বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যার বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
প্রথম কথা, খরচ করবার আগে দেখা দরকার টাকাটা আসবে কোথা থেকে? আর যদি দেখা যায় যথেষ্ট টাকা আছে তখন দেখা হবে খরচটা কীসের জন্য করা হচ্ছে এবং সেটা কতটা প্রয়োজনীয় ছিল মানুষের স্বার্থে? এই দু’টি প্রশ্নের উত্তর এই বাজেট সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছে। বাজেটের তথ্য-সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে প্রথমেই দেখা যাবে, যে-পরিমাণ খরচের কথা বলা হয়েছে তার সংস্থান রাজ্যের আয় থেকেই হচ্ছে। ঘাটতি আছে সামান্যই। প্রায় ২ লক্ষ ৫৫ হাজার কোটি টাকার বাজেটটি দাঁড়িয়ে আছে নিজস্ব আয় সংস্থানের উপর। অভূতপূর্ব বিষয় এটাই। কেন্দ্রের অনুদান বা কেন্দ্রের প্রকল্প সামনে রেখে রাজ্যে উন্নয়নের মানচিত্র তৈরি করা হয়নি। কারণ, এখানে কাজ করেছে একটা বিকল্প ভাবনা। ভাবনাটা এই যে, প্রচলিত পথে যেখানে শিল্পের লগ্নি খুব বেশি নেই, এবং চাইলেই কাল সেই লগ্নির জোয়ার বাংলায় আসবে না, তাহলে বাংলার উন্নয়ন হবে কী দিয়ে? আবগারি শুল্ক, স্ট্যাম্প ডিউটি থেকে? না। জিএসটি বাবদ রাজ্য বিপুল টাকা পায়। আছে কয়লার রয়্যালটি এবং পেট্রল-ডিজেলে করের ভাগ। এরকম নানা সূত্রে যে অর্থাগম হচ্ছে সেটা প্রতি মাসেই বাড়ছে। সেই অতিরিক্ত অর্থ পরিকল্পনা করে ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যাতে বাংলার মানুষের হাতে নানাভাবে অর্থের জোগান বাড়ে। নানারকম প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে টাকাটা মানুষের হাতে পৌঁছলে প্রকৃতই মানুষ উপকৃত হয়, বাড়ে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা।
এই বর্ধিত চাহিদা আরও বেশি খরচের মধ্যে দিয়ে রাজ্যের কোষাগারে জিএসটি বাবদ আয় বাড়িয়ে দেবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এত সবুজশ্রী কন্যাশ্রী রূপশ্রী ইত্যাদি নানা সব জনমুখী প্রকল্প করে টাকা জনগণের হাতে তুলে দিচ্ছে। তাতেই একই সঙ্গে বাড়ছে রাজ্যের আয় এবং কর্ম সংস্থান। খেয়াল করুন, এরাজ্যে শিল্পবৃদ্ধি একটি মাত্রায় আটকে থাকলেও কিন্তু বাণিজ্যের বৃদ্ধি ঘটছে। প্রথাগত ক্ষেত্রে চাকরি সৃষ্টি নাহলেও রাজ্যের অসংগঠিত ক্ষেত্রের বৃদ্ধি সারা দেশে সব চাইতে বেশি। গ্রামীণ আয় বাড়াতে রাজ্যের কৃষি খুব ভালো সাপোর্ট দিচ্ছে। সামগ্রিকভাবে রাজ্য তাই নিজের অর্থ সংস্থানের বিকল্প উৎস তার নিজের নীতির আর প্রয়োগের মধ্যেই পেয়ে গেছে। শিল্প ছাড়াও একটি রাজ্যের অর্থনীতি কতটা তেজিভাবে এগতে পারে সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বিকল্প ভাবনার প্রয়াসের সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রের সমীক্ষা সেই কথাই বলছে। সারা দেশে ১০০ দিনের কাজে রাজ্য প্রথম। এর মানে, ১০০ দিনের মজুরির টাকাটা নিয়মিত স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন দোকানে ভাগে ভাগে খরচ হচ্ছে। তাতে এলাকায় বেচাকেনা বাড়ছে। আয় বাড়ছে অন্য শ্রেণির মানুষের। সেই দোকানদারের আয় অন্যত্র খরচ হচ্ছে, যা রাজ্যের শহরকেন্দ্রিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে শক্ত ভিত তৈরি করে দিচ্ছে। তার উপর দাঁড়িয়ে খুচরো বাজার, নির্মাণশিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট ও বিবিধ পরিকাঠামোর মধ্যে দিয়ে রাজ্য সরকারের দেওয়া নানা খাতের টাকা হাতে হাতে ঘুরছে। ফলে নতুন চাহিদার সৃষ্টি হচ্ছে। এই চাহিদা বৃদ্ধি করতে পারাটাই রাজ্যের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির আসল কৌশল।
তাতে একই সঙ্গে রাষ্ট্রের আয় বাড়ে, জনগণের আয় বাড়ে, বেকারের কর্মসংস্থান ঘটে। ঠিক এভাবেই মমতার সরকার বিগত বাজেটগুলি করে আসছে। এতে একটা ধারাবাহিক উন্নয়নের ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে। এই সত্যটা কেন্দ্রের পরিসংখ্যান মন্ত্রকের তরফে প্রকাশিত তথ্যেই পরিষ্কার। তিনটি ক্ষেত্রে মমতার সরকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে: (১) সংগঠিত শিল্প ছাড়াও উন্নয়নের হার বৃদ্ধি। (২) উন্নয়ন অব্যাহত রেখে বিপুল ঋণের বোঝা কমানো। (৩) বিকল্প পথে আয় সৃষ্টি করার ক্ষমতা। এভাবেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার দেশের জাতীয় বৃদ্ধির চাইতেও বেশি বৃদ্ধি নিজের রাজ্যে বজায় রেখেছে। এটাও কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য। অন্যদিকে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য হল, বাম আমলে যে পরিমাণ ঋণের বোঝা ছিল তৃণমূল সরকার তা শোধ করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি দক্ষতা দেখাতে পেরেছে।
কিন্তু যেটা পারেনি সেটা হল, সংগঠিত ক্ষেত্রে শিল্প উন্নয়ন। ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে ধরনের চাকরি চায় সেটা সৃষ্টি করতে পারেনি। এই বাজেটে সেই দিকেও নজর দেওয়া হল। সামগ্রিক উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান ধরে রাখার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু দেশের প্রথম সারির রাজ্যগুলির মধ্যে একটি। এই তথ্য আবারও বলছি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দেওয়া নয়, এটিও মোদি সরকারের দেওয়া।
তাই রাজনৈতিক বিরোধিতা করার জন্য এই রাজ্যের অর্থনীতি নিয়ে যেভাবে গেল গেল রব তোলা হয় সেটা আদৌ ঠিক নয়। আসলে, দশ বছরে পায়ের তলার মাটি এতটা শক্ত হয়েছে বলেই একটার পর একটা জনমুখী প্রকল্প মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার মতো সাহস দেখাতে পেরেছে। তবে এই বাজেটে সঙ্গতভাবে কয়েকটা প্রশ্ন উঠতে পারে। মাত্র ৫০ কোটি টাকা দিয়ে বা ৫০০ কোটি টাকা দিয়ে যে সমস্ত কথা বলা হচ্ছে তা কি আদৌ করা সম্ভব? এখানে প্রতিশ্রুতি বিলানো হচ্ছে যা আদৌ কোনওদিন বাস্তব রূপ পাবে না! বিরোধীদের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এটাও বাজেটের স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, এই ঘোষণাগুলি একবছরের জন্য নয়। এটা আগামী পাঁচ বছরের জন্য একটা ভাবনা। এই পাঁচবছরে রাজ্যের আয়ের সংস্থান আরও বাড়বে। বর্তমান হার বজায় থাকলে কমপক্ষে দুই থেকে তিনগুণ হবে। অর্থনীতিতে মানি মাল্টিপ্লায়ার থিওরি বলে একটি কথা আছে। রাষ্ট্রীয় খরচের মধ্যে দিয়ে ওই তত্ত্বে কতটা আয় এবং চাহিদা বাড়ানো যায় সেই ভাবনাটা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার চলছে। বাজেটের মধ্যেই তার অন্তর্নিহিত শক্তি লুকিয়ে আছে ওই তাত্ত্বিক ভিত্তিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থনৈতিক দর্শন তাই যে বাজেট প্রস্তুত করে তার বিশ্লেষণ করতে হবে ওই আলোয়। যেমন, অশোকনগরে তেল কতটা পাওয়া যাবে তার চাইতেও বেশি সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে পরোক্ষে। তেল খুঁড়তে গেলে যত টাকা লগ্নি হবে, তার পরোক্ষ প্রতিক্রিয়ার ফলে এলাকায় অনেক দোকান হবে। মজুরি বাড়বে। ঘরবাড়ির ভাড়া বাড়বে। রোজগার বাড়বে এলাকার মানুষের। কাজের অনেক সুযোগ হবে। এটাকেই এই সরকার বলে কর্মসংস্থান, এবং এটা ঘটনা যে এরাজ্যে সরকারি হিসেবে (প্রথাগত সংগঠিত ক্ষেত্রের হিসেবে) চাকরি নেই, কিন্তু কাজ করার লোকগুলো বসেও নেই। এলাকায় কাউকে কর্মহীন দেখা যাবে এমন মানুষের সংখ্যা কমে আসে প্রতি বছর। এটাও ঠিক যে কৃষিক্ষেত্রে কাজ নেই, এলাকায় কাজ নেই, তাই দলে দলে বেকার যুবক ভিন রাজ্যে যাচ্ছে। আজ তারাই পরিযায়ী। এই সমস্যা মেটাতে এই সরকার এবার গ্রামোন্নয়ন এবং সড়ক নির্মাণে জোর দিয়েছে। পরিকাঠামো খরচ বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের রাস্তা খোলার প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে এলাকাতেই অনেক শ্রমনিবিড় কাজ সৃষ্টি হয়।
শেষ করারার আগে একটা কথা বলতেই হবে, দেশটা মানুষের। তাদের কথা ভেবে, তাদের ব্যথা দূর করার কথা ভেবে একটা সরকারকে দেশ চালাতে হয়। এই বাজেটে ঘোষিত উপর্যুপরি প্রকল্পগুলি তার প্রমাণ রেখেছে। গণতন্ত্রকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটা আপ্রাণ চেষ্টা আছে। আর আছে আগামী প্রজন্মকে তৈরি করার জন্য জোরের জায়গা হিসেবে শিক্ষাকে বেছে নেওয়া। তাই বিকল্প অর্থনৈতিক ভাবনা শুধু নয়, দলীয় তন্ত্র ছেড়ে দায়বদ্ধ গণতন্ত্র অনুশীলন এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির আবহে রাজ্যের অর্থনীতিকে সাজানোর চেষ্টা আছে, যেটা খুব প্রয়োজন। এই বাজেট তাই শুধুই একটা ভোট অন অ্যাকাউন্ট নয়। আগামিদিনে বাংলার ঘুরে দাঁড়ানোর পথ এবং অনৈক্য কমিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের উন্নয়নের জন্য ভাবনা এতে রয়েছে। নতুন দিশায় সাজানো এই বাজেটের অনেক কথার মধ্যে একটা কথা বলার আছে, করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় করতে জনস্বাস্থ্য এই বাজেটে উপেক্ষিত। সেটা ভাবা দরকার ছিল।