গৃহসুখ বৃদ্ধি ও সপরিবারে আনন্দ উপভোগ। অন্যের দোষের দায়বহন করতে হতে পারে। ... বিশদ
সিবিআই অভয়া খুনের তদন্ত শুরুর কয়েকদিন পর পেয়েছিল আর জি কর দুর্নীতি মামলার দায়িত্ব। পরে পাওয়া দুর্নীতি মামলায় আর জি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে গ্রেপ্তার করে ফেলল। কিন্তু খুনের বিষয়ে স্পিকটি নট। অভয়াকে কে খুন করেছে, খুনির সংখ্যা এক না একাধিক! এই খুন তাৎক্ষণিক ঘটনার পরিণতি, নাকি পরিকল্পিত, এসব জানার ব্যাপারেই মানুষের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তা নিয়ে সিবিআই কোনও কথা বলছে না।
সেই সুযোগে বিভিন্ন ‘সূত্র’ থেকে নানা খবর সামনে আসছে। খুন কোথায় হয়েছে, তা নিয়ে ধন্দ। কেউ বলছে, অন্য কোথাও খুন করে দেহ সেমিনার হলে আনা হয়েছিল। তাই সেমিনার হল ছিল পরিপাটি, সাজানো গোছানো। পাল্টা যুক্তি, চারিদিকে সিসি ক্যামেরা। খুন করে দেহ সেমিনার হলে নিয়ে যাবে কেন? ধর্ষণ খুনের আগে নাকি পরে, তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। খবরগুলি পরস্পর বিরোধী। এই সব সূত্রের খবরের উপর ভিত্তি করেই বিশেষজ্ঞদের কেউ ঝাল মেটাচ্ছেন, কেউ আবার ক্ষতে প্রলেপ দিতে ব্যস্ত। তাতে বাড়ছে জাস্টিস পাওয়া নিয়ে সংশয়।
গোটা রাজ্যের নজর ছিল ৫ সেপ্টেম্বরের দিকে। ওই দিনই সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই তদন্ত রিপোর্টের উপর শুনানি ছিল। তাতে খুনের তদন্ত কতটা এগিয়েছে, সেটা জানা যেত। বোঝা যেত সিবিআই কোনও গুরুত্বপূর্ণ ‘মিসিং লিঙ্ক’ উদ্ধার করতে পেরেছে কি না! কলকাতা পুলিসের বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপাটের যে অভিযোগ নিয়ে প্রবল চর্চা হচ্ছে, সেটা সত্যি কি না, তাও জানা যেত। রিপোর্টের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট কড়া পদক্ষেপ করতে পারত। কিন্তু শুনানি পিছিয়ে যাওয়ায় আপাতত অপেক্ষা সোমবার পর্যন্ত।
জাস্টিস বিলম্বিত হওয়ায় আন্দোলনকারীরাও অস্থির হচ্ছেন। খুনের তদন্ত নিয়ে সিবিআই একটু ঝেড়ে কাশলেই সমস্যার অবসান ঘটত। কিন্তু সেটা তারা কিছুতেই করছে না। অথচ পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দুর্নীতি নিয়ে তদন্তের সময় সিবিআই মাঝেমধ্যেই কিছু বিষয় প্রকাশ্যে এনেছিল। সিবিআইয়ের সৌজন্যেই টাকার পাহাড় দেখেছিল বাংলা। কিন্তু অভয়ার খুন নিয়ে সিবিআই চুপচাপ। তাতেই জাগছে প্রশ্ন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা কি কৌশলগত কারণে চুপ রয়েছে, নাকি নতুন কিছুই পায়নি!
অন্দোলন শুধু মনের বন্ধ দরজাই উন্মুক্ত করে না, জন্ম দেয় নতুন সম্ভাবনার। আন্দোলনের পথ বেয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী। তাই একটিবারও জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের বিরোধিতা করেননি। উল্টে তাঁদের আন্দোলনকে ন্যায্য বলে মেনে নিয়েছেন। তাঁর আপত্তি অভয়ার নৃশংস মৃত্যুকে নিয়ে সিপিএম এবং বিজেপির রাজনীতিতে। ২৮ আগস্টের সভায় সেটাই তিনি জানিয়েছিলেন। তিনি কী বলেছিলেন? যারা কামড়াচ্ছে তাদের কামড়াতে হবে না, শুধু ফোঁস করলেই হবে।
অভয়া ইস্যুতে হিংসার রাজনীতির মোকাবিলা রাজনৈতিকভাবে করতে বলেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। আর কিছু অর্বাচীন, ভুঁইফোড় তৃণমূল নেতা ‘ফোঁস’ করার জায়গায় খোঁচাতে শুরু করে দিলেন। তাও সেটা কাদের? সেলিব্রিটি ও আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের। ওই সব নেতার খোঁচা দেওয়ার ক্ষমতাটুকুই আছে, কামড়ানোর মুরোদ নেই। কারণ রাজনীতিতে দাঁত ওঠার বয়স এখনও তাঁদের হয়নি। কেউ কেউ ধমক খেয়ে ভুল স্বীকার করছেন। কিন্তু কথায় আছে, হাতের ঢিল আর মুখে কথা একবার বেরিয়ে গেলে তা আর ফিরিয়ে আনা যায় না।
আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা বিভিন্ন পরিবার থেকে এসেছেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু অভয়ার জাস্টিসের দাবিতে তাঁরা ব্যক্তিগত রাজনৈতিক আদর্শকে পাশে সরিয়ে এককাট্টা হয়েছেন। তাই জুনিয়র ডাক্তাররা অত্যন্ত সচেতনভাবে রাজনৈতিক ছোঁয়া এড়িয়ে চলেছেন। তাঁরাও খুব ভালো করেই জানেন, কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষে গেলেই ঐক্য ভেঙে যাবে। আর সাধারণ মানুষের যে সমর্থন তাঁরা কুড়িয়েছেন সেটাও হারিয়ে ফেলবেন।
এখনও পর্যন্ত সিংহভাগ চিকিৎসক রাজনীতির কারবারিদের ফাঁদে পা দেননি। লালবাজার অভিযানে সেটা আরও একবার স্পষ্ট হয়েছে। পুলিস কমিশনারের পদত্যাগের দাবিতে তাঁদের মিছিল গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই আটকে দিয়েছিল। তাঁরা বিজেপি বা সিপিএমের রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলে ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করতে পারতেন। ভাঙচুর চালাতে পারতেন। কিন্তু করেননি। তাঁরা বসে পড়েছেন। রাত জেগেছেন। বৃষ্টিতে ভিজেছেন। রোদে পুড়েছেন। কিন্তু ময়দান ছাড়েননি। শেষপর্যন্ত তাঁদের শর্ত মেনেই চিকিৎসক প্রতিনিধি দলকে লালবাজারে যেতে দিতে বাধ্য হয়েছে।
লালবাজার অভিযানের মাঝেই তাঁদের কাছে এসেছিল সুখবর, সন্দীপ ঘোষকে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই। আন্দোলনকারীরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিলেন। সেই সুযোগে আন্দোলনস্থলে হাজির হয়েছিলেন ‘দাবি এক, দফা এক মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’ স্লোগানের বাংলায় ফ্রানচাইসি নেওয়া বিজেপির সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রাক্তন বিচারপতি। তাই হয়তো ভেবেছিলেন, আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা তাঁকে ‘স্যার’ সম্বোধনে অভ্যর্থনা জানাবেন। কিন্তু ঘটল তার উল্টো। তাঁকে দেখামাত্রই ফুঁসে উঠলেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা। উঠল স্লোগান, ‘অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় গোব্যাক।’ থতমত খেয়ে গেলেন। তাঁকে দেখামাত্র চিকিৎসকদের ‘রিঅ্যাকশন’ এমন হবে, তা কল্পনাও করেননি। ধাতস্থ হওয়ার আগেই ফের মাইকে ঘোষণা, ‘একজন রাজনৈতিক নেতাকে এখানে দেখা যাচ্ছে। তিনি বেরিয়ে যান।’ এরপর আর থাকা যায়?
অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কি নিজের ইচ্ছায় আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের কাছে গিয়েছিলেন? মোটেই না। এটা ছিল বিজেপির আন্দোলন হাইজ্যাকের একটা টোপ। অভিজিৎবাবু বিজেপি সাংসদ হলেও প্রাক্তন বিচারপতি। ধারে এবং ভারে দলের অন্য নেতাদের থেকে তিনি অনেকটাই এগিয়ে। তাই অভিজিৎবাবুকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল ‘টোপ’ হিসেবে। তা গিললেই কিস্তিমাত। কিন্তু আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা টোপ গেলেননি। উল্টে গভীর জলের মাছের মতোই লেজের ঝাপটায় বড়শি থেকে টোপটা খসিয়ে দিলেন। তাঁরা বুঝিয়ে দিলেন, রাজনীতির ছিপে তাঁদের গাঁথা যাবে না। মেরুদণ্ডটা এভাবেই সোজা রাখতে হবে তাঁদেরও।
সুপ্রিম কোর্টে শুনানি পিছিয়ে যাওয়ায় জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি আরও প্রলম্বিত হল। বাড়বে অসুস্থ গরিব মানুষের দুর্ভোগ। পিছিয়ে যাবে হাজার হাজার জটিল অপারেশন। চিকিৎসার অভাবে হয়তো কেউ হবেন সন্তানহারা, কেউ হবে অনাথ। আন্দোলনের জেরে থমকে যাচ্ছে স্বাভাবিক জনজীবন। আধ ঘণ্টার পথ যেতে লাগছে দু’ঘণ্টা। জেলার মানুষ কলকাতায় যেতে ভয় পাচ্ছেন। মার খাচ্ছে ব্যবসা। গানের মধ্যে দিয়ে অরিজিৎ সিং জানতে চেয়েছেন, আর কবে সিক্ত হবে হৃদয়! এই প্রশ্ন সমাজের সকলের কাছে। এবার অসুস্থ গরিবদের জন্য সিক্ত হোক আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের হৃদয়ও।
একথা ঠিক, জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদ বাংলায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। তাঁদের আন্দোলন অর্জন করেছে বিপুল জনসমর্থন। তাই দই সাঁটানোর আশায় ‘নেপো’র দল ঘুর ঘুর করছে। এখন কালো পোশাক পরে হাতে মোমবাতি নিলেই হওয়া যাচ্ছে আন্দোলনকারী, প্রতিবাদী। আন্দোলনকারীর ভেক ধরে কেউ দিচ্ছে সরকার বিরোধী স্লোগান, কেউ পোড়াচ্ছে শাসক দলের পতাকা। প্রতিবাদে শামিল হওয়া জনপ্রিয় নায়িকাকেও দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এসবই কিন্তু নেপোয় দই মারার লক্ষণ।
প্রতিবাদ চলছে। এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ। অভয়ার জন্য জাস্টিস চাইছেন সবাই। কিন্তু আন্দোলনকারীদের একাংশের সেলফি তোলার হিড়িক, সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই সব ছবির উজ্জ্বল উপস্থিতি, নাচনকোঁদন কেমন যেন বেড়েই চলেছে। তা দেখে হচ্ছে ভয়, রাজনীতির কারবারিদের হাতে পড়ে প্রতিবাদ শেষে ‘শোকের উৎসব’ যেন না হয়ে যায়!