পেশা ও ব্যবসায় অর্থাগমের যোগটি অনুকূল। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ... বিশদ
কালিম্পং যাব মনস্থির করেছি আর বিখ্যাত মর্গান হাউসে রাত্রিবাস করব না, তা তো হতে পারে না। যাচ্ছি যাব করেও এতদিন সুযোগ হয়নি। এবার সুযোগ আসতেই মর্গান হাউসে দু’এক রাতের ডেরা বাঁধার প্ল্যান ছকে ফেললাম। আমাদের বরাদ্দ ঘরটি যেমন সুন্দর, তেমনই তার আসবাবপত্র। কাচের জানলার ওপাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও অনেকখানি সবুজ সাজানো বাগিচা। ঘাসের লন, ঝুলন্ত লতাগুল্ম। আগ্রহ তৈরি হয়েছিল আগেই, বিভিন্ন ভ্রমণ ম্যাগাজিনের ছবি দেখে। স্বচক্ষে দেখে এবং এখানেই থাকব ভেবে আত্মহারা হয়ে গেলাম। এই অট্টালিকাটি ঘিরে গা ছমছম ‘ভূতুড়ে বাড়ি’ গুজবের জন্ম। বাড়তি আগ্রহ সেই থেকেও।
শহরের ঘিঞ্জি পরিবেশ ছেড়ে এবার ফাঁকা চড়াই পরিচ্ছন্ন পথ। প্রকৃতির দান অকৃপণ কালিম্পং শহর ও শহরতলিতে। রিসর্ট, হোটেল, ঘরবাড়ির উঠোনে রকমারি ফুলের আয়োজন। ফুল আর অর্কিডের জন্য কালিম্পঙের প্রশস্তি। ভিড়ভাট্টা, বাজার, বাসস্ট্যান্ড বাদ দিলে প্রকৃতির শোভা কালিম্পঙে অনেকখানি।
ওক-মেপল-বার্চ-সাইপ্রাস বৃক্ষাদির মাঝে ডেলোর যাত্রাপথে বাঁ দিকে ডাঃ গ্রাহামস হোম। ১৯০০-সালে কিছু অনাথ শিশুকে নিয়ে স্কটিশ মিশনারি ডাক্তার জন অ্যান্ডারসন গ্রাহাম পাহাড় ঢালে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। ১৯৪২-এ ডাঃ গ্রাহামসের মৃত্যুর পরেও আবাসিক স্কুলটিতে দেশবিদেশের প্রচুর ছাত্রছাত্রী পড়তে আসে। এখানকার পঠনপাঠন, শিক্ষার মান এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ নিয়মানুবর্তিতার জন্য পাহাড়ি পরিবেশে মিশনারি গুরুকুলটি খুবই খ্যাত। প্রতিবছর মে মাসে এখানকার ‘মে ফেয়ার’ উৎসবটি খুব জনপ্রিয়। পাশেই মেয়েদের হস্টেল ও স্কুল। প্রায় ৫০০ একর জমিতে গাছগাছালি ঘেরা গ্রাহামস হোমের ডেয়ারি, পোলট্রি, ফার্মিং, বেকারিও রয়েছে। গ্রাহামসের নিজের হাতে সৃজন করা গাছগুলি এখন বৃহৎ বনস্পতি।
কালিম্পঙের দু’-প্রান্তে দুই প্রহরী দূরপিনদাড়া ও ডেলো। কালিম্পং থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে ডেলো পাহাড়। দার্জিলিং-গোর্খা উন্নয়ন নিগমের ব্যবস্থাপনায় তৈরি ট্যুরিস্ট লজটি সুভাষ ঘিসিংয়ের উদ্বোধনকৃত। ভেতরে বিশ্রামাগার, রেস্তরাঁ, কিডস প্লাজা সবই আছে। ডেলো পাহাড়ে প্রবেশমূল্য দিয়ে ঢুকে কিছুটা উঁচুতে পর্যটকাবাস। চমৎকার কেয়ারি করা ফুলবাগিচা, ঘাসের লন, অর্কিড, পরিচর্যার গুণে বর্ণময়। সমস্ত চত্বরে বিভিন্ন কৌণিক অবস্থানে বেশ কয়েকটি ভিউপয়েন্টে বসার জায়গা। হাওয়ার গতিবদলে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে হাওয়া নিশানগুলো। পর্যটকদের জন্য রয়েছে প্যারাগ্লাইডিং, হর্স রাইডের বিনোদনমূলক ব্যবস্থাও। ব্রিটিশ আমলের জলাধারটি পরিত্যক্ত। পাশেই বাঁধানো জলাধারটি থেকে সমগ্র কালিম্পঙে জলসরবরাহ হয়। ডেলো পাহাড়চূড়া থেকে পাহাড়-খাঁজে গোটা কালিম্পং শহর কুয়াশায় ঝাপসা দেখায়। ৪৫০১ ফুট উচ্চতায় দূরপিনদাড়া ভিউপয়েন্ট থেকে বরফাচ্ছাদিত কাঞ্চনজঙ্ঘা মনোহররূপে স্থিরস্থিতধী। পরিচ্ছন্ন আকাশে পেশক চা-বাগিচা, পশ্চিম সিকিমের অংশবিশেষ, তাকদা, নাথুলা, টাইগারহিল নজরে পড়বে। দূরবিনদাড়া থেকে নীচে নজর করলে তিস্তা, রঙ্গিত, রেলি, রিয়াং নদীদের আসামান্য রূপ।
কালিম্পঙের মর্গান হাউস— স্থানীয়রা বলেন সিংমারি বাংলো। এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটনবিভাগের কেতাদুরস্ত আবাস। অনবদ্য ব্রিটিশ স্থাপত্যের এই মর্গান হাউসকে পর্যটকদের দরবারে হাজির করার ক্ষেত্রে মর্গান হাউসের ভূতুড়ে গল্প অনেকাংশে দায়ী। শহরে পৌঁছে বাঁহাতি ঢালুপথটিতে মঙ্গলধাম মন্দির। বাগান ঘেরা সুন্দর শান্ত আশ্রম-মন্দির। তিনতলার গর্ভগৃহে সোনার মুকুট ও গাঢ় নীল পোশাকসজ্জিত রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ। দেওয়ালগাত্রে কৃষ্ণের জন্মলীলা থেকে কুরুক্ষেত্রে অর্জুনকে গীতামাহাত্ম্য দান পর্যন্ত প্রতিটি গল্পের মৃন্ময়ীমূর্তি। দোতলায় গুরু মঙ্গলদাসজির সমাধিভবন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী মৃতদেহ দাহ না করে দণ্ডায়মান অবস্থায় এখানে সমাহিত করা হয়। পাশের গ্রন্থাগারটিতে তাঁর জীবনালেখ্য সম্বন্ধীয় পুস্তক, সিডি। গেরুয়াবসনধারী ভক্তশিষ্য মন্দির চত্বরে। বেলা বারোটা বাজতেই আমাদের সামনেই বিগ্রহের সামনে কালো পর্দা টেনে দিলেন আশ্রমের ভক্তবৃন্দ, বিগ্রহের মধ্যাহ্নভোজনের সময় তখন।
দ্রষ্টব্য স্থানগুলির মধ্যে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত চিত্রভানু বা গৌরীপুর হাউস। বাড়িটি এখন কোঅপারেটিভ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। রবীন্দ্রনাথ এখানে অবকাশ-যাপনে কয়েকবার এসেছিলেন। ১৯৪০ সালের এপ্রিলে তাঁর ‘জন্মদিন’ কবিতাটি এখান থেকেই সরাসরি টেলিফোনযোগে আবৃত্তি করেন এবং আকাশবাণী মারফত সম্প্রচারিত হয়। শহরের প্রধান সড়কপথ ঋষি রোড। ভিড়ে ঠাসা দোকানপাটে প্রয়োজনীয় ও শখের পণ্যসামগ্রী বিকোয়। ঋষি রোডে নেপালি বৌদ্ধমঠ সোংমা গুম্ফা ১৯৫২ থেকে কালিম্পঙের ধর্মোদয় সভার পরিচালনায় চলছে। অন্দরের বুদ্ধমূর্তিটি বর্মার বৌদ্ধদের উপহার। দূরেই লেপচা মিউজিয়াম। এখানে লেপচা জনজাতির জীবনশৈলী-ধর্ম-সংস্কৃতি সম্পর্কে তথ্যাবলির উজ্জ্বল সংগ্রহ রয়েছে। গ্রাহামস হোমসের কাছেই থার্পা চোলিং মনাস্ট্রি। শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে দূরপিনদাড়া পাহাড়চূড়ায় জং-দোক-পালরি মনাস্ট্রি। ১৯৫৬ সালে, দলাই লামাকৃত গবেষণাধর্মী প্রাচীন পুঁথি রয়েছে। রঙিন কারুকাজে অলংকৃত তিনতলা গুম্ফাটিতে লামাদের বিদ্যালয়, ধর্মোদয় বিহার রয়েছে। মনাস্ট্রির বাইরে দেওয়ালে অসংখ্য কাঠের ধর্মচক্র। গুম্ফার অভ্যন্তরে গুরু পদ্মসম্ভবের শান্তসমাহিত মূর্তি। কালিম্পং মহাবিদ্যালয়ের কাছে বনদপ্তর পরিচালিত প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র। নানাধরনের পাহাড়ি গাছপালা, বন্যপ্রাণীর ছবি ও নমুনার দুর্লভ সংগ্রহ। দার্জিলিং-গোর্খা পরিষদ স্থাপিত কালিম্পং সায়েন্স সেন্টার। সেখানে বিজ্ঞানের অবগতি সম্পর্কিত বিষয়গুলি, ছাত্রছাত্রী এমনকী পর্যটকদের কাছেও যথেষ্ট মনোগ্রাহী। মানেক শা রোড ধরে এগলে ২৭ মাউন্টেন ডিভিশনের সেনাবাহিনীর ছাউনি পড়বে বাঁয়ে। ব্রিটিশরাজ থেকেই অঞ্চলটি পুরোটাই ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। ঝকঝকে রাস্তাঘাট, পরিচ্ছন্ন এলাকা। ছবির মতো বাংলো ব্রিগেডিয়ার ও ওপরমহলের সেনাপ্রধানদের জন্য। পাহাড়ঢালে সেনাবাহিনীর সবুজাভ গল্ফ কোর্স।
অর্কিড-শহর কালিম্পং। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রজাতির অর্কিডের সংগ্রহ এখানকার নার্সারি-ফার্মগুলিতে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাইনউড নার্সারির অফুরন্ত সংগ্রহ। কতরকমের নাম-আকার-রঙের অপূর্ব সৌন্দর্য। দেশবিদেশে রপ্তানিতে যথেষ্ট অর্থাগম হয়। নার্সারিটির বোগেনভিলা কটেজে থাকার ব্যবস্থাও আছে।
ঝান্ডিদাড়া গুম্ফা ভারত-চীন সীমান্ত কাছে হওয়ায় নিরাপত্তা বেশ জোরদার। আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানরা ড্রাইভারের লাইসেন্স দেখে অনুমতি দিলেন। অসাধারণ কারুকার্যমণ্ডিত গুম্ফাটি। কাছেই ১৯৫৬ সালে নির্মিত কালীমন্দির। কালিম্পঙের পরিমণ্ডলে আবছা কুয়াশাও কাঞ্চনজঙ্ঘার চমক। কুয়াশা থমকে ওক গাছের ডালে-পাতায়। তাতে সামান্য হিম। রাত বাড়ে, কিন্তু মর্গান হাউসের ভূতুড়ে গুজব একটুও ভয়ের স্পর্শ করায় না।