বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যার বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
রবীন্দ্রনাথ ‘ধর্মমোহ’ কবিতায় বলেছেন, ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।’ স্বামী বিবেকানন্দের কথায়, ‘যখন দেখবে কেউ বলছে, কেবলমাত্র আমিই ঠিক, আমার সম্প্রদায়ই যথার্থ পথ ধরেছে এবং অন্য সকলে ভুল করছে তখন জানবে, তারই সব ভুল।’ আর রামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘যত মত তত পথ।’ বাংলা তো এই সংস্কৃতিতেই বিশ্বাসী। সে সব ভুলিয়ে দিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’কে ত্রাতা হিসাবে প্রমাণে ঝাঁপিয়েছেন বিজেপি নেতারা। বাংলার বুকে তাঁরা ‘জয় শ্রীরাম’ সংস্কৃতির জন্ম দিতে চাইছেন।
ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতি, আধ্যাত্মবাদ আমাদের শিখিয়েছে, সহিষ্ণুতা মহৎ গুণ। ক্ষমা পরম ধর্ম। বাঙালির সংস্কৃতি শান্ত ও স্নিগ্ধ। তাই সেখানে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরির যত চেষ্টাই হোক না কেন, তা স্থায়ী হতে পারে না। যে কোনও ধর্মীয় উন্মাদনা ঝড়ের মতো। প্রচণ্ড বেগে তা প্রবাহিত হয়। তার বিধ্বংসী ক্ষমতাও প্রচণ্ড। তাই তাকে সবাই ভয় পায়। সে অনেক কিছু নষ্ট করে দিতে পারলেও তার স্থায়িত্ব কম। তবে ধর্মীয় উন্মাদনা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে বুঝতে হবে, প্রলয় আসন্ন।
শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল জন্মসূত্রে কেউ হিন্দু, কেউবা মুসলিম। কিন্তু তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়ের গণ্ডিতে বেঁধে রাখা যায়নি। তাঁদের কর্মে, তাঁদের উদারতায় তাঁরা হয়ে উঠেছেন আপামর বাঙালির হৃদয়ের মানুষ। শুধু বাংলা বা ভারতবর্ষ নয়, গোটা বিশ্ব তাঁদের আদর্শ ও কর্মের সামনে মাথা নত করেছে। শিকাগোর ঐতিহাসিক ভাষণে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘আমরা শুধু সকল ধর্মকে সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি। যে জাতি পৃথিবীর সকল ধর্মের ও সকল জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী জনগণকে চিরকাল আশ্রয় দিয়ে আসছে, আমি সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে নিজেকে গর্বিত মনে করি।’ বিবেকানন্দের এই ভাবনার জন্যই গোটা বিশ্ব তাঁর প্রিয় ভারতবর্ষকে নতুন করে চিনেছিল।
স্বামী বিবেকানন্দের বাংলায় বিভাজনের রাজনীতি কায়েমের চেষ্টা চলছে। ‘পরিবর্তন যাত্রা’র নামে বের করা হচ্ছে রথ। ইতিহাস বলছে, রথযাত্রার মধ্যে দিয়েই হয়েছে বিজেপির উত্থান। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গুজরাতের সোমনাথ মন্দির থেকে লালকৃষ্ণ আদবানি ‘রাম রথ’ বের করায় বিজেপি বিপুল সাফল্য ঘরে তুলেছিল। রাম জন্মভূমি সম্পর্কে দেশবাসীকে জানানোর জন্য ‘রাম রথযাত্রা’ বলা হলেও আসল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় মেরুকরণ স্পষ্ট করা। ২৩ অক্টোবর বিহারের সমস্তিপুরে লালুপ্রসাদ যাদব সেই রথ আটকানোয় উত্তাল হয়েছিল গোটা দেশ। বিজেপির ভারতবর্ষের মসনদ দখলের ভিত সেদিনই গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। তারপর সঙ্কটমুক্তি বা লক্ষ্য পূরণের জন্য বিজেপি বারেবারে ‘রথযাত্রা’কে হাতিয়ার করেছে।
বঙ্গ দখলের লক্ষ্যে বাংলার বুকে আমদানি করা হয়েছে ‘রথযাত্রা’ সংস্কৃতি। বিজেপি দেশ চালালেও এই মুহূর্তে বাংলার মানুষের কাছে তাদের সরকারের হয়ে সওয়াল করার মতো হাতে কিছুই নেই। ডাল, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। রান্নার গ্যাস, পেট্রল, ডিজেলের দামও লাগামছাড়া। পেট্রল, ডিজেল পৌঁছে গিয়েছে সেঞ্চুরির দোরগোড়ায়। সাধারণ মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। সরকারি চাকরির দরজাও প্রায় বন্ধ। অথচ বছরে ২কোটি করে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি।
এই অবস্থায় বঙ্গ দখলের জন্য বিজেপির সামনে একটা রাস্তাই খোলা, ধর্মীয় মেরুকরণ। সেই লক্ষ্যে ধর্মকে মন্দির থেকে রাস্তায় নামিয়ে আনতে উঠেপড়ে লেগেছেন নেতারা। বিজেপি নেতৃত্ব হয়তো ভাবছে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। বিহারের সমস্তিপুরের মতো ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের বুকে ঘটার আশায় রয়েছেন তাঁরা। রথযাত্রা নিয়ে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেই প্রশস্ত হবে বিভাজনের পথ। তাহলেই বিজেপির ফায়দা। কিন্তু তার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কারণ বিবেকানন্দ সকল ধর্মের ও সকল জাতির নিপীড়ত ও আশ্রয়প্রার্থীকে চিরকাল আশ্রয় দিতে শিখেছেন। তাঁর বাংলা সেই শিক্ষায় শিক্ষিত।
এরাজ্যের মানুষ আষাঢ় মাসে রথযাত্রা দেখতে অভ্যস্ত। বিজেপির সৌজন্যে মাঘ মাসে শুরু হয়েছে রথযাত্রা। তবে বিজেপি নাম দিয়েছে ‘পরিবর্তন যাত্রা’। নাম যাই হোক না কেন, রথযাত্রার উদ্দেশ্য একটাই, ভোটের মেরুকরণ ঘটানো। অনেকে বলছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে টানার এটাই বিজেপির শেষ ‘ট্রাম্প কার্ড’। তবে, কোনও অশান্তি না হলে বিজেপির পক্ষে ম্যাচ বের করা কঠিন।
আষাঢ় মাসে রথযাত্রার সময় জগন্নাথদেবের রথের রশি টানার জন্য ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন, রথের রশি টানলে পুণ্য হয়। কিন্তু, বিজেপির রথ ঘিরে কোনও উন্মাদনা নেই। এমনকী, বিজেপি সমর্থকরাও এই ‘পরিবর্তন যাত্রার’ রথ নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। রথযাত্রার সূচনা পর্বে তারাপীঠের এবং লালগড়ের ফাঁকা মাঠ তার বড় প্রমাণ। তারাপীঠে ভিড় না হওয়ার জন্য অনেকে অনুব্রত মণ্ডলের হুমকির দিকে আঙুল তুলতে পারেন। কিন্তু লালগড়ে ভিড় হল না কেন?
লালগড়েও স্বয়ং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা উপস্থিত ছিলেন। তা সত্ত্বেও মাঠের সিকিভাগ ভরাতেই গেরুয়া শিবিরের নেতাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। লোকের অভাবে বাতিল করতে হয়েছে ঝাড়গ্রামের সভা। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের জেলায় এমনটা হওয়ায় গেরুয়া শিবিরের কর্মীদের মনোবলে চিড় নয়, ফাটল ধরেছে। কারণ ঝাড়গ্রাম লোকসভা আসনটি বিজেপির দখলে। পঞ্চায়েত ভোটেও এই জেলায় তারা ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল। সেই জেলায় লোকের অভাবে নাড্ডাজির সভা বাতিল! ভাবতেও পারছেন না বিজেপি সমর্থকরা। ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করার জন্য বিজেপিকে সাংবাদিক সম্মেলন করতে হয়েছে। কিন্তু, এসব করেও নাড্ডাজির সভা বাতিলের ‘বদনাম’ ঘোচানো যাচ্ছে না।
বিজেপির সভাগুলিতে লোকজন কমে যাওয়ার জন্য অনেকে বাম সমর্থকদের দিকে আঙুল তুলছেন। তাঁরা বলছেন, এতদিন বিজেপির সভাগুলিতে বাম কর্মী-সমর্থকরাই বেশি ভিড় জমাতেন। কিন্তু, নয়া কৃষি আইনের প্রতিবাদে বামেরা সক্রিয় হতেই কর্মী-সমর্থকরা পুরনো দলে ফিরতে শুরু করেছেন। তাঁরা নিজের দলের কর্মসূচি সফল করার দিকে মন দিয়েছেন। তাই বিজেপির সভাগুলিতে আগের মতো উচ্ছ্বাস ও ভিড় দেখা যাচ্ছে না। দিলীপ ঘোষের মতো নেতাকেও ‘চায়ে পে চর্চায়’ লোক আনার জন্য এলইডি বাল্ব বিলি করতে হচ্ছে। ভোট ঘোষণা হলে হয়তো আরও অনেক কিছুই বিলি করতে দেখা যাবে! এসব দেখেই কি নরেন্দ্র মোদি ‘ম্যাচ ফিক্সিং’ এর অভিযোগ এনেছেন?
এর ঠিক উল্টো ছবি দেখা যাচ্ছে শাসক দলের সভাগুলিতে। তৃণমূলের জেলা ও রাজ্যস্তরের নেতাদের সভাতেও ভিড় হচ্ছে যথেষ্ট। আর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাগুলি ভিড়ের নিত্যনতুন রেকর্ড গড়ছে। কিন্তু, এত ভিড়ের কারণটা কী? স্বাস্থ্যসাথী? দুয়ারে সরকার? নাকি রাজ্যের মানুষ সঙ্কটকালে বিবেকানন্দের বাণীকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছেন? বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘যে ধর্ম বা যে ঈশ্বর বিধবার অশ্রু মোচন করতে পারে না অথবা অনাথ শিশুর মুখে এক মুঠো খাবার দিতে পারে না, আমি সে ধর্মে বা সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না।’ মানুষ কি তাহলে এই মন্ত্রবলেই ‘জয় শ্রীরামে’র উন্মাদনা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন? নাকি তাঁরাও স্বামীজির ভাবনার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে বুঝেছেন, ধর্মের চেয়েও জরুরি পেটের ভাত।