোপে অন্ধ হয়ে যান। পরে নিজের দোষ স্বীকার করে আকুল হৃদয়ে দেবীর কাছে প্রার্থনা করলে আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান সকলে। তাই অভিভূত গুলাম শা অর্ঘ্য হিসাবে মন্দিরে দান করেছিলেন চারশো কেজি ওজনের এক বিশাল ঘণ্টা। মন্দিরে রয়েছে ৪১ প্রদীপের রূপার তৈরি একটি দীপদান। জমাদার ফতে মহম্মদ দেবীকে এটি অঘ্য হিসেবে দান করেন।
এখানে এই দেবীর আবির্ভাব সম্বন্ধে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে—
প্রায় দেড় হাজার বছর আগে দেবচন্দ শাহ নামে এক মারোয়াড়ি ‘করার বৈশ্য’ (বেনিয়া) দূরদেশে ব্যবসায় কারণে তাঁর বানজারন নিয়ে এখানে এসে পড়েন। তখন আশ্বিন মাস। দেবীপক্ষ। নবরাত্রির সময়। শক্তি এবং যোগমায়ার পরম ভক্ত দেবচন্দ নবরাত্রি পালন করবেন বলে সেখানেই ছাউনি ফেললেন।
নবরাত্রির শেষ রাতে ব্রাহ্মমুহূর্তে দেবী যোগমায়া দেবচন্দকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, ‘দেবচন্দ! তোমার আরাধনায় আমি সন্তুষ্ট। সে জায়গায় ঘট পেতে তুমি আমার অধিষ্ঠান করেছ ঠিক সেখানেই আমি প্রকট হতে চাই। তাই ওখানেই তুমি আমার একটা মন্দির তৈরি করিয়ে দাও। তবে একটা কথা, মন্দির তৈরি হওয়ার পর ছয় মাস পর্যন্ত যেন ওই মন্দিরের দ্বার খুলো না। ছয় মাস পরে আমি প্রকট হব এবং তোমার যদি কোনও মনোবাসনা থাকে তা পূর্ণ করব।’
স্বপ্নভঙ্গে দেবচন্দ জাগ্রত হয়ে উঠে বসে দেখলেন তাঁর মাথার কাছে একটি চুনরী, কিছুটা চাল ও একটি নারিকেল রাখা আছে। তাই দেখে তাঁর আনন্দের সীমা রইল না। সেই থেকে তিনি বাণিজ্য বন্ধ রেখে সেখানেই বসবাস করতে লাগলেন।
দেবচন্দ মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করলেন। কাজ শেষ হলেও তিনি রয়ে গেলেন সেখানেই এবং ঘরে বসে দেবীর আরাধানা করতে লাগলেন। এই ভাবে পাঁচ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এক সন্ধ্যায় দেবচন্দ শুনতে পেলেন মন্দিরের ভেতর থেকে সুমধুর সুরে নারীকণ্ঠের গান ও নূপুরের ধ্বনি ভেসে আসছে। শুনেই অধীর হলেন দেবচন্দ। মনে মনে ভাবতে লাগলেন দেবী নিশ্চয়ই প্রকট হয়েছেন। তাই কৌতূহল মেটাতে মন্দিরের দ্বার খুলে দিলেন। থেমে গেল দেবী গান। নূপুরের ঝংকার। কেউ তো নেই ঘরে। শুধু দেখা গেল ঘরের মেঝে ফুঁড়ে উঠেছে একটি শিলিখণ্ড এবং তাতেই দেবীর অসম্পূর্ণ মূর্তির প্রকাশ। এতক্ষণে দেবীর নিষেধাজ্ঞা স্মরণে এল দেবচন্দের। এখনও তো ছয়মাস পূর্ণ হয়নি। পাঁচ মাস চলছে সবে। সর্বনাশ।
দেবচন্দ তখন লুটিয়ে পড়লে সেই পাষাণ প্রতিমার চরণে। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘হে মা জগদম্বে! আমি তোমার নিষেধ অমান্য করে দরজা খুলেছি। আমাকে ক্ষমা করো। কৃপা করো।’
দেবী তখন দেবচন্দকে দেখা দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে ক্ষমা করলাম দেবচন্দ। তবে আমার এই অধুরা মূর্তি আর সম্পূর্ণ হবে না। আমি এরই মধ্যে চিরকাল অধিষ্ঠিতা থাকব। এখন তুমি আমার কাছে বর প্রার্থনা করতে পারো। যদি তোমার মনে কোনও আশা আকাঙ্খা থাকে তাহলে বলো আমি তা পূরণ করে দেবো।’
দেবচন্দ বললেন, ‘মা, তোমার কৃপায় আমার কোনও কিছুরই অভাব নেই। শুধু একটি অভাব আছে, আমি নিঃসন্তান। যদি তোমার কৃপায় আমি একটি পুত্রসন্তান লাভ করতে পারি তো ধন্য হই।’
দেবী তথাস্তু বলে অন্তর্ধান করলেন।
দেবীর বরে দেবচন্দ যথাসময়ে একটি পুত্রসন্তান লাভ করলেন এবং বরাবরের জন্য মন্দিরের কাছাকাছিই বাস করতে লাগলেন। সেই থেকে দেবচন্দ শাহর বংশ ‘মাহেশ্বরী বানিয়া’ নামে খ্যাত হল।
আশাপুরা মাতাকে দর্শনের পর চলে এলাম প্রাঙ্গনেই চাচারা মাতার স্থানে। এখানে শিশুদের মস্তক মুণ্ডনের প্রথা আছে। এর গঙ্গাসম পবিত্র চাচারা কুণ্ডের জল মাথায় নিয়ে ধর্মশালা সংলগ্ন ভোগমণ্ডপে এলাম প্রসাদ গ্রহণ করতে। মাত্র দশ টাকায় দমভর প্রসাদপ্রাপ্তিতে মন যেন ভরে গেল।