বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যার বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
তিনি বলেন, ‘সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদেরই সিভিল সার্ভিসে যাওয়া উচিত। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের নয়।’ কেন? ‘সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের যেহেতু গঠন সংক্রান্ত জ্ঞান থাকে, এবং সমাজকে গঠন করাই সিভিল সার্ভিস, তাই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদেরই উচিত সিভিল সার্ভিসে যাওয়া।’
ত্রিপুরার বিধানসভা ভোটের জন্য যে ‘ভিশন ডকুমেন্ট’ প্রকাশ করেছিলেন অরুণ জেটলি, সেখানে পরিবারপিছু একজনের চাকরির প্রতিশ্রুতি ছিল। চাকরির আকাল মেটাতে না পারাটা তাদের হারের অন্যতম বড় কারণ বলে মেনে নিয়েছিল সিপিএমও। কিন্তু ক্ষমতায় এসে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী এখন বলেন, ‘চাকরির জন্য নেতা বা সরকারের পিছনে না ঘুরে গোরু পোষা ভালো। দুধ ৫০ টাকা লিটার। যে পড়াশোনা করে ১০ বছর ধরে চাকরির জন্য ঘুরছে, একটা গোরু কিনে পালন করলে এত দিনে ১০ লক্ষ টাকা তার রোজগার হয়ে যেত!’
হ্যাঁ, এই বিপ্লব কুমার দেবই ছিলেন ত্রিপুরায় বিজেপির মুখ!
তাঁকে ঘিরেই ত্রিপুরায় হঠাৎ উত্থান হয়েছিল বিজেপির। প্রথম কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল, তারপর তৃণমূল ভেঙে রাতারাতি বিজেপি হয়ে গিয়েছিল সবাই। তাতেই ২৫ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটে। পরিবর্তন হয় ত্রিপুরায়। কিন্তু তারপর দু’বছর কাটতে না কাটতেই ত্রিপুরায় বিপাকে বিজেপি সরকার। জোটসঙ্গী আইপিএফটি তো বেজায় চটেছে বিজেপির উপর। দুই দলের মধ্যে শুরু হয়েছে তীব্র অসন্তোষ। ত্রিপুরার রাজনীতিতে ফের বদলের হাওয়া প্রবেশ করেছে এরই মধ্যে। শরিকি কোন্দল, দলীয় অন্তর্কলহ তো আছেই, তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে বিজেপির সর্বনাশ ডেকে এনেছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। তার সঙ্গে রয়েছে ত্রিপুরাল্যান্ড, আদিবাসীদের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়-সহ অনেক ইস্যু। যা নিয়ে নাজেহাল মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব। এসবেরই জেরে বিপ্লবের জনপ্রিয়তা তলানিতে পৌঁছে গিয়েছে। আর ত্রিপুরায় কামব্যাকের সুযোগ পেয়ে কংগ্রেস তুখোড় ব্যাটিং শুরু করেছে। বিজেপিতেও ভাঙন ধরেছে। দলে দলে কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন নেতা-কর্মীরা। ভাঙছে আইপিএফটিও।
শূন্য আসন থেকে রাতারাতি শাসক বনে যাওয়া বিজেপির উত্থান নিয়ে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বামদের শাসন পাল্টাতে ‘চলো পাল্টাই’ স্লোগানই শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করেছিল। ত্রিপুরায় গত বিধানসভা ভোটের আগে কখনও কোনও আসন পায়নি বিজেপি। শুরু থেকেই এই রাজ্যে জয় পেতে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে দলটি। জোট ভাঙা–গড়ার খেলায় বিজেপি নেতারা কৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারে দেদার অর্থও বিলিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ দলের কেন্দ্রীয় বাঘা বাঘা নেতা সেখানে প্রচারে নামেন। প্রচারে এসে ভোটারদের উদ্দেশে মোদি বলেছিলেন, ‘মানিক ফেলে এবার হীরে তুলে নিন!’ হীরে মানে, দিল্লি থেকে রাজ্যে আসা, রাজনীতিতে নবীন বিপ্লব কুমার দেব। হীরে মানে হাইওয়ে, ইন্টারনেট, রোডওয়েজ, এয়ারওয়েজ। লক্ষ লক্ষ বেকারের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদি।
বিজেপির আইটি সেল আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দিয়েছিল স্লোগান—‘চলো পাল্টাই’। শুধু নতুন কিছু পাওয়ার লোভ আর কোটি কোটি টাকা নয়, নির্বাচনী মেশিনারির অবাঞ্ছিত উপযোগই শুধু নয়, বিজেপিকে সত্যিই বিশ্বাস করেছিল ত্রিপুরা। পঁচিশ বছরের বাম ধারার একঘেয়েমিতে ক্লান্ত, অনেকাংশে বিরক্ত ত্রিপুরা একটি বার অন্তত স্বাদ বদল করে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু, মাত্র তিন বছরেই এমন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা হতে পারে, কেউ ভাবতে পারেননি। বিজেপির ভিশন ডকুমেন্টে প্রতিশ্রুতি ছিল, কর্মচারীদের সপ্তম বেতন কমিশন, ঘরে ঘরে রোজগার, প্রথম বছরেই ৫০ হাজার শূন্য পদে চাকরি, সব সামাজিক ভাতা বাড়িয়ে মাসে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা, রেগার মজুরি সমেত সব মজুরি কমপক্ষে ৩৪০ টাকা, সবার জন্য পাকা ঘর, সব যুবককে স্মার্ট ফোন, মেয়েদের নিখরচায় পড়ার ব্যবস্থা, বিপিএল–দের নিখরচায় স্বাস্থ্য পরিষেবা, অ্যাড–হক ১০,৩২৩ শিক্ষকের চাকরি সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা হবে, সমগ্র শিক্ষা সমেত বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের চুক্তিবদ্ধ কর্মীদের নিয়মিত করা, ইত্যাদি।
আর আজ? রাজ্য জুড়ে আশাভঙ্গের বেদনা আর আফশোস প্রকট। স্বাদ বদলাতে গিয়ে মুখ পুড়েছে। সংসারের অভাব অনটনের কারণে দিশাহারা হয়ে দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার চাকরিচ্যুত শিক্ষক উত্তম ত্রিপুরাদের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে। ত্রিপুরায় বাম আমলে এই শিক্ষকদের নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু আইনি জটিলতায় চাকরি হারান তাঁরা। তবে স্কুল পরিচালনার জন্য সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের অ্যাড হক ভিত্তিতে নিয়োগ করার অনুমতি দেয়। ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি এই শিক্ষকদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তারপরে তারাও কোনও পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ চাকরি খোয়ানো শিক্ষকদের। এই ১০,৩২৩ জন শিক্ষকের একজন ছিলেন উত্তম ত্রিপুরা (৩২)। আর তাঁকে নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যাটা দাঁড়ালো ৭৮। অথচ, তাঁরাই ছিলেন ভোটের আগে বামদের শাসন পাল্টানোর প্রচারের হাতিয়ার। কিন্তু ক্ষমতায় এসে ভোল পাল্টে যায় বিজেপির। ক্ষমতায় এসে ওই শিক্ষকদেরই ‘পাপের বোঝা’ অথবা ‘ভুলের বোঝা’ হিসেবে আখ্যা দেন শিক্ষামন্ত্রী রতনলাল নাথ।
মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের কথাই ধরুন। ত্রিপুরাকে নাকি তিনি মডেল স্টেট বানাতে চান। কীভাবে? তাঁর যুক্তি, কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের সরকার থাকায় রাজ্যের উন্নয়নে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও ত্রিপুরার বর্তমান সরকারকে ‘ডাবল ইঞ্জিনের সরকার’ বলে অবহিত করেন। কেমন সেই সরকার?
শুনলে অবাক হবেন, বাংলার প্রতিটি মানুষের হাতে যখন ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ড তুলে দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তোড়জোড় করছেন, তখন পাশের রাজ্য ত্রিপুরায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার দিন শেষ। বিজেপি সরকারের ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ নীতিতে ছাড় পাননি দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষও। ছাড় শুধু অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনাভুক্তদের। স্বাস্থ্য দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করা হয়েছে, দারিদ্রসীমার উপরে থাকা (এপিএল) অথচ ‘প্রায়োরিটি হাউসহোল্ড’ (পিএইচএইচ) গোষ্ঠীভুক্ত পরিবারভুক্ত মানুষকেও (বার্ষিক আয়ের পরিমাণ গ্রামে ১ লক্ষ ২০ হাজার ও শহরে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা) নগদ টাকা দিয়েই সরকারি হাসপাতালে পরিষেবা কিনতে হবে। তালিকায় বিপিএল-ভুক্তদের কোনও শ্রেণিবিন্যাস করা হয়নি। ফলে তারাও পিএইচএইচ তালিকায় ঢুকে যাচ্ছে। কেন এই সিদ্ধান্ত, সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য দপ্তরের দায়িত্বে থাকা মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব নীরব। তবে ত্রিপুরার মানুষই বলছেন, সরকার রাজস্ব আয় বাড়ানোর উৎস খুঁজছে। এবং তা করতে গিয়েই স্বাস্থ্য পরিষেবাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, দিনের পর দিন বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বেতন না পেয়ে রাজ্য সরকারি কর্মীরা এমনিতেই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁদের সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি পালের হাওয়া কেড়েছিল সিপিএমের। আর আজ? রাজ্যের অর্থমন্ত্রী জিষ্ণু দেববর্মা বলছেন, রাজ্যের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তাই সরকারি কর্মচারীদের ডিএ দেওয়া যাচ্ছে না। টাকার সংস্থান হলেই রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের ডিএ প্রদান করা হবে।
বিজেপি জমানায় ত্রিপুরায় তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট এতটাই যে, গত বেশ ক’মাস ধরে বিভিন্ন সামাজিক ভাতা প্রদান থেকে শুরু করে, হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ, কৃষকদের বিনামূল্যে সার, কীটনাশক, বীজ সরবরাহ, বিনামূল্যে কৃষি, সেচ ও কৃষকদের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ, গ্রাম ও শহরে ইন্দিরা আবাস যোজনায় গৃহ নির্মাণে সাহায্য, প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনায় রাস্তা নির্মাণ, আইসিডিএস পরিষেবার কাজকর্ম এক রকম বন্ধ হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে পড়েছে স্কিল ডেভেলপমেন্ট স্কিমে বেকারদের কর্মমুখী করে তুলতে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দানের কাজ থেকে শুরু করে গ্রামীণ জীবিকা মিশনের কাজকর্ম। নতুন করে কোনও উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া দূরের কথা পুরানো ও চালু বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলিই চালু রাখা যাচ্ছে না। নিখরচায় জুমিয়াদের দ্বিগুণ রেশন বন্ধ করে দেওয়ায় খাদ্যের সঙ্কট জনজাতি এলাকায়। সম্পদ কর বাড়ানো হয়েছে, রাস্তায় মেরামতির সেস বসেছে, বাজারেও বসেছে ট্যাক্স। কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে ‘ডাবল ইঞ্জিনের সরকার’।
উল্টোদিকে তাকান। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৬৪টি এমন প্রকল্প এনেছেন এবং বাস্তবায়িত করেছেন, যার সমকক্ষ ভূ-ভারতে নেই। কন্যাশ্রী। রাষ্ট্রপুঞ্জে পুরস্কৃত। কমেছে স্কুলছুটের সংখ্যা। কমেছে কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। গেরুয়া শিবিরের নেতারা বলতে পারেন, কেন্দ্রের আছে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’। গোটা দেশের জন্য যা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র, শুধু বাংলাই কন্যাশ্রীতে খরচ করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। রূপশ্রী, ঐক্যশ্রী, সবুজ সাথী, জয় জোহার, এমন আরও অনেক প্রকল্প আমাদের রাজ্যে। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা, দেশের আর কোনও রাজ্যে নেই। স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে ১৫০০ বেসরকারি হাসপাতালেও, খরচ রাজ্য সরকারের। এত প্রকল্পের রূপায়ণ করেও মমতা থেমে থাকেননি। বাস্তবায়নে খামতি থাকতেও পারে, সব মানুষের কাছে সুবিধা পৌঁছতে না–ও পারে, তাই ‘দুয়ারে সরকার’। সরাসরি মানুষের কথা শুনছে, বিহিত করছে রাজ্য সরকার। ২০ হাজার শিবির! এটাও, ভারতের আর কোনও রাজ্যে নেই। এই বাংলাকে কি উল্টো পথে ঠেলে দিতে চাইবেন?
সজাগ থাকুন, ত্রিপুরার মতো বঙ্গভোটেও চাকরির ‘টোপ’ আসবে। আসবে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার প্রতিশ্রুতিও। আপনিই ঠিক করুন, বিপ্লব দেবের মতো কোনও ‘অযোগ্য’ বিজেপি নেতার হাতে নিজের জীবন সঁপে দেবেন কি না!