বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যার বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
একজীবনে এও হয়! বাংলার সব পরিবারের সবার জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যের রাজ্য সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্পের নাম স্বাস্থ্যসাথী। পরিবারের যে-কোনও সদস্যের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গুরুতর চিকিৎসা/অপারেশনের জন্য স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দেওয়া হয়েছে। সারা রাজ্যে নথিভুক্ত সরকারি/বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ‘ক্যাশলেস’ চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’হাজারের বেশি প্যাকেজভুক্ত রোগের চিকিৎসায় এই কার্ড গ্রাহ্য। চিকিৎসা সবার অধিকার। এসব এতদিন বড় বড় কেতাবি বুলির মতোই গুরুত্বহীন ছিল। পাশাপাশি চিকিৎসা ছিল একটা আতঙ্কের নাম। মমতা সেই আতঙ্ক থেকে সবাইকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন।
লোকে জানত, চিকিৎসা গরিবের জন্য নয়। তাদের দৌড় বড় জোর সরকারি হাসপাতাল। সেখানে সারাদিন হত্যে দিয়ে আউটডোরে ডাক্তার দেখানোটা হয়তো হয়ে যায়, কিন্তু ভর্তি হয়ে অপারেশন বা গুরুতর অসুখের চিকিৎসা পাওয়া? ডেট পেতে পেতে রোগীই দুনিয়া থেকে সরে যায়, রোগ আর সারে না। এই যেখানে পরিস্থিতি ছিল, সেখানে বেসরকারি চিকিৎসা ক্ষেত্রের দরজাও মমতা খুলে দিলেন গরিবদের জন্য। বড়লোক আর মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা অংশই শুধু বেসরকারি হাসপাতাল/ নার্সিংহোমের দামি চিকিৎসা নিতে অভ্যস্ত। তাঁদের বেশিরভাগের ব্যক্তিগত বা কর্পোরেট স্বাস্থ্য বিমা করা থাকে। তার জন্য মোটা অঙ্কের প্রিমিয়াম গুনতে হয়। তারপরেও থাকে ‘ক্ষুদ্র অক্ষর’-এর একগুচ্ছ শর্ত। তাতে অনেক চিকিৎসার ন্যায্য দাবিই নস্যাৎ হয়ে যায় কার্যকালে। প্রিমিয়ামের হার নানা অজুহাতে ক্রমবর্ধমান, করোনার ধাক্কায় তা আরও বেড়েছে। তাই ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বিমা মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে।
মমতা নিশ্চয় এটা নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন। স্বাস্থ্যসাথী তাঁর সেই মানবিক মুখেরই ছবি। এই স্কিমের বিশেষত্ব: পুরনো রোগেরও চিকিৎসা মিলবে এবং গরিব রোগীরা হাসপাতালে যাতায়াতের কিছু খরচা পাবেন। কোনও উন্নাসিক বেসরকারি হাসপাতাল/নার্সিংহোম পরিষেবা দিতে অস্বীকার করলে তার লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলে সাফ জানিয়ে রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সুনীতিবালার বাড়িতে কাজ করেন রূপালি ভুঁইয়া। স্বামীপরিত্যক্তা মহিলা। বছর তিরিশের রূপালির একটি ছেলেও আছে। রূপালি আতঙ্কে থাকে, তার যাবতীয় আশা-ভরসা ছেলেটার যদি বড় কোনও রোগ হয়! রূপালির সেই আতঙ্ক দূর হয়ে গিয়েছে সুনীতিবালার সুপরামর্শে। রূপালির হাতেও এখন স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। বহুদিন বাদে দীপকের ফোন পেয়েছে রূপালি। নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। দীপক হল রূপালির ছেলে গাবলুর বাবা। দীপকের আর্জি, রূপালির স্বাস্থ্যসাথীতে তার নামটাও যদি রাখা হয়! তার যুক্তি, সে এখনও রূপালির ‘স্বামী’, তাদের তো কোর্ট মারফত ছাড়াছাড়ি হয়নি। রূপালি এই প্রথম দাপটের সঙ্গে দীপকের মুখের উপর তার দরজা বন্ধ করে দিতে পেরেছে।
স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডে পরিবারের কোনও একজন মহিলাকেই বেনিফিসিয়ারি রাখার নিয়ম। বাংলার সমাজে একটি মেয়েকে শেখানো হয়, তুমি মেয়ে হয়ে জন্মেছ, অতএব তোমার অনেক সহ্যগুণ থাকতে হবে। ভাই/দাদা থাকলে মাছ থেকে বড় মিষ্টি, সব সেরা জিনিস তাদের প্রাপ্য। অবশিষ্ট কিছু থাকলে পাবে বোন/দিদি। এই শুরু। দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে আত্মত্যাগে অভ্যস্ত করে নেওয়া হয়—শিক্ষা এবং কেরিয়ারেও। ভাই/দাদাকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর প্রয়োজনে বোন/দিদিকে স্কুল-কলেজের পড়া ‘স্যাক্রিফাইস’ করতে হয়। কেননা, তারা তো পরের ঘরেই চলে যাবে। সংসারধর্ম পালন করবে। অতএব তাদের পিছনে টাকা খরচ করে কী লাভ? ঠিক যেন ব্যবসা, ইনভেস্টমেন্টের রিটার্ন নিয়ে ক্যালকুলেশন! একইভাবে স্বামীর সংসারে গিয়েও খাওয়া-দাওয়া শখ-আহ্লাদ সবেতেই স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অগ্রাধিকার মেনে নিতে হয় হাসিমুখে। মা হওয়ার পর শুরু হয় যৎসামান্য দাবিটুকুও একে একে সন্তানের কাছে ছেড়ে দেওয়া। সব মিলিয়ে মেয়েদের ‘বাপের বাড়ি’ কিংবা ‘শ্বশুর বাড়ি’ বা ‘স্বামীর ঘর’ হয়—‘নিজের ঘর’ বলে কিছু থাকতে নেই।
যে-সমাজের এই বিধান, সেখানে মমতাই প্রথম বললেন, স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডে বেনিফিসিয়ারি হবেন একজন মহিলা। স্বামী বা পুত্র নন, তিনি হবেন মা/স্ত্রী/কন্যা। অভূতপূর্ব এক স্বাদ। এই প্রথম। অনেক উলট-পুরাণের প্রতীক্ষায় থাকে মেয়েরা, সারা জীবন। কিন্তু প্রতীক্ষার অবসান হয় না। নারীজীবনের এমন এক অনন্ত প্রতীক্ষার অবসান ঘটালেন মমতা।
আসলে মমতা কোনও একজন মেয়ের নাম নয়—একটা লড়াইয়ের নাম, একটা আন্দোলনের নাম—যে লড়াই/আন্দোলন জয় ছিনিয়ে নিয়ে তবেই শেষ হয়। প্রায় অসম্ভবকে নিশ্চিতরূপে সম্ভব করে তোলার নাম মমতা। রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসা থেকে নতুন দল তৈরি, রাইটার্স দখল, নরেন্দ্র মোদির মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়ে রাজনীতি করা—এই সুদীর্ঘ পথের কথা চিন্তা করলে তিনি একটা আস্ত বিস্ময়। নিজের জীবন দিয়েই মমতা দেখিয়ে দিয়েছেন একজন নারী কত দূর লড়াই করতে পারেন।
কিন্তু এক জীবনে সব করা যায় না। প্রগতিশীলতা ও উন্নয়নের এটাই নিয়ম। তাই অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব তিনি তুলে দিচ্ছেন তাঁর অগণিত কন্যাশ্রীর হাতে। কিশোরীদের ক্ষমতায়নের জন্য ২০১৩ সালে মমতা কন্যাশ্রীর উদ্ভাবন করেন। এখনও পর্যন্ত বাংলার প্রায় ৬৮ লক্ষ কিশোরী কন্যাশ্রীর মাধ্যমে আলোকিত হওয়ার অভূতপূর্ব সুযোগ পেয়েছে। তারা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, গবেষণা করছে। অন্যদিকে, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে আরেক দল কন্যাশ্রী ‘স্বপ্ন ভোর’ স্কিমে কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বনির্ভর হচ্ছে।
এমনকী, অভাবী পরিবারের মেয়ের বিবাহে এককালীন ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেওয়ার জন্য চালু রয়েছে রূপশ্রী স্কিম। ২০১৮-র এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ বিবাহযোগ্য কন্যাকে এই স্কিমে টাকা দেওয়া হয়েছে। অবাক ব্যাপার, সম্প্রতি একটি মেয়ে রূপশ্রীর আবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছে! ফলতার কলসগ্রামের ক্লাস টুয়েলভের মাজেদা খাতুন সোজা বিডিওর কাছে গিয়ে জানায়, এই বিয়েতে তার মত নেই। সে আরও পড়তে চায়। যে-কথা বাবা-কাকাদের কাছে বলার সাহস হয়নি, সেই কথাই মাজেদা জানিয়েছে বিডিও সাহেবকে। আমরা জানি, অমতের বিয়ে রুখে দিয়ে উচ্চশিক্ষার পথে অবিচল থেকেছে অনেক মেয়ে, কিন্তু রূপশ্রীর আবেদন প্রত্যাহারের কথা শুনিনি। সেদিক থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রেরণায় মেয়েদের শিক্ষা আন্দোলনের এটা অবশ্যই এক নতুন দিক। এক কন্যাশ্রী বাংলার কন্যাদের মানসিক ভিত কতটা মজবুত করে দিয়েছে, এই ঘটনা তারই প্রমাণ। এই ঘটনা কন্যাশ্রীর সাফল্যেরই বিস্তৃতি।
বাংলার মাটি বস্তুত বামপন্থা অনুশীলনের জায়গা। বামপন্থীদের দীর্ঘকাল নেতৃত্ব দিয়েছে সিপিএম। বামফ্রন্ট গড়ে তারা ইয়া লম্বা ইনিংসের সরকার গড়েছে। কিন্তু ক্ষমতার চিটেগুড়ে এমন আটকে গিয়েছিল যে, ক্ষমতালাভের উৎসটাকেই বামপন্থা থেকে অনেকখানি দূরে সরিয়ে দিয়েছিল তারা। রাজনীতির সঙ্গে হাওয়ার সম্পর্কটা অদ্ভুত। শূন্যস্থানের গন্ধ পেলেই হাওয়া দ্রুত সেখানে ছুটে গিয়ে দখল নেয়। বামফ্রন্ট প্রকৃত বামপন্থা ছেড়ে দিতেই জায়গাটা দ্রুত দখল করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি। শুধুমাত্র প্রচলিত বামপন্থী আদর্শে মানুষের কল্যাণের কাজে আটকে নেই তিনি, ব্যাপারটাকে তাঁর নিজস্ব ডিকশনে ও উদ্ভাবনী প্রতিভায় নিরন্তর উন্নত করে চলেছেন। তাই হলফ করে বলা যায়, মমতা যতদিন রাজনীতিতে আছেন বাংলায় সিপিএমের কিচ্ছুটি করার নেই। মোদির সৌজন্যে ভোটের বাজারে তারা হঠাৎ কিঞ্চিৎ প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়ার পরেও মন্তব্যটি অপ্রাসঙ্গিক মনে করছি না।
অন্যদিকে, ‘তৃণমূলের বি টিম’ হয়ে বিজেপির পক্ষে কতদূর এগনো সম্ভব হবে? ভোট ঘোষণার আগেই, দিলীপ ঘোষ ১০ দফায় ভোটগ্রহণের আর্জি নিয়ে দিল্লি গিয়েছেন। ভালো কথা। কিন্তু একদা ‘সিপিএমের বি টিম’ কংগ্রেসের করুণ মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখবেন না! রাজ্যে এজেন্ট বসিয়ে রেখে, ভাড়াটে সৈনিক দিয়ে, কমিশনের উপর পরোক্ষে চাপ সৃষ্টি করে আর যাই হোক কোনও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। অসময়ে রথ দেখিয়ে সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যটি যত দেখনদারি ধর্মের ভিতরে ঢুকবে, রাজধর্ম থেকে সরে যাবে তত। রাজধর্ম পালনে আন্তরিকতার জবাবে ধর্মের নামে বজ্জাতি উপহার—এমন দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কীই-বা আছে গেরুয়া ঝুলিতে! মোদির পার্টি দুর্গা বাহিনী তৈরি করেছে। কিন্তু সেই নকল দশভুজাদের দশ হাতই শূন্য। মমতার রক্ত-মাংসের দ্বিভুজা কন্যাশ্রীদের এক হাতে শিক্ষা আর অন্য হাতে সুস্বাস্থ্য। একটা মানবজীবন সুন্দরভাবে পেরতে আর কোন অস্ত্রের প্রয়োজন?