বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যার বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
অজিতবাবু রাজনীতির মানুষ হলেও তাঁর স্ত্রী ঊর্মিলাদেবী সাতে পাঁচে থাকতেন না। স্বামী, সন্তানই ছিল তাঁর জীবন। স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর তিনি নাবালক ছেলেকে আঁকড়ে ধরেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, পারলেন না। স্বামী খুনের মূল অভিযুক্ত বিজেপিতে যোগ দিতেই তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার। গৃহকোণ ছেড়ে রাজনীতির আঙিনায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে উগরে দিয়েছেন ক্ষোভ। ঊর্মিলাদেবী বলেন, ‘আমার স্বামীকে যারা খুন করেছে, বিজেপি তাদেরই বরণ করে নিচ্ছে। বিজেপির নেতাদের কাছে জানতে চাই, কেন এমনটা হচ্ছে? আমার স্বামীর খুনিকে শাস্তি না দিয়ে কেন দলে জায়গা দেওয়া হল? আমার দুঃখের কথা মানুষকে জানানোর জন্যই রাস্তায় নেমেছি।’
বিজেপির মণ্ডল সভাপতির পদে থেকেও নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন অভিজিৎবাবু। দলীয় অনুশাসন কথাটা তাঁর কাছে আজ বড় অসহ্য। প্রতিনিয়ত বিবেকের দংশনে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে সমাজ বদলের স্বপ্ন। অভিজিৎবাবুর কথায়, ‘এরপর আমরা বিজেপি করি, সেটা মানুষকে বলতে পারব না। ভোট চাওয়া তো অনেক দূরের কথা। এই ঘটনায় আদিবাসীরা মুখ ফিরিয়ে নিলে রানিবাঁধে বিজেপির পতাকা বওয়ার লোক পাওয়া যাবে না। কথাটা বলতে খুব খারাপ লাগছে, তাও বললাম। কারণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরের পর বছর বিজেপির ঝান্ডা নিয়ে মাঠেঘাটে ঘুরেছি। স্রেফ আদর্শের টানে। কিন্তু, সেই আদর্শটাই কোথায় যেন হারিয়ে গেল! দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছি না। তাই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছি।’
২০১৮ সালের ২৩ মে শান্তিপুরের মেলের মাঠে খুন হয়েছিলেন বিপ্লব সিকদার। বিপ্লববাবু বিজেপি করতেন। পঞ্চায়েত ভোটের দিন মেলের মাঠের বুথে ছাপ্পা ভোট রুখে দিয়েছিলেন। ‘পরিণতি ভালো হবে না’ বলে শাসিয়ে ছিল দুষ্কৃতীরা। তারপর গভীর রাতে বাড়িতে ঢুকে বিপ্লববাবুকে খুন করেছিল। বুথ দখলে বাধা দেওয়ার প্রতিশোধ নিয়েছিল দুষ্কৃতীরা।
বিপ্লববাবুর স্ত্রী শঙ্করীদেবীর অভিযোগপত্রে স্থানীয় বিধায়ক অরিন্দম ভট্টাচার্যের নাম ছিল। সেই অরিন্দমবাবু এখন বিজেপিতে। দিল্লিতে গিয়ে নেতাদের হাত থেকে নিয়েছেন বিজেপির পতাকা। গলায় পরেছেন গেরুয়া উত্তরীয়। তাঁর যোগদানের খবর পেয়েই বিপ্লববাবুর ছেলে সুফল একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন।পিতৃহারা সন্তানের আবেগঘন পোস্ট রাজনীতিতে রীতিমতো ঝড় তুলেছে। সুফলের অভিযোগ ছিল, বিধায়কের নির্দেশে তাঁর বাবাকে খুন করা হয়েছে। তিনি বিজেপির সাংসদ জগন্নাথ সরকারের দিকে আঙুল তুলে বলেছেন, একদিন থানার সামনে মাইকে চিৎকার করে আপনিই শান্তিপুরের বিধায়কের শাস্তি চেয়েছিলেন। আপনি এখন এমপি।
প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী। মনে রাখবেন, আমাদের ভোটেই আপনি এমপি হয়েছেন। আমরা আপনাদের তুলতে পারি, আবার নামাতেও পারি। আমার বাবা সততার রাজনীতি করতেন। দয়া করে রাজনীতিকে নোংরা করবেন না। শান্তিপুরে বিজেপি এমনিতেই জিতত। বিধায়ককে দলে নেওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না। তবে, অরিন্দম ভট্টাচার্যকে দলে নেওয়ায় কেউ যাতে বিজেপিকে ভোট না দেয়, তার জন্য আমি প্রচার করব...।
সুফলের সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। মোবাইলে মোবাইলে ঘুরছে পিতৃহারা সন্তানের কাতর আবেদন। তাঁর ভিডিওটি দেখে অনেকেই চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। কিন্তু, সম্বিত ফেরেনি বিজেপি নেতাদের। অরিন্দমবাবুকে বিজেপিতে নিয়ে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সুফলের চেয়েও দলবদলু নেতাদের গুরুত্ব তাঁদের কাছে অনেক বেশি।
এই ঘটনায় সুফল চরম হতাশ। তিনি বলেন, ‘আমি ঠিক করেছি, আর রাজনীতির সাতে পাঁচে থাকব না। সাধারণ আমজনতা হয়ে থাকতে চাই। ভোটে কে দাঁড়াল, কে জিতল, তাতে আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না। আমি শুধু আমার বাবার খুনিদের শাস্তি চাই। যে দল বাবার খুনিদের শাস্তির ব্যবস্থা করবে, আমরা সেই দলের পাশে থাকব। মানুষও তাদের আশীর্বাদ করবে।’
নদীয়া জেলার(দক্ষিণ) সাংগঠনিক সভাপতি অশোক চক্রবর্তীর কথায়, ‘কোনও পাপী যদি এসে বিজেপির গঙ্গায় ডুব দিয়ে পাপমুক্ত হতে চায়, আমাদের কী বলার আছে? কারণ দস্যু রত্নাকরও বাল্মীকি হয়েছিলেন।’ অশোকবাবুর কথাতেই স্পষ্ট, বিজেপিতে ‘দস্যু’দের ভিড় বাড়ছে। তবে তাঁরা বাল্মীকি হবেন নাকি রত্নাকরই থেকে যাবেন, সেটা বলবে সময়।
শুধু রানিবাঁধ বা শান্তিপুরেই নয়, পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলায় এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। পার্টির নেতারা ক্ষমতা দখলের মোহে শীর্ষ নেতৃত্বের সেই নির্দেশ মেনে নিলেও সাধারণ কর্মী সমর্থকরা মানতে চাইছেন না। কেউ কেউ প্রতিবাদ জানাতে কেশব ভবন পর্যন্ত ছুটছেন। কিন্তু তাতে কাজ হবে কি না বলা কঠিন। কারণ বিজেপির কাছে জনতার চেয়েও অন্য দলের নেতারা ক্রমশই মূল্যবান হয়ে উঠছেন।
তৃণমূলের ‘কদরহীন’ নেতারাই বিজেপির কাছে আজ অতীব মহার্ঘ। কারণ বিজেপি নেতৃত্ব বুঝেছে, তৃণমূলকে ভাঙতে না পারলে তাদের ‘মিশন-২০২১’ এর হাল চন্দ্রযান-২ এর মতোই হবে। মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই তৃণমূল নেতাদের বিজেপিতে নেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের তর সইছে না। পাঠিয়ে দিচ্ছেন আস্ত চাটার্ড প্লেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেন দিতে না পারলেও, নেতা ধরার জন্য চাটার্ড প্লেনের তাঁদের অভাব নেই। তৃণমূলের ‘উপেক্ষিত’ নেতাদের ‘সম্মানিত’ করার এটাই সর্বোত্তম রাস্তা। গুজরাতের ‘বেওসায়ি’ পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা বিজেপির নেতারা সেটা খুব খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন।
কথায় আছে, যত গর্জে তত বর্ষে না। বিজেপির অবস্থা এখন অনেকটা তেমনই। বিজেপির নেতারা বঙ্গ জয় নিয়ে যতই তর্জন গর্জন করুন, যতই ২০০ আসনের কথা বলুন, বাস্তবের মাটি বড়ই রুক্ষ। সেটা তাঁরাও জানেন। তাই দলবদলুদের বিজেপিতে নেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
তবে, দলবদলুদের নিয়ে লাভ হচ্ছে নাকি ক্ষতি, সেটা বিজেপির নেতারাও সম্ভবত ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তাই দলবদলুদের জন্য একবার ঝাঁপ বন্ধ করছেন, আবার তুলে নিচ্ছেন। দলবদলুদের নিয়ে বিজেপি নেতাদের বিভ্রান্তি স্পষ্ট।
কিন্তু বিজেপির মতো একটা রেজিমেন্টেড পার্টিতে এমনটা হচ্ছে কেন? অনেকে মনে করছেন, দিল্লির নেতারা বঙ্গ বিজেপির উপর ভরসা রাখতে পারছেন না। তাই নিত্যনতুন মুখের সন্ধান করছেন। তৃণমূলের কেউ দোদুল্যমান হলেই তাঁকে ধরার জন্য জাল ফেলছেন। কোনও একটা পদ থাকলেই হল। বিধায়ক বা সাংসদ। আর তা করতে গিয়ে তাঁরা এমন অনেককে দলে নিচ্ছেন যাঁদের অনুগামী দূরের কথা, পরিবারের ভোটটাও বিজেপির জন্য নিশ্চিত নয়। কারণ তাঁদের পদের ওজনের চেয়েও বদনামের বোঝা অনেক ভারী। সেই সব নেতা বিজেপিতে যাওয়ায় তৃণমূলের ক্ষতি তো হয়ইনি, উল্টে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।
মূলত ওই সব নেতাকে ঘিরেই বিজেপির নিচুতলায় তীব্র ক্ষোভ। তবুও নেতৃত্ব বেপরোয়া। কারণ বঙ্গে বিজেপির হয়ে হাওয়া তোলার জন্য তাঁদের মুখ দরকার। ঝকঝকে মুখ। সঙ্গে ঝাঁঝালো ভাষণ। দলবদলুদের সৌজন্যে বিজেপিতে তেমন মুখের এখন রমরমা। সেই সব ঝকঝকে মুখের পাশে অজিত মুর্মুর বিধবা স্ত্রীর, বিপ্লব সিকদারের ছেলের মুখ
আজ বড়ই বেমানান। তাই তাঁরা সরে যাচ্ছেন। দূরে, অনেক দূরে। কারণ তাঁরাও বুঝেছেন, বিজেপির কাছে শহিদ পরিবারের চেয়েও ঝকঝকে, তকতকে নেতাদের কদর বেশি। তবে, এখানে একটা ছোট্ট বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: নেতা ধরতে গিয়ে জনতা না ফস্কে যায়!