নবযুগের মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ কাব্যে’ রামায়ণকে নতুন আলোকে বিশ্লেষণ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তিনি ‘ভিখারি রাঘবের’ থেকে রাবণের বীরত্বকে অনেক বেশি মহিমান্বিত করেছিলেন। রামশিবির চেয়েছিল, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’। তার জন্য তাঁরা বিভীষণের সাহায্য নিয়েছিলেন। বিভীষণ হলেন পৃথিবীর প্রথম দলবদলু। অবশ্য বাস্তবে নয়। কেন না রাম চরিত্র কোনও ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। তা পৌরাণিক। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘নারদ কহিলা হাসি, সে সত্য যা রচিবে তুমি-/ ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি তব মনোভূমি / রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ যাই হোক, মেঘনাদকে বধ করার জন্য বিভীষণ গোপন পথে লক্ষ্মণকে নিয়ে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে এলেন। সেখানে নিরস্ত্র অবস্থায় মেঘনাদকে হত্যা করেন লক্ষ্মণ। মৃত্যুর আগে তিনি বিভীষণকে বলেছিলেন, ‘নিজগৃহপথ তাত দেখাও তস্করে?/ চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?’
আজ এই নির্বাচনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের নেতৃত্বে বিজেপির রাজনৈতিক রিয়েলিটি শো দেখতে দেখতে রাজ্যের মানুষের মেঘনাদ বধ কাব্যের বিভিন্ন অংশ মনে পড়বেই। আজ যাঁরা দলে দলে পদ্মশিবিরে ভিড় করছেন, তাঁদের অনেকেই বলছেন, এই রাজ্যে কোনও উন্নয়ন হয়নি। উন্নয়নের স্বার্থেই নাকি তাঁরা পদ্মশিবিরে যোগ দিচ্ছেন। তাঁরা সম্ভবত এ রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন নিয়ে কেন্দ্রের প্রকাশিত রিপোর্টগুলিই উপেক্ষা করছেন। উন্নয়নের নিরিখে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই রাজ্য অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে। এতো কেন্দ্রের রিপোর্টই বলছে। আসল কথা হল রাজ্যের উন্নয়ন নয়, তাঁদের লক্ষ্য আত্ম-উন্নয়ন। আজ কিন্তু অনেকেই ভুলে গিয়েছেন, একদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এঁদের রাজনৈতিক জন্ম দিয়েছিলেন। পথে পড়ে থাকা অনাথ শিশুকে অনেকেই যেমন কুড়িয়ে এনে মানুষ করেন, একটা সুস্থ জীবন দেন, এঁদেরও তেমন মমতা ক্ষমতা দিয়েছিলেন, খ্যাতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের বিবেকহীনতার এই নগ্নতা রাজ্যের মানুষ কি সত্যিই ক্ষমার চোখে দেখবেন? সত্যিই কি আজ মানুষ বলবেন, মমতা ভুল করেছেন, আর এরা আজ সবাই ঠিক? আসলে তৃণমূলের শিবির ভাঙতে না পারলে বিজেপি এই রাজ্যে একশোটি আসনেও প্রার্থী দিতে পারত না। তাই এতদিন যাঁদের তারা গালমন্দ করেছে, তাঁদেরই দল ভাঙিয়ে লোক নিয়ে গিয়ে গোডাউন বোঝাই করছে। কিন্তু এদের ক’জনের নিজ ক্ষমতায় জেতার মুরোদ রয়েছে, সে ব্যাপারে কি বিজেপির জানা নেই? জানলেও অবশ্য কিছু করার নেই। ভোটে প্রার্থী চাই তো। তাই চলছে বিজেপির রিয়েলিটি শো।
একবার সদ্যপ্রসূত বাজেটের দিকে তাকিয়ে দেখুন। স্বাধীন ভারতে এমন রদ্দিতম বাজেট এর আগে হয়েছে কি না সন্দেহ! বাজেটের নমুনা দেখলেই সরকার পক্ষের বড় বড় ব্যক্তিত্বের অর্থনীতি সংক্রান্ত জ্ঞানগম্যি বোঝা যায়। আসলে দেশের অর্থনীতিকে ফোঁপরা করে দিয়েছে বিজেপি সরকার। সরকারের ভাণ্ডার যে শূন্য, তা এই বাজেটই বলে দিচ্ছে। তাই কোথাও যেমন বড় বরাদ্দ নেই। তেমনই কোথায় কর মকুবের ব্যাপারও নেই। একমাত্র কোভিডের জন্য সরকারকে বরাদ্দ বাড়াতে হয়েছে। ভোটের দিকে তাকিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রাস্তার জন্য ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সবটাই কিন্তু কাগজে কলমে। এর দশ শতাংশ টাকাও কিন্তু আসবে না। ভোট মিটলেই সব ভুলে যাবে কেন্দ্র। পাশাপাশি সবকিছ বেচে দেওয়ার পথ হাট করে খুলে দিয়েছে বেচুবাবু সরকার। বেচো আর খাও। আর কী চাই! এও তো সরকার চালানোর এক রিয়েলিটি শো। উজ্জ্বল আলোর বৃত্তে শুধু ভোজবাজির খেলা। মন কি বাত শুনলে আপনার কিন্তু মনে হতে পারে, এই সরকার পৃথিবীর সেরা সরকার।
আর একটা রিয়েলিটি শোয়ের কথা মনে পড়ল। মনে করে দেখুন তো, ভিক্টোরিয়া চত্বরে বাঙালির পরম শ্রদ্ধেয় মানুষ নেতাজির জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানটি। মঞ্চে আলম্বশ্মশ্রু নরেন্দ্র মোদি আছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। তাঁরা উঠে একে একে দেশনায়কের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। সেই সময় তাল কাটল এক গুটখাসেবী যুবকের চীৎকারে। সে বলে উঠল ‘জয়শ্রী রাম’ (উচ্চারণ অনুযায়ী এমনই শোনা গিয়েছে। দেখেছি অনেকে জয় শ্রীরাম ঠিকমতো বলতেই পারে না।)। যে অনুষ্ঠানে বলা উচিত ছিল ‘জয়তু নেতাজি’ বা ‘জয়হিন্দ’, সেই অনুষ্ঠানে বিজেপির একদল অশিক্ষিত চিৎকার করে বললেন ‘জয়শ্রী রাম’। আসলে সাভারকর, নাথুরাম ভক্তরা নেতাজি কে জানেন না। মানেনও না। শুধু ভোটের দায়বদ্ধতাকে মেনে নিয়ে তাদের এই নকল নেতাজি প্রীতি। যতই মোদিকে এনে সাজানো গোজানো অনুষ্ঠান হোক না কেন, ভিক্টোরিয়া অনুষ্ঠানে সান্ধ্য লগ্নে সব উদ্দেশ্যটুকুই নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়ে গেল। মোদিজির উপস্থিতিও সেই লজ্জাটুকু ঢাকতে পারল না। এখান থেকেই বোঝা যায়, এই বাংলাকে গেরুয়া বাহিনীর তাবড় নেতারা কোন দৃষ্টিতে দেখেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে মোদির অশুদ্ধ উচ্চারণে মহাপুরুষের নামাবলী পাঠ ভোট বৈতরণী পারাপারের কড়ি জোগাড় করতে পারবে না। বাঙালি এই অপমান মেনে নেবে না। বাঙালি জানে, যে আসনে নেতাজি, গান্ধীজি, ক্ষুদিরামের স্থান, সে আসনে ঠাঁই পেতে পারেন না সাভারকর, নাথুরামরা। ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লেও পারবেন না।
সেদিন কিন্তু ভিক্টোরিয়ার ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সেদিন সকাল থেকে দুর্গাপুর, আসানসোল সহ বিভিন্ন জেলায় বিজেপির তালেবররা নেতাজির ছবি নিয়ে ‘জয়শ্রী রাম’ বলে পদযাত্রা করেছেন। গুটখা লাঞ্ছিত মস্তিষ্ক এর থেকে উন্নততর সংস্কৃতি জানে না। ধারও ধারে না। গুটখা রঞ্জিত ঠোঁট থেকে কোনওদিন ‘জয়তু নেতাজি’ বেরবে না। ‘জয় শ্রীরাম’ বা ‘জয় নাথুরাম’ বেরতে পারে। বিজেপির সেদিনের আচরণের পর এই রাজ্যের অবিলম্বে শুদ্ধকরণ দরকার। নির্বাচনই হতে পারে সেই শুদ্ধকরণ পদ্ধতি। হয় আমরা বাংলা সংস্কৃতির হাত ধরে বাঁচব, অথবা গুটখা সংস্কৃতির দাসত্ব মেনে ধ্বংস হয়ে যাব। এখানেই এসে পড়ে শেক্সপিয়রের হ্যামলেটের ‘টু বি অর নট টু বি’ প্রসঙ্গটি। তা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। বেঁচে ওঠার পথ না কি মৃত্যুর তমসুক?
বিজেপিবাবুরা বলছেন, ক্ষমতায় এলে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে জবাব। বোঝাই যাচ্ছে, এটা হতাশার বাণী। বুঝে গিয়েছেন, ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়। তাই এখন দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করতে বীররসের কথা, বাহুবলের কথা বলছেন। তাঁরাই আবার সাফাই গেয়ে বলেছেন, ‘জয় শ্রীরাম বলে বেশ করেছি।’ এই ঔদ্ধত্য বিহার, উত্তরপ্রদেশের গুন্ডাগার্দি সংস্কৃতি হতে পারে। বাংলার নয়। বাংলার শিল্পী-সাহিত্যিক ও জনগণ একে ধিক্কার জানিয়েছেন। আই কিউ লেভেল যাঁদের কম বা যাঁরা গোরুর দুধে সোনা খুঁজে পান, ঘুঁটেতে অ্যান্টিরেডিয়েশন খুঁজে পান, পাঁপড় ভাজায় করোনা তাড়ানোর ওষুধ খুঁজে পান, উত্তরপ্রদেশ বা বিহারে তাঁদের বিরাট দাম থাকতে পারে, কিন্তু এ রাজ্যের শিক্ষিত মানুষ তাঁদের গ্রহান্তরের কোনও জীব হিসাবে মনে করেন। রাজ্যের মানুষও কিন্তু ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে হিসাব মেলাচ্ছেন। মমতার কাজ এবং মোদিজির কাজ মানুষ ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মেলাচ্ছেন। মানুষ নজর রেখেছেন কৃষক আন্দোলনের দিকে। মানুষ জানেন, কাদের স্বার্থে মোদি কৃষক বিরোধী আইন তুলে নিতে পারছেন না। আন্দোলনে দিশাহারা মোদিজি আঙুল তুলে বলছেন, ওদের চালাচ্ছে পাকিস্তান। তিনি নিজেকে দেশের চৌকিদার বলে দাবি করেন। অথচ তিনি মানুষকে দিনে দিনে সর্বস্বান্ত করছেন। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে নরকে তিনি নিয়ে গিয়েছেন। আর কিছুদিন পর ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে হয়তো আপনাকেই সুদের টাকা গুনতে হবে। কার স্বার্থে এটা হয়েছে। গ্যাসের দাম কৌশল করে ভর্তুকি ব্যবস্থা করলেন। এখন আটশো টাকায় গ্যাস কিনে ক’ পয়সা আপনার ব্যাঙ্কে জমা পড়ছে, একবার পাসবই খুলে দেখে নেবেন। সবটাই ভক্কিবাজি। কার স্বার্থে এসব হচ্ছে, মানুষ আজ বুঝে গিয়েছে। কর্পোরেটের স্বার্থ দেখতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন দুর্বিপাকের কানাগলিতে। প্রতিবাদের কথা বললেই, আন্দোলনের কথা বললেই আপনি কিন্তু পাকিস্তানের চর।
পাশাপাশি মমতা ভোটের আগে পুরোপুরি অ্যাটাকিংয়ে। একের পর এক এক উন্নয়ন প্রকল্প দিয়ে ভেঙে ফেলছেন গেরুয়া বাহিনীর ডিফেন্স। বিজেপির আক্রমণের মুখে তাঁর অস্ত্র উন্নয়ন ও শান্তি। সেই উন্নয়ন সেই সব সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, যাঁরা বিজেপির কাছে উপেক্ষিত। সেইসব কৃষক, সেইসব শ্রমিক, সেইসব হতভাগ্য মানুষের দল আজও বিবেকের তাড়নায় দলবদলু হতে পারবে না। সত্যিটা বেছে নেবেন সেইসব জনগণই। কেননা এবারে ভোটের লড়াই উন্নয়ন বনাম কুৎসার।