বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যার বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের থেকে এমন একটা বাজেট বক্তৃতা কেউ সেদিন আশা করেননি। সত্যি বলতে সাধারণ ক’জন মানুষ সেদিন চিনতেন তাঁকে? ওই দিনের পর চিনেছিল সবাই... নড়েচড়ে বসেছিল তামাম দুনিয়ার অর্থনৈতিক মহল। কারণ, দরজা খুলছিল ভারতের... গোটা বিশ্বের সামনে। বাজারের দরজা... বিনিয়োগের দরজা। কিন্তু মনমোহন সিং সেদিন বলেছিলেন, ‘সামাজিক সুরক্ষা, ন্যায় আমাদের দেশের ঐতিহ্য, পরম্পরা, প্রতিশ্রুতি... এর উপর কোনও দিন আঁচ আসতে দেব না। অর্থনৈতিক যে পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন, দিনের শেষে তার সবটাই দেশের আম জনতার জন্য... এটা আমি ভুলতে পারি না। ভুলব না।’ ১৯৯১ সাল... প্রতিবন্ধকতার খাদের কিনারে পৌঁছে গিয়েছিল দেশের অর্থনীতি। রাজস্ব আদায়ে সঙ্কট, আর্থিক বৃদ্ধি ধাক্কা খাচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারও তলানিতে। মনমোহন কথা রেখেছিলেন। অর্থনীতি উদার হয়েছিল, কিন্তু সাধারণ ভারতবাসীর স্বার্থ, সামাজিক নিরাপত্তাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। ভারতের অর্থনীতির মজবুত ভিত্তিপ্রস্তর সেদিন স্থাপন করেছিলেন মনমোহন সিং। যার উপর দাঁড়িয়ে এখনও চলছে সংস্কারের আস্ফালন!
মনমোহন সিং দেখিয়েছিলেন, বিনিয়োগ স্বাগত... কিন্তু দেশ বেচে দিয়ে নয়। প্রধানমন্ত্রিত্বের ১০ বছরেও সেটা বারবার প্রমাণ করেছেন তিনি। হাওয়া বদলেছে। এখন কর্পোরেট জমানা। কামাইয়ের উপর দাঁড়িয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। লকডাউন এবং আনলক পর্বের হিসেব কষতে বসলে সাধারণ মানুষের অ্যাকাউন্টে একগুচ্ছ উদ্বেগ, আর সব হারানোর যন্ত্রণা ছাড়া প্রায় কিছুই জোটেনি। চাকরি গিয়েছে, ছোট ছোট বহু ব্যবসা বন্ধ, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে মূল্যবৃদ্ধি। যে পেট একবেলা খেতে পেত, তার সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে অপরিকল্পিত লকডাউন। এর দায় কে নেবে? কেন, রাজ্য সরকার! রিজার্ভ ব্যাঙ্কই তো সম্প্রতি বলেছে, মূল্যবৃদ্ধির দায় রাজ্য সরকারগুলি এড়াতে পারে না। ওদের ট্যাক্স কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া উচিত। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা যাই থাক না কেন, তার সাত খুন মাপ। রাজ্যগুলি তাদের দায়িত্ব পালন করেনি, এখনও করছে না। ঠিকই তো! লকডাউন পর্বে যখন অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে হুইলচেয়ারে বসেছিল, তখন তো রাজ্য কিছুই করেনি! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আনলক পর্বের প্রথম দিন থেকে যেভাবে গ্রামীণ অর্থনীতির উপর জোর দিয়েছিলেন, তা আর এমন কী! ১০০ দিনের কাজের উপর জোর দিলে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ হবে। পাশাপাশি মানুষের হাতেও টাকা পৌঁছবে। এটাই ছিল তাঁর প্রাথমিক ভাবনা। এবং সফল ভাবনা। সেটাই করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য সব রাজ্য যখন এক পা এগলে করোনা আতঙ্কে দু’পা পিছিয়ে যাচ্ছে, তখন একের পর এক সেক্টর ধীরে ধীরে খুলে দিয়েছিলেন তিনি। যতজন কর্মী উপস্থিত না থাকলেই নয়, ততটুকুরই অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু অর্থনীতিকে অপদার্থের মতো ঘরে বসিয়ে রাখেননি। সরকারি লেকচার মানলে, সেটাও তাহলে কিছুই নয়! এই ইস্যুতে তর্ক হওয়া উচিত। এখনই। কারণ, সামনে ভোট। বিজ্ঞ কিছু লোকজন মনে করতেই পারেন, ভোটের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী? সম্পর্ক আছে... ‘ফুল কানেকশন হ্যায় বাবা’! মানুষ ভোট কী দেখে দেবে? উপায় দু’টি—কাজ অথবা প্রতিশ্রুতি। আসন্ন বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের প্রধান বিরোধী বিজেপি। অতিবৃদ্ধ বামেদের অকর্মণ্যতা, কংগ্রেসের গা ছাড়া ভাব এবং গেরুয়া শিবিরকে আচমকাই বেশি নম্বর দিতে শুরু করা তৃণমূল... এই তিনের মিশেলে বিজেপি বাংলার প্রধান বিরোধী আসনে জাঁকিয়ে বসেছে। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সরকারে এলে এই করব, ওই করব। কিন্তু বাংলার এই ভোটে সত্যিই কি প্রতিশ্রুতি কোনও কাজে লাগবে? মানুষ যা বিচার করার করবে কাজের নিরিখে। তৃণমূলের কাজ মানুষ রাজ্যে দেখেছে, আর বিজেপিকে কেন্দ্রে। বিচার হবে তুল্যমূল্য। বিজেপির দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা এই সহজ সত্যটাই ধরতে পারছেন না। গত লোকসভা ভোট ছিল দিল্লি দখলের লড়াই। শুধু বাংলার ১৮টি আসন কেন, গোটা দেশ নরেন্দ্র মোদির উপর ভরসা রেখেছিল। তারপরও দু’বছর হতে চলল... হাতে রইল কী? এবার সময় এসেছে তার হিসেব কষার। নোট বাতিল, জিএসটির অভিঘাত, কৃষি আইন... এই সবই না হয় মেগা ব্যাপার-স্যাপার। একটু হাতড়ালে দেখা যাবে, সাধারণ মানুষের হাতে টাকার জোগান কমেছে... ধীরে ধীরে, স্লো পয়জনিংয়ের মতো। মধ্যবিত্ত আজ ভাবতে বসেছে, তার স্টেটাসটা ঠিক কোথায়? নিম্ন মধ্যবিত্ত... নাকি নিম্নবিত্ত? উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই আরও বেশ কয়েকটা প্রাণ আত্মহত্যার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। আরও কয়েকজন বেকার খিদের জ্বালা জুড়োতে না পেরে চুরি-ডাকাতির মতো পেশায় নাম লেখাবে। আর উচ্চবিত্তের সম্পদ বাড়বে। ভবিষ্যৎ কাল নয়, এই সবই বর্তমানের আঙিনায় ঢুকে পড়েছে। মানুষ এখন কি সত্যি আর ‘আচ্ছে দিনের’ স্বপ্ন দেখে? বোধহয় না। অন্তত সাম্প্রতিক বাজেটের পর তো তেমন স্বপ্ন আরও আসছে না। কর কাঠামোয় সুবিধা নেই, দেখা যাচ্ছে না মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের লক্ষণও। উপরন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রির জিগির মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়া তো ছিলই, ভারত পেট্রলিয়াম, শিপিং কর্পোরেশন, আইডিবিআই ব্যাঙ্ক, কন্টেইনার কর্পোরেশন, নীলাচল ইস্পাত নিগম... এই সবই বিক্রির তালিকায় চলে এসেছে। পাশাপাশি সরকারি বিমা সংস্থায় বিদেশি বিনিয়োগের ছাড়পত্র ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। লাইফ ইনস্যুরেন্স কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া এখনও প্রত্যেক ভারতীয়ের আস্থার জায়গা। ৫ হাজার টাকা মাসিক উপার্জন হলেও একজন নিম্নবিত্ত চেষ্টা করেন, একটা অন্তত এলআইসি করার। কিছু তো জমবে! আর এই টাকা মার যাবে না। এটাই বিশ্বাস। এবার সেই বিশ্বাসেও আঘাত আসছে। বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলি ভারতের বাজারে শত চেষ্টা সত্ত্বেও এত বছর খাপ খুলতে পারেনি শুধু এলআইসির জন্য। এবার সেই মার্কেট খুলে যাবে। আর সংস্কার নামক জুতোর তলায় দুরমুশ মানুষের ভরসা, নিরাপত্তা।
মোদি সরকার বলবে, কেন বাজারে যে পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য ৫ লক্ষ ৫৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে! তার বেলা? এর মধ্যে গ্রামীণ অর্থনীতি এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য দেওয়া হচ্ছে ২ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা। যা কি না পঞ্চায়েতের মাধ্যমে খরচ করা হবে। কিন্তু এই টাকা কোথা থেকে আসবে? মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করে। আর কর্পোরেট কিছু সংস্থাকে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির খেলায়। পরিকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিতভাবে এই মুহূর্তে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে বাঁচানোর প্রথম উপায়। কিন্তু তার জন্য দেশ না বেচলেও তো চলে! মনমোহন সিং দেশ বেচে দেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু পরিকাঠামো উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করে ফেলেছেন। তাঁর বাজেটের ফোকাস দু’টি—প্রথমত, রাস্তা-ঘাট, স্কুল, উড়ালপুল সহ পরিকাঠামো উন্নয়ন। এবং দ্বিতীয়ত, স্বনির্ভর প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়া। এতে বাংলার অর্থনীতির কী লাভ হবে? ১) পরিকাঠামো উন্নয়নে প্রচুর সংখ্যক কর্মসংস্থান। তাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে অর্থের জোগান প্রচুর পরিমাণে বাড়বে। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ যেহেতু ইট এবং সিমেন্ট উৎপাদনে দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে, তার ফলে নির্মাণ সেক্টরও মুনাফার মুখ দেখবে। তার প্রভাব সরাসরি পড়বে বাজারে। অর্থের জোগান হলে কেনাকাটা বাড়বে। বাজারে ভোগ্যপণ্য বা পরিষেবার চাহিদা তৈরি হবে। সেই মতো বাড়বে সরবরাহ। আনলক পর্বেও কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার জিএসটি সংগ্রহে বিপুল সহযোগিতা করেছে। ভোগ্যপণ্য, ফার্মা এবং হোসিয়ারি... এই তিনটি ক্ষেত্র থেকে গত কয়েক মাসে সবচেয়ে বেশি জিএসটি আদায় হয়েছে। যা সমৃদ্ধ করেছে কেন্দ্রের কোষাগারকেও। শুধু ভাঁওতা দিয়ে সরকার চলে না, দেশ চলে না। মনমোহন সিং তা বুঝিয়েছিলেন। গত ১০ বছরে বুঝিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তারপরও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হলদিয়ায় এসে দাবি করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জমানায় কোনও উন্নয়নই করেননি! তাঁর তাঁবেদাররাও এই প্রচারে তালি বাজাচ্ছে। কিন্তু মানুষ কী ভাবছে? তাঁর ঘরে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী আছে, সবুজ সাথীর সাইকেল আছে, তাঁর জেলায় সবচেয়ে বেশি জব কার্ড আছে, যুগ যুগের হা-পিত্যেশের পর বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ, পানীয় জলও আছে! আর আছে কর্মসংস্থানের দিশা। যা ফাঁপা নয়।
বিচারক তাঁরাই। নাম তাঁদের ভোটার। কী পেয়েছেন, তার হিসেব তাঁরাই করবেন। নরেন্দ্র মোদির দাবি, বাংলা এবার তৃণমূলকে ‘লাল কার্ড’ দেখাবে। বাংলা ফুটবল বোঝে। বাঙালি জানে, ফাউল যে করে, লাল কার্ড তারই প্রাপ্য! তাহলে ফাউল কে করছে? উন্নয়ন না ভাঁওতা? উত্তর মিলবে ভোটযন্ত্রে।