বিতর্ক-বিবাদ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেম-পরিণয়ে মানসিক স্থিরতা নষ্ট। নানা উপায়ে অর্থোপার্জনের সুযোগ।প্রতিকার: অন্ধ ব্যক্তিকে সাদা ... বিশদ
বেঁচে থাকলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তিনি বলতেই পারতেন, আপনি চা-ওয়ালা, তো আমি দুধওয়ালা। কিন্তু নিজের স্ট্রাগলকে প্রচারের মাধ্যম করেননি রাজেশ। প্রিয় বন্ধু রাজীব গান্ধীর এক অনুরোধে বায়ুসেনা থেকে অবসর নিয়ে নেমে পড়েছিলেন রাজনীতিতে। ভোটে জিতেছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়ে চন্দ্রস্বামীকে জেলবন্দিও করেছেন। পলিটিক্যাল মিসঅ্যাডভেঞ্চার তাঁর একটিই—অশীতিপর সীতারাম কেশরিকে কংগ্রেস সভাপতির পদে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া। পারেননি রাজেশ। সীতারাম আগেই দলের ভোট ‘ম্যানেজ’ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাও দলে তাঁর গুরুত্ব হারায়নি... কারণ, তিনি দলকে, বা কংগ্রেস তাঁকে ছেড়ে যায়নি। সভাপতির পদে রাজেশ পাইলটের লড়াইটা শুধু ক্ষমতার ছিল না, তার সঙ্গে জড়িয়েছিল কিছু আদর্শ এবং গান্ধী পরিবারের প্রতি তাঁর আনুগত্য। রাজেশ পাইলটের মৃত্যুর পর ২০ বছর কেটে গিয়েছে। এবার আর আদর্শ নয়, লড়াইটা পুরোপুরি ক্ষমতা দখলের।
ক্ষমতার নেশাটা ভয়াবহ। যার আছে, সে আরও বেশি দেখাতে চায়। আর যার নেই, সে তাক কষে কবে সেই চেয়ারে বসবে। অশোক গেহলট পুরোদস্তুর সোনিয়া গান্ধী পন্থী। কমল নাথও তাই। কিংবা আহমেদ প্যাটেল। সোনিয়ার কোর গ্রুপে দীর্ঘদিন এঁদের বসবাস। কাজেই জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার বদলে কমল নাথ, কিংবা শচীন পাইলটের পরিবর্তে যখন অশোক গেহলট মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন, তাতে খানিক গোঁসা হতে পারে। কিন্তু বিস্ময়ের কিছু নেই। শচীন পাইলট তাঁর বাবার মতো স্ট্রাগল দেখেননি। বা তাঁকে সেই পথে হাঁটতেও হয়নি। রাজস্থানে যখন কংগ্রেস হইহই করে জিতল, তিনি ভাবলেন ‘সবটাই আমার কৃতিত্ব’। কিছু অবদান যে তাঁর রয়েছে, সে ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই। দলের ‘ভবিষ্যতের মুখ’ শচীন। রাহুল ব্রিগেডের তরুণ তুর্কি হিসেবে তাঁর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাও উজ্জ্বল ছিল। কিন্তু ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানের অঙ্ক কষেছিলেন শচীন পাইলট। যার ফলস্বরূপ তাঁর আমও গিয়েছে, ছালাও। অর্থাৎ উপ মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে তাঁকে সরানো তো হলই, চলে গেল প্রদেশ সভাপতির পদটাও। বিদ্রোহ করার আগে শচীন একবারও ভাবলেন না, তাঁর সঙ্গে রয়েছে বলতে মাত্র ১৮ জন বিধায়ক। বাড়তি দাবি ছিল, আরও ৩০ জন এমএলএ গেহলট শিবির ছেড়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে তৈরি। কিন্তু এই সংখ্যাতত্ত্বের দাবি আদৌ কি তাঁকে লাভের দিশা দেখাবে? অর্থাৎ বিষয়টা পরিষ্কার, শচীন পাইলট যতই বিদ্রোহ দেখান না কেন, অশোক গেহলট সরকারকে ফেলা যাবে না। ২০০টি বিধানসভা আসনের রাজস্থানে ম্যাজিক ফিগার ১০১। যদি ১৯ জন বিধায়ক বহিষ্কৃত হন, তাহলে মোট সংখ্যা নেমে আসবে ১৮১তে। সেক্ষেত্রে ম্যাজিক ফিগার হবে ৯১। আর গেহলটের দাবি অনুযায়ী, নির্দল, সিপিএম এবং ভারতীয় ট্রাইবাল পার্টির সমর্থন নিয়ে তাঁর পাশে রয়েছেন ১০৯ জন বিধায়ক। চলতি সপ্তাহে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে ছবিটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। অথচ, সম্ভাবনা তো কম ছিল না শচীনের! রাজস্থানে জাতপাতের ভোটব্যাঙ্ক নির্ণায়ক ফ্যাক্টর হিসেবে প্রত্যেক নির্বাচনেই কাজ করে। তিনি নিজে গুজ্জর। অর্থাৎ রাজ্যের ৩০ শতাংশেরও বেশি ভোট তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েই ইভিএমের বোতাম নির্বাচন করে। তার উপর শচীনের শিক্ষাগত যোগ্যতা। পিছড়ে বর্গের সঙ্গে মিশেলে যা শচীন পাইলটের রাজনৈতিক চরিত্রকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, সবটাই কিন্তু কংগ্রেস নামক শতাব্দীপ্রাচীন একটি দলের ছাতার তলায়। জার্সি খুলে নিলে কী হবে বলা মুশকিল। এখনও পর্যন্ত সমীকরণ যা রয়েছে, শচীন পাইলট একটি অসম লড়াইয়ে নেমেছেন। বা বলা ভালো, মিসঅ্যাডভেঞ্চার। রাজস্থানে কংগ্রেস যদি পরেরবারও ক্ষমতায় ফিরে আসে, তাহলে শচীন পাইলটই কিন্তু মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রধান দাবিদার হতেন। বৃদ্ধ অশোক গেহলট নন। তাহলে এই তাড়াহুড়ো কেন? হয়তো ভেবেছিলেন, কংগ্রেস এখন ধুঁকতে থাকা পার্টি। চাপ দিয়ে যেমন খুশি প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেওয়া যাবে। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে তিনি নাকি ফোনেও বলেছিলেন, ‘দল যদি ঘোষণা করে আগামী এক বছরের মধ্যে আমাকে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী করা হবে, তাহলে সোনিয়াজি এবং রাহুল গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতে যাব। না হলে নয়।’ তেমন কোনও ঘোষণা হয়নি। আর প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে ফোনালাপের ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে উপ মুখ্যমন্ত্রীর পদটাও চলে গিয়েছিল তাঁর। কংগ্রেসের এই দুঃসময়েও...।
রাহুল গান্ধী দায়িত্ব নেওয়ার পর লোকজন আশা করেছিল, এবার দলটা উঠে দাঁড়াবে। তা তো হয়ইনি, বরং রাহুল নিজেই দায়িত্বের জুতো ছেড়ে গা বাঁচিয়ে বসে পড়েছেন। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে এক সময় মনে হয়েছিল, তিনি হয়তো নেতৃত্বের অটোম্যাটিক চয়েজ। গত লোকসভা ভোটের পর সেই ধারণা এক অলীক, কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলে মনে হচ্ছে। তাহলে রইল কে? অসুস্থ সোনিয়া গান্ধী। এবং তিনিই যে এখনও কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানোর সেরা বাজি, সেটা আরও একবার প্রমাণ করলেন তিনি। শচীন এপিসোডে। ক্ষমতায় থাকলে বা পায়ের তলার জমি শক্ত হলে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়াই যায়। কিন্তু পরিস্থিতির চাকা যদি সম্পূর্ণ উল্টোপথে ঘোরে? কঠিন পদক্ষেপ তখন আর খুব সহজ হয় না! সোনিয়া সেটাও করে দেখালেন। শচীন পাইলটকে পদচ্যুত করা, অবস্থানে অনড় থাকা এবং প্রয়োজনে আস্থা ভোটে যাওয়ার মতো সাহস দেখানো।
প্রাথমিকভাবে মনে হতেই পারে, ভুল কাজ করলেন তিনি। তরুণ প্রজন্মকে তুলে আনার মোক্ষম সময়ে সম্ভাবনাময় নেতাদের একে একে ছেঁটে ফেলছেন। সোনিয়া গান্ধী তো আর আদি অনন্তকাল কংগ্রেসের কাণ্ডারী হয়ে বসে থাকবেন না! তাঁর ছেলেমেয়েরও সেই ‘যোগ্যতা’ তৈরি হয়নি। এমন একটা পরিস্থিতিতে দল চলবে কীভাবে? সোনিয়া গান্ধী মনে করেন, দল চলবে নিজের ভারে।
প্রতিষ্ঠান বড়। ব্যক্তি নয়। কাজেই বিদ্রোহ মেনে নেওয়া যাবে না। ‘ডাউন দ্য লাইন’ তৈরি করতে হবে ঠিকই, কিন্তু দলের সম্মান বা আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। এই সিদ্ধান্তে দলের একটা অংশের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হতেই পারে। কিন্তু সেটা সাময়িক। ‘চক্রবৎ পরিবর্তন্তে’... এক নেতা যাবে, অন্য কেউ সেই জায়গার দখল নেবে। কোনও স্থানই শূন্য থাকে না। কোনও ব্যক্তি অপরিহার্যও হয় না। থেকে যায় প্রতিষ্ঠান। দল। কঠিন সময়েও সোনিয়া গান্ধী যে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা তৃণমূল স্তরে কিন্তু মনোবল বাড়াবে... আমরা এখনও পারি। কংগ্রেসের লেগাসি শুধু কয়েকটা লোকসভা আসন বা বিধানসভা ভোটের জয়ে সীমাবদ্ধ নয়। ভবিষ্যতে এই সিদ্ধান্তই কংগ্রেসকে ডিভিডেন্ড দেবে।
শচীন পাইলট বিজেপিতে যাবেন না। এই মুহূর্তে তো নয়ই। বিধানসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রিত্বের গ্যারান্টি পেলে আলাদা কথা। কী করতে পারেন তিনি? আলাদা দল গড়তে পারেন। অপেক্ষা করতে পারেন সঠিক সময়ের জন্য। কিংবা মাথা নিচু করে কংগ্রেসের আশ্রয়েই পারেন শূন্য থেকে আবার সব শুরু করতে। ক্ষমতা এক বিষম বস্তু। এর পিছন পিছন দৌড়তে হয় না। অর্জন করতে হয়। যোগ্যতা, দায়বদ্ধতা থাকলে ক্ষমতাই দাঁড়িয়ে থাকবে
বরণডালা নিয়ে। এক্ষেত্রেও বয়সটা কিন্তু ফ্যাক্টর। কর্মক্ষমতা এবং যোগ্যতার সঙ্গে পরিণতিবোধ... বয়সের সঙ্গে যা ধীরে ধীরে পোক্ত করে ব্যক্তিত্বকে। সীতারাম কেশরির কাছে দলনেতৃত্ব দখলের যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন রাজেশ পাইলট। সীতারাম তখন বলেছিলেন, ‘গরম রক্ত... ঠিক হয়ে যাবে।’ শচীন পাইলট যেন ওই আপ্তবাক্যটি মেনে চলেন। না হলে তাঁর এই বিদ্রোহ কিন্তু ‘রাজনৈতিক আত্মহত্যা’ হয়েই ইতিহাসে লেখা থেকে যাবে।