কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
মাউন্ট আবুতে তিন-চারবার গেলেও অম্বাজিতে এলাম দু’বার। আবু রোড স্টেশন থেকে অম্বাজির দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। প্রতি বছর বিভিন্ন সময়ে অগণিত তীর্থযাত্রী এই মহাতীর্থে এসে থাকেন। অর্বুদাচল বা অম্বাজি তীর্থের এই অম্বাজির নাম ভারতময় বিখ্যাত।
অনেকেই মাউন্ট আবু দেখার পর অম্বাজিতে গিয়ে সময় নষ্ট করতে চান না। শতকরা আশিজন যদি মাউন্ট আবুতে যান, তো কুড়ি জন অম্বাজিতে আসেন। অথচ স্থানটি শুধু তীর্থভূমি নয়, অতীব রম্যস্থান। এখানে যাতায়াতেরও কোনও অসুবিধা নেই।
আমি অম্বাজিতে এসে আগে যেখানে উঠেছিলাম সেই পুরুষোত্তম ধর্মশালাতেই উঠলাম। এই নবরাত্রির সময়েও মাতৃমহিমায় ঘর পেতে কোনও অসুবিধে হল না আমার।
ধর্মশালায় জিনিস রেখে প্রথমেই চললাম দেবী দর্শনে। দলে দলে যাত্রীরা চলেছেন ‘জয় অম্বে’ ধ্বনি দিয়ে। যাত্রীদের মধ্যে রাজস্থানি এবং গুজরাতিই বেশি। লাল চোলি, নারকেল, ধূপ, সিঁদুর আর ফুলমালা নিয়ে চলেছেন সবাই। ওইরকম একটি ডালি নিয়ে আমিও চললাম। মন্দির খুব কাছেই। সেই পুরনো মন্দির ভেঙে এখন নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে। দেবীর অধিষ্ঠানও এখন দোতলায়। যাই হোক, বিশাল মন্দির প্রাঙ্গণের সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে দর্শনের জন্য লাইন দিলাম। ভাগ্য ভালো যে, নবরাত্রি উপলক্ষেও ভিড় বেশি ছিল না। তাই অনায়াসেই দেবীকে দর্শন করলাম। এখানে দেবীর কোনও মূর্তি নেই। দেবী এখানে যন্ত্রে স্থিতা। এদেশে পাণ্ডার উপদ্রব নেই। পূজার ডালি এগিয়ে দিতেই পূজারীরা তা দেবীর যন্ত্রে স্পর্শ করিয়ে ফেরত দিলেন। পূজার প্রসাদ নিয়ে এবার এলাম চাচরে। চাচর হল বিশাল নাটমন্দিরে দেবীর সম্মুখে এক জ্বলন্ত কটাহ। এর অনির্বাণ দীপশিখা কোন সুপ্রাচীনকাল থেকে জ্বলে আসছে তা কেউ জানে না। ভক্তযাত্রীগণ সেই কটাহ মধ্যে সাধ্যমতো ঘি ঢালছেন। দেবী নাকি এতেই প্রসন্না হন। অম্বাজির মন্দির শ্বেত-পাথরের। মন্দিরের সামনে যে বিশাল প্রাঙ্গণ তাকেও চাচর বলা হয়। শারদ ও বাসন্তী নবরাত্রিতে গুজরাতি মেয়েরা এখানে গরবা নাচেন।
মন্দির দর্শন করে এর পিছনে মান সরোবর নামে এক জলাশয় আছে, সেটি দেখতে গেলাম। এর নাম দেবী কুণ্ড। তীর্থযাত্রীরা এই কুণ্ডে স্নান করে দেবীকে দর্শন করতে যান।
মন্দির দর্শনের পর এবার আমি চললাম দেবীর মুখ্য স্থান দর্শন করতে। অম্বাজি ক্ষেত্র থেকে আড়াই কিমি দূরে ছোট্ট একটি পর্বতের উপর দেবীর মুখ্য স্থান। এটি ‘গব্বর’ নামে পরিচিত। এখানে যাওয়ার জন্য শেয়ারের ট্যাক্সি মেলে। আমি এমনই একটি ট্যাক্সি নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘গব্বরে’ এলাম। দারুণ রমণীয় মনোমুগ্ধকর পার্বত্য পরিবেশ এখানকার। বনময় এই স্থানও যাত্রী সমাগমে জমজমাট। গব্বরে গিয়ে পর্বতারোহণ শুরু করলাম। ছোট্ট পর্বত কিন্তু ভয়ঙ্কর খাড়াই। মোচাকৃতি ও বৃক্ষবিরল। এই পর্বতে আরোহণ দুর্বল ও অশক্ত লোকেদের পক্ষে কষ্টকর। তাই এখানে ডুলির ব্যবস্থাও আছে।
পাহাড়ের বেশ কিছুটা উচ্চস্থানে ওঠার পর একটি বিশাল আয়তনের গুহার সামনে এসে দাঁড়ালাম। এই স্থানটির নাম দেবী কি ঝুলা। এখানে পুরোহিত আছেন। পুলিস পাহারাও আছে। একটি সুবৃহৎ পাথরের ফাটলে অনেক যাত্রী কান পাতছেন। কী ব্যাপার? পুরোহিত বললেন, ‘এই ফাটলে কান পাতলে হরগৌরীর কথোপকথন শুনতে পাওয়া যায়।’ ভীষণ কৌতূহল হল আমার। ভিড় একটু কম হলে অনেকক্ষণ কান পেতে রইলাম। কিন্তু না। কোনও শব্দই কানে এল না আমার। হয়তো আমি ভাগ্যবান নই।
এরপর খাড়াই বেয়ে আবার উপরে ওঠা। পথটি খুবই বিপজ্জনক। সেই পথ পার হয়ে আরও এক গুহামন্দিরে ঢুকলাম। ভেবেছিলাম এটাই দেবীর মুখ্যস্থান। কিন্তু পুরোহিতরা বললেন, ‘না। সে স্থান আরও উপরে।’
অতএব আরও উচ্চস্থানে গিরিশৃঙ্গের শীর্ষদেশে পৌঁছলাম। এখানেই দেবী দুর্গা শিবের জন্য সহস্র বছর তপস্যা করেছিলেন। এই সেই মহাপীঠ, যেখানে সতীর অঙ্গ ‘বাঁয়া পের কি অঙ্গুলি গিরা থা’ অর্থাৎ বাঁ-পায়ের আঙুল পড়েছিল। এখানে সামান্য একটু সমতল আছে। তারই একপাশে দেবীর মুখ্যস্থান। সেখানে পুলিস প্রহরায় জোর পুজো-পাঠ চলছে তখন। সেই স্থানের সৌন্দর্যের কোনও তুলনা নেই। ছোট্ট একটি মন্দিরে আছেন অম্বাজি। এখানেও দেবীর সম্মুখে ঘৃত প্রদীপ জ্বলছে। শুধুমাত্র জানা না থাকার কারণে এই রম্যস্থানে এর আগে আসিনি ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবে দেবীর কৃপায় এ যাত্রায় দর্শন থেকে যে বঞ্চিত হলাম না এই ভেবেই আনন্দে নন্দিত হলাম। এবার অন্য পথে নীচে নামা। অবতরণ কষ্টের নয়। তাই সহজেই নেমে এলাম। পরদিন সকালে চললাম এখান থেকে পাঁচ কিমি দূরে গুজরাত প্রদেশে সরস্বতীর উৎস দেখতে। এখানেও অনুচ্চ একটি পাহাড়ের উপর সরস্বতীর উৎস। সরস্বতী এখানে বেগবতী ও স্রোতস্বিনী। উৎসমুখ থেকে নেমেই সরস্বতী কুণ্ড। ঝর্ণার আকারে বয়ে এসে নদী এখানে গোমুখ কুণ্ডে পড়ছে। এর পাশেই কোটীশ্বরের শিব মন্দির। মন্দিরটি অতি প্রাচীন।
আমি সরস্বতী কুণ্ডে স্নান করার পর বাল্মীকির তপোবনে এলাম। তপোবন কোটীশ্বরের নীচে। শোনা যায়, মহামুনি বাল্মীকি নাকি রামায়ণ রচনার আগে এখানে সরস্বতীর কৃপালাভের আশায় আশ্রম রচনা করে কিছুকাল বসবাস করেন। ফেরার পথে এলাম কুম্ভারিয়াজির মন্দির দেখতে। কী অনবদ্য ভাস্কর্য সেই মন্দিরের। আরও একবার অম্বাজি-দর্শনে না এলে এ সবই আমার অদেখা রয়ে যেত। সেদিনটা ছিল বাসন্তী নবরাত্রির মহাষ্টমী। মন্দির প্রাঙ্গণে লোক যেন ভেঙে পড়েছে। অম্বাজির সন্ধ্যারতির সময় চাচরে এসে বসলাম। তখনই শুরু হল গুজরাতি রমণীদের অনবদ্য গরবা নাচ। নাচের সঙ্গে গান। বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নৃত্যগীত সমানে চলতে লাগল। নির্মেঘ আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র আর নীচে দেবী মন্দিরে ঘৃতদীপালোকে সেই রমণীয় নৃত্যকলা এখানকার পরিবেশটাকে যেন স্বর্গীয় করে তুলল। এবারের যাত্রায় আমারও জন্মান্তর হল। (ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল