বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যার বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
আমি যখন স্কুলছাত্র, শুনেছি—ব্রুটাস তুমিও! আমি শুনেছি যে জিসাস ক্রাইস্টের সবথেকে প্রিয় শিষ্য বললেন, ‘প্রভু, আমি তোমাকে কখনওই অস্বীকার করব না’। জিসাস উত্তর দিলেন, ‘আজকে রাত্রেই যখন তিনবার মোরগ ডেকে উঠবে, ঠিক তখনই তুমি আমায় অস্বীকার করবে। বলবে, কে জিসাস? তোমাকে তো আমি চিনি না!’ আসলে, আমি একটা পলিসিতে বিশ্বাস করি, আমায় কেউ ভুল বুঝবেন না। আমি সন্দেহপ্রবণ লোক নই। কিন্তু একটা ফিলোসফি আমার আছে যে, ‘সিজারস ওয়াইফ মাস্ট বি অ্যাবভ অল সাসপিশন’। সিজারের যে বউ হবে তাকে সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। তেমনি আমি একজন তৃণমূল কর্মী, আমি যেন আমার দলের কাছে, আমার দেশের কাছে, আমার বাংলার মানুষের কাছে, আমার নেত্রীর কাছে সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকি। আমি কী করলাম, কী খেলাম, কোথায় বেড়াতে গেলাম, কোন জামাকাপড় পরলাম—এটা কোনও ফ্যাক্টর না। ফ্যাক্টরটা হচ্ছে, বেসিক ক্যারেকটার আমার চেঞ্জ হচ্ছে কি না।
বেসিক ক্যারেকটার আমার একটাই, প্রয়োজনে আমরা চৈতকের নাম বলি। প্রাণ দিয়েছিল, কিন্তু প্রভুকে বাঁচিয়েছিল। ছোট থেকে আমার প্রিয় পদ্য, পোয়েম বা একটা গদ্যই ছিল, যে আমি ‘ক্যাসাবিয়াঙ্কা’ হতে চাই। আমার ক্যাপ্টেন আমাকে বলেছে যে, তুমি এখানে দাঁড়াবে। আমি যদি বুঝতেও পারি যে আস্তে আস্তে আমার পায়ের তলাটা ভিজে যাচ্ছে, আমার কোমর অবধি জল চলে এসেছে, আমি কিন্তু নড়ব না। কারণ, আমি ক্যাসাবিয়াঙ্কার চরিত্রে বিশ্বাস করি।
একবারের ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। বালুরঘাটে প্রচণ্ড বন্যা আর নানাদিক থেকে জল ঢুকে গিয়েছিল গঙ্গায়। আমি এবং আমার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা ট্যাক্সিতে ছিলাম। অ্যাম্বাসাডর ট্যাক্সি, মানে অন্য কোনও গাড়ি জোটেনি। আর যখন দু’পাশ থেকে দোতলার ওপর থেকে মানুষ বলছে, আর এগবেন না। গাড়িটা ডুবে যাচ্ছে। চাকা ডুবে গেছে। ড্রাইভিং সিটে জল ঢুকে গেছে। আর আমি কী করেছি, বোকার মতো দুম করে দরজাটা খুলে দিয়েছি। অমনি হু হু করে জল ঢুকে গেল। পুরো ভিজে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চারিদিকে দোতলায় দাঁড়িয়ে যেসব মানুষ এসব দেখছেন, তাঁরা চিৎকার করছেন। আমি সেদিনও দেখেছিলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আমি ভয় করব না, ভয় করব না’ রূপ। মৃত্যুভয়ে, নিজে বাঁচার জন্যে সবাইকে ছেড়ে পালাবার চেষ্টা তিনি করেননি। ভেসে ওঠার চেষ্টা করছেন। আর ভেসে উঠেছিলেন বলেই, বাংলার মানুষ বলল, তুমি মহাসমুদ্রে ভেসে উঠবে। এই জনসমুদ্রে তাই বারবার ভেসে উঠছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
জগৎ শেঠ, উমিচাঁদদের আমি অপছন্দ করি। কারণ, তারা বেইমানি করেছিল। কিন্তু তারা ধাপে ধাপে ধাপে, তিলে তিলে তিলে, বছর বছর ধরে বেইমানি করেনি—করেছিল একবারে। একরাতে পলাশির প্রান্তরে, সিরাজউদ্দৌলার প্যালেসে। কিন্তু আমরা তাদের মেনে নিতে পারি না। আমার ভাই হতে পারে, আমার আত্মীয় হতে পারে, আমার সঙ্গে সন্ধিপুজোয় অঞ্জলি দিতে পারে, কিন্তু আমাকে যে বাঁচিয়ে রেখেছে, তাকে আমি মানব না? যার কোলে গিয়ে পায়রাটা পড়ল, ব্যাধ এসে বলল যে, ‘এটা আমার শিকার এটা আমায় দিতে হবে’। বুদ্ধ বললেন, ‘না আমি দিতে পারব না। প্রয়োজনে আমার প্রাণ নাও। কারণ, ওকে আমি আমার কোলে আশ্রয় দিয়েছি। ও বাঁচবার জন্য আমার কোলে আশ্রয় নিয়েছে।’ শরণাগত দীনার্ত পরিত্রাণ পরায়ণে। বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি। সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি। আমরা যেন বলতে পারি, ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়’। আমাকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে চলো, আমাকে জ্ঞান থেকে অজ্ঞানের পথে নয়, অজ্ঞান থেকে জ্ঞানের পথে নিয়ে চলো। চলো অমৃতের সন্ধানে যাই। কিন্তু ইমানদারের মতো।
মান্না দে-র একটা গান আছে, ‘সবাই তো সুখী হতে চায়, তবু কেউ হয়, কেউ হয় না।/ জানি না লোকে যা বলে সত্যি কি না, সবার কপালে নাকি সুখ সয় না।’ হয়তো আমার কপালে মন্ত্রিত্ব সয় না, হয়তো আমার কপালে ক্ষমতা সয় না। হয়তো ভগবান আমার কপালে লিখেছিলেন, তুই বারবারই পাওয়ারের কাছে যাবি, ক্ষমতার অলিন্দে ঘুরবি, কিন্তু ক্ষমতার অংশীদার হতে পারবি না।
কিন্তু, ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার জন্য আমি আমার আত্মসম্মান, চরিত্র, ধর্ম কোনও দিন বিসর্জন দেব না। যুধিষ্ঠিরের শেষসঙ্গী ছিল একটা কুকুর। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘সবাই আমায় ছেড়ে চলে গেছে। তাদের প্রত্যেকের মনে অহংকার ছিল। কেউ ভাবত আমার থেকে বড় সুন্দরী নেই। কেউ ভাবত আমার থেকে বড় বীর বা তিরন্দাজ নেই। কিন্তু এ আমায় ছাড়েনি। এই কুকুরটা হচ্ছে ধর্ম।’
আমিও ইমানদার। কাফের নই। এটা আমার ধর্ম। ধর্মযুদ্ধে কৌরবপক্ষে পিতামহ ভীষ্ম ছিলেন। ছিলেন দ্রোণাচার্য। তবু জয় হয়েছিল পাণ্ডবদের। কারণ ধর্ম পাণ্ডবদের সঙ্গে ছিল। তাঁদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছিল। ‘লঙ্কেশ্বর স্বামী মোর , আমি কি ডরাই সখী, ভিখারি রাঘবে?’ রাবণ ছিলেন মহাবীর। তারপরেও রাবণের পরাজয় হয়েছিল। কারণ, অন্যায়টা রাবণের ছিল, তিনি পরস্ত্রী হরণ করেছিলেন।
জানি, অনেকে প্রশ্ন করবেন, তাহলে বিভীষণ কী করে আপনার আইকন হলেন? হ্যাঁ, আমাকে একটা জিনিস দেখতে হবে। আমি ছোটবেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম, ক্লাস এইট কী নাইনে, স্টোরিটার মধ্যে ছিল, বিচারক যদি সব বিচার তলিয়ে দেখতেন, বহু ক্ষেত্রেই পাপীকে শাস্তি দেওয়া যেত না। কারণ পাপটা সে করেছে আলটিমেটলি হয়তো পুণ্য করার জন্য। একটা পুণ্য করার জন্য একটা পাপ, একটা প্রায়শ্চিত্ত, একটা বেইমানির পাপ। দু’টোর মধ্যে তফাত আছে। তাই রাম যেখানে গিয়েছিলেন, সেটা বালি, সুগ্রীব হোক বা বিভীষণ, যেখানে যেখানে যাঁরা তাঁদের এই ধর্মযুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন, প্রত্যেককে তাঁদের রাজত্বে বসিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। ‘বিশ্বাস করো তোমরা, আমি রাজা হতে চাই না। আমি নিজের রাজত্ব আমার ভাইয়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।’ আর তার জন্যই আমরা এই স্লোগান দিই, ‘দেখো দুনিয়াওয়ালো, তুম ইয়ে কাম না করো, রাম কা নাম বদনাম না করো। রাম কো সমঝো, কৃষ্ণ কো জানো, নিন্দ সে জাগো, ও মস্তানো’।
‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ’। তাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আমি যেন কোনও অবস্থাতেই ভয় না পাই। ভয়ানক দুর্যোগ আসুক। ঘোর জঙ্গলের মধ্যে সবাই ফেলে চলে যাবে, তবু আমি যেন নবকুমার হয়ে উঠতে পারি। গভীর অরণ্যে কাঠ আনতে যাব। সবাই চলে যাবে, বলবে বাঘের পেটে গেছে! আমি শ্রীকান্ত হয়ে বাঁচতে চাই। আমি নবকুমারের চরিত্র ভালোবাসি। আর তাই জন্যই আমার শেষ লাইন ‘তুমি অধম—তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?’
আর যারা নবকুমারের মতো ঝুঁকি নিতে পারে, তারাই শুনতে পায় সেই আওয়াজ—পথিক, তুমি কি পথ হারিয়েছ? এস, আমার সঙ্গে। আমি তোমায় পথের সন্ধান দিচ্ছি। আর এই ইমানদারের যে পথের সন্ধান দেবে, সে হচ্ছে, ‘শোনো হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।