কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
প্রত্যেক রবিবার দুপুরে এই বাড়িতে এসে আমরা পরলোকতত্ত্ব নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতাম। কোনও কোনও সময় আমাদের আর একজন বিশিষ্ট সভ্য কলকাতা হাইকোর্টের সলিসিটার পূর্ণচন্দ্র মুখার্জির বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে, আবার কখনেও অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত ফরাসি হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার বেরিগনীর চেম্বারেও আমাদের পারলৌকিক চর্চার বৈঠক বসত।
একদিন মিউগেন্স সাহেবকে বললাম, আমি বাড়িতে মাঝে মাঝে মিডিয়াম হয়ে ‘স্পিরিটের’ সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খুব ভালো পারছি বলে মনে হচ্ছে না। মিউগেন্স সাহেবের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বললাম, — অথচ বিলেতের কাগজে পড়েছি, এফিসিয়েন্ট মিডিয়ামের সাহায্যে তারা একান্ত আপনজনের স্পিরিট নিয়ে আসছে....
— মিডিয়াম জিনিসটা কি? কারা হতে পারে মিডিয়াম? আর এক সলিসিটার নরেনবাবু কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।
— মিডিয়াম হলো, মৃত ব্যক্তির আত্মা এবং জীবিতদের ভেতরে যোগাযোগকারী— A link between the dead and the living. একটু থেমে আবার মিউগেন্স সাহেব বললেন, যাদের মনের গঠন খুব বলিষ্ঠ এবং যাদের একাগ্রতা অর্থাৎ কনসেনটেশন করার ক্ষমতা খুব বেশি তারাই ভালো মিডিয়াম হতে পারে— কয়েক মুহূর্ত কি যেন চিন্তা করলেন। কেন যেন খুশির আমেজে মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, বিলেতে আমার স্পিরিচ্যুয়ালিস্ট বন্ধুদের কাছে লিখেছি একজন মিডিয়ামকে পাঠাতে। কিছুদিন বাদেই এসে পড়বে।
ইংল্যান্ড থেকে মিডিয়াম আসবে জেনে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলাম। আনন্দে , উত্তেজনায় অধীর হয়ে মিডিয়ামের অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু....
হতাশ হতে হলো। একদিন মিউগেন্স জানালেন, বিলেত থেকে মিডিয়াম আসছেন না।
দিন কাটে। আমরা একজন স্যুটেবল মিডিয়ামের খোঁজখবর করতে থাকি। বন্ধুবান্ধবদের ভেতরে একে বলি তাকে বলি।
একদিন ডাক্তার রাজকৃষ্ণ মিত্র নিয়ে এলেন এক যুবককে। বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা। চোখে মুখে বুদ্ধির ছাপ আছে। তার নাম নিত্যরঞ্জন ঘোষ। সে নাকি খুব ভালো মিডিয়াম। যে কোনও আত্মাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে পারে। অশরীরী সেই আত্মা তার ওপরে ভর করে। পরলোকগত মানুষটির যা কিছু বক্তব্য ওই মিডিয়ামের মাধ্যমেই বলতে থাকে।’
তারপর কী হল! দিনটা ছিল শনিবার। সকাল থেকেই মুখ গোমড়া আকশের। প্রকৃতি কেমন যেন থম মেরে রয়েছে। সেই কোন ভোর থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। তবে প্রবল নয়, প্রথম বর্ষার পিটপিটে বৃষ্টি। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে উপেক্ষা করেই বিকেলবেলায় তিন বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্র, মিউগেন্স ও মিঃ ইনিয়াস ব্রুস তাঁদের চার্চ লেনের অফিসে পৌঁছে গেছেন। প্রকৃতির মতো তাঁরাও যেন কেমন থম মেরে বসে আছেন।
নীরবতা ভাঙলেন প্যারীচাঁদ। খোলা জানলা দিয়ে দৃষ্টি মেলে দিলেন মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে। তারপর মিউগেন্সকে বললেন, আর একটু বাদেই সন্ধে নামবে। এইরকম আবহাওয়া প্রেতচক্রের পক্ষে দারুণ অনুকূল। আজ যদি একজন ভালো মিডিয়াম পাওয়া যেত তাহলে খুব ভালো হতো! মিউগেন্স বন্ধুর কথার কোনও উত্তর না দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন বাইরের দিকে।
আর ঠিক সেইসময় প্রায় উদভ্রান্তের মতো ডাক্তার রাজকৃষ্ণ মিত্র এক বলিষ্ঠ যুবকের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে প্রবেশ করলেন। ভেজা ছাতাটা দরজার পাশে দাঁড় করিয়ে তিনি বললেন, প্যারীবাবু, আর কোনও চিন্তা নেই, আমরা আমাদের মিডিয়ামের খোঁজ পেয়ে গিয়েছি। এর নাম নিত্যরঞ্জন ঘোষ। খুব ভালো মিডিয়াম। আমরা আজই একে পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
রাজকৃষ্ণ মিত্রের এই প্রস্তাবে তাঁর তিন বন্ধু প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। সোল্লাসে তাঁরা শুরু করলেন জোগাড়যন্ত্র। নিত্যরঞ্জন বেশ গম্ভীরমুখে তাঁদের কাজকর্ম দেখতে দেখতে বললেন, সেজবাতিটা আরও কমিয়ে দিন। এত আলোতে তাঁদের আসতে কষ্ট হয়।
নিত্যরঞ্জনের কথামতো ডাক্তার মিত্র আলোটা একদম কমিয়ে দিলেন। বাইরে তখন আঁধার নামছে, ঘরেও নেমে এল অন্ধকার। নিত্যরঞ্জনকে মিডিয়াম করে চার বন্ধু মাটিতে গোল হয়ে বসে পড়লেন।
প্যারীচাঁদ লিখছেন, ‘ঘরের সেই ছায়া-ছায়া অন্ধকারে আমাদের এক-একজনকে প্রেতলোকের অভিশপ্ত আত্মার মতো মনে হতে লাগল। আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি। নিত্যর মারফত কোন প্রেত আসবে— কেমন করে আসবে— সেই ভেবে অসহ্য উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠছি। আমরা লক্ষ করলাম— নিত্যর সারা শরীর যেন একটু একটু করে শক্ত হয়ে উঠছে। থর থর করে কাঁপছে সে। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। আর আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়ে সে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আর সেই বৃষ্টি মাথায় করেই পাশের বাড়ির প্রাচীরের গায়ে একটা নিমগাছে তড়াক করে উঠে পড়ল। আমাদের তো গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল এই কাণ্ডকারখানা দেখে। মিউগেন্স সাহেব করলেন কি— নিজেই সেই গাছে উঠে জোর করে নিত্যকে নামিয়ে নিয়ে এলেন।
সে তখন একেবারে অন্য মানুষ। তার মুখের দু’পাশ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে। কেমন নিস্তেজ আর অলস হয়ে বসে রইল সে। চোখ দু’টোর দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত আর কেমন সুদূর। আমাদের কাউকে যেন দেখেও দেখতে পাচ্ছে না। হঠাৎ বিকৃত গলায় বলতে লাগল— আপনারা কেন আমাকে এখানে ডেকেছেন? আমার সম্বন্ধে জানতে চান? তবে শুনুন।’