বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যার বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
বর্তমান: ত্রিপুরায় বিজেপির সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিজেপি শাসনে কেমন আছেন সেখানকার মানুষ?
মানিক সরকার: ত্রিপুরায় বিজেপি সরকারে এসেছে ৩৪ মাসের মতো হল। নতুন সরকার। এর আগে ত্রিপুরায় তারা কোনওদিন সরকার গড়েনি। কিন্তু মাত্র ৩৪ মাসে ‘অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি’ যে জায়গায় পৌঁছেছে, তা ভাবা যায় না। আমার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের যে অভিজ্ঞতা, তার সঙ্গে মেলাতেই পারছি না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে, কেন এমনটা হল? কারণ মানুষ ভোট দেওয়ার পর সরকারের কাজকর্ম দেখার জন্য সাধারণত পাঁচ বছর অপেক্ষা করেন। কিন্তু ত্রিপুরায় বিজেপি সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভ, অবিশ্বাস, অনাস্থা ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। তার প্রথম কারণ ভোটের আগে যে কথা বলেছিল, তার সঙ্গে সরকারের কাজের কোনও মিল ত্রিপুরার মানুষ খুঁজে পাচ্ছেন না।
বর্তমান: কথা ও কাজের মধ্যে ফারাকটা কোথায়?
মানিক সরকার: দেখুন, বিজেপি নির্বাচনী প্রচারে ‘ডবল ইঞ্জিনে’র ফাঁদ তৈরি করে বেকারদের
চাকরি দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু, সেই প্রতিশ্রুতি তারা রাখতে পারেনি। শিক্ষিত বেকারদের প্রলুব্ধ করার পাশাপাশি বিজেপি গরিব মানুষকেও প্রলোভনের ফাঁদে ফেলেছিল। বিজেপি বলেছিল, ক্ষমতায় এলে ওরা ১০০ দিনের কাজটা ২০০ দিন করে দেবে। আর মজুরি বাড়িয়ে ৩৪০ টাকা করবে। আমাদের সময় ১০০ দিনের কাজে ত্রিপুরা ছিল দেশের প্রথম সারিতে। পর পর তিন বছর আমরা দেশের মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম। সর্বোচ্চ ৯৪ দিন কাজ
দিতে পেরেছিলাম। আর এখন সেটা ৪৫ থেকে ৫৬ দিনে নেমে এসেছে। মজুরি তো ৩৪০ টাকা
হয়ইনি, সেই ২১০ টাকাই দেয়। তাও পুরো মজুরি শ্রমিকরা পাচ্ছেন না। তার একটা অংশ মণ্ডলের
নামে লুটপাট হচ্ছে। মানুষ মুখ বুজে সহ্য করতে
বাধ্য হচ্ছেন। অর্ধাহার, অনাহার শুরু হয়েছে।
মানুষ কাজের জন্য অন্য রাজ্যে যাচ্ছেন। বিজেপির ভাঁওতা ত্রিপুরার মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। তবে, সবচেয়ে বেশি আক্রমণ নেমে এসেছে
গণতন্ত্রের উপর।
বর্তমান: গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ বলতে ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?
মানিক সরকার: ভোট গণনার দিন দুপুর ২টোর সময় স্পষ্ট হয়ে গেল, বিজেপি ত্রিপুরায় ক্ষমতায় আসছে। বিকেল ৪টে থেকেই শুরু হয়ে গেল সন্ত্রাস। মারধর, দোকানপাট ভাঙচুর। আর সরকার গঠনের পর বুলডোজার দিয়ে বিরোধীদের পার্টি অফিস ভাঙা শুরু করল। সারা ভারতবর্ষে খাসজমির উপরেই পার্টি অফিস হয়। আমাদের ত্রিপুরাতেও ছিল। বামেদের উপর ওদের আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হলেও কংগ্রেস বাদ যায়নি। আক্রান্তরা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যেতে পারছেন না। এমনকী, থানার পথও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কারণ কিছু থানায় অভিযোগ জানাতে গেলেই পুলিস অভিযুক্তদের ডেকে পাঠিয়ে উল্টো মামলা করিয়ে দিয়ে আমাদের লোকজনকেই গ্রেপ্তার করছে। এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
শুধু বিরোধীরা বা সাধারণ মানুষই নয়, সাংবাদিকরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। কোভিডের সময় হাসপাতালের কিছু দুরবস্থার খবর সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল। তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য সভায় হুমকি দিয়ে বললেন, যারা এগুলি করছে, তাদের আমরা দেখে নেব। সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করে বললেন,‘মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কথা প্রত্যাহার করুন।’ কিন্তু নিজেদের সংশোধন করা তো দূরের কথা, মুখ্যমন্ত্রীর হুমকির পর ত্রিপুরায় ২২ থেকে ২৩ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন। আগেরগুলি আর নাই বা বললাম। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে আক্রান্ত মানুষ আদালতে মামলা পর্যন্ত করতে পারছেন না। কারণ আক্রান্তদের হয়ে মামলা করলে আইনজীবীকেও আদালত চত্বরে পেটানোর ঘটনা ঘটছে।
বর্তমান: বিজেপি বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে তারা মানুষের গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেবে। আপনার কী অভিমত?
মানিক সরকার: পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন
ওঠাটা খুবই স্বাভাবিক। পঞ্চায়েত ভোটে বহু
জায়গায় বিরোধীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয়নি। মেয়াদ শেষে পুরসভার নির্বাচন না করায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে। সেই ক্ষোভকে বিজেপি কাজে লাগাতে চাইছে। কিন্তু বিজেপি যেন ভুলে
না যায়, ত্রিপুরায় পঞ্চায়েতের প্রায় ৯৫ ভাগ আসন ওরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল। তাছাড়া গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় নির্বাচন কমিশন দেশের মধ্যে মাত্র একটি আসনেই নির্বাচন স্থগিত করে দিয়েছিল, সেটি পূর্ব ত্রিপুরা লোকসভা কেন্দ্র। তাই বিজেপির মুখে গণতন্ত্রের কথা মানায় না।
বাম গণতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তিই গণতন্ত্রকে সর্বাধিক মর্যাদা দেয়। এরাজ্যের মানুষ সেটা অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুধাবন করছেন।
বর্তমান: ত্রিপুরায় জনপ্রতিনিধিদের কী অবস্থা? তাঁরা কি স্বাধীনভাবে আন্দোলন বা প্রতিবাদ জানাতে পারেন?
মানিক সরকার: আমরা বিরোধী দলে আছি।
আমাদের এখন ১৬ জন বিধায়ক। আমি ২০ বছর সরকার চালিয়েছি। মুখ্যমন্ত্রী ছিলাম। এখনও আমি বিধায়ক। কিছু ঘটলেই ওরা আমাকে ঘটনাস্থলে যেতে বাধা দেয়। মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। সন্তান বিক্রি করছে। সাধারণ মানুষ রেশন পাচ্ছেন না। প্রতিবাদ করলে খুন হচ্ছে। খোঁজ নেওয়ার জন্য
সেই সব জায়গায় যেতে গেলেই আমাকে আটকে দেওয়া হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে আমি নিজে
১৫ থেকে ১৬ বার অবরুদ্ধ হয়েছি। এমনকী, বিধানসভার প্রতিনিধিদের নিয়ে সেখানে যেতে গেলেও আটকে দেওয়া হয়েছে। পুলিস এসে বলছে, স্যার, আমাদের ক্ষমা করবেন। আমাদের হাত, পা বাঁধা। আমরা কিছু করতে পারব না।
এই হচ্ছে বিজেপি শাসিত ত্রিপুরার গণতন্ত্রের প্রকৃত অবস্থা। এরা পশ্চিমবঙ্গে কী করে মানুষের ভালো করবে? তবে, এরাজ্যে খাল কেটে
কুমিরকে ডেকে এনেছে তৃণমূল। সেই কুমির যদি ঘরে ঢোকার সুযোগ পায় তাহলে রক্ত, হাড়, মাংস
সব নিংড়ে নেবে। বিজেপি মুখে যত বড় বড় কথাই বলুক না কেন, তারা কিছুতেই মানুষের ভালো
করতে পারে না। আমার বিশ্বাস, কেন্দ্রের
সরকারকে দেখে কথা ও কাজের ফারাকটা বাংলার মানুষ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।