বিতর্ক-বিবাদ এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। প্রেম-পরিণয়ে মানসিক স্থিরতা নষ্ট। নানা উপায়ে অর্থোপার্জনের সুযোগ।প্রতিকার: অন্ধ ব্যক্তিকে সাদা ... বিশদ
ব্যাপারটা এখন পরিষ্কার যে গত জানুয়ারিতে মিস্টার জি একটা নতুন ট্রেনিং মবিলাইজেশন অর্ডারে (টিএমও) (সূত্র: দ্য হিন্দু, ১৩ জুলাই, ২০২০) সই করেছিলেন। এবং, ওই আদেশ অনুসারেই চীনা লালফৌজ (পিএলএ) ভারত-চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর চীনের দিকে সেনা মোতায়েনের প্ল্যান করে। আর সেই প্ল্যান মাফিক সেনাদের প্রস্তুত করে এবং বাহিনী সেখানে পাঠিয়ে দেয়। এরপর ১৫ জুলাই, ২০২০ তারিখে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত একটা রিপোর্টের উল্লেখ করছি। ওই রিপোর্ট অনুসারে, এক গোয়েন্দা অফিসার জানিয়েছেন যে, চীনা বাহিনীর মুভমেন্টের প্রথম ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টটা পাওয়া গিয়েছিল ২০২০-র এপ্রিলের মাঝামাঝি।
যেসব প্রশ্নের উত্তর চাই
বেশকিছু প্রশ্ন উঠেছে:
১. চীনের নতুন টিএমও-র ব্যাপারে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক এবং সেনা সদর দপ্তর কি অবগত ছিল না?
২. এলএসি বরাবর চীনের ভিতরে সেনা বাহিনীকে প্রস্তুত করার ব্যাপারটা ভারতের আর্মি ইন্টেলিজেন্স এবং বিদেশ বিষয়ক গোয়েন্দা এজেন্সি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (আরঅ্যান্ডএডব্লু বা সংক্ষেপে 'র') কি টেরই পায়নি?
৩. এলএসি লাগোয়া গলওয়ান উপত্যকা এবং প্যানগং হ্রদের মাঝের দৈর্ঘ্য ২০০ কিলোমিটার। ওখানকার অনেকগুলো জায়গায় চীনা সেনা এবং তাদের গাড়ি চলাচলের ছবি আমাদের উপগ্রহগুলোর মাধ্যমে পাওয়া গেল না?
৪. এপ্রিলের মাঝামাঝির গোয়েন্দা রিপোর্টটা কি বিশ্লেষণ করে দেখা হয়নি? সেটা কি সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে শেয়ার করা হয়নি? তার ভিত্তিতে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি?
এসব প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই দিতে হবে। এখন নয়, যথাসময়ে দিতেই হবে।
উভয় দেশই এখন সেনা সরিয়ে (ডিসএনগেজেমন্ট) এবং উত্তেজনা প্রশমনের (ডি-এসকালেশন) পর্যায়ে রয়েছে। এটা সত্যিই ভালো এবং এই অবস্থানটাকে আমি সমর্থন করি। সীমান্ত সমস্যা যুদ্ধের মাধ্যমে কখনও মেটেনি। ভারত-চীন যুদ্ধ, টিভি অ্যাঙ্কর-জেনারেলদের প্রার্থনা সত্ত্বেও, কোনও পথ নয়। এটা খুশির ব্যাপার যে প্রধানমন্ত্রী সত্যটা মানছেন। কিন্তু এটা পরিষ্কার নয়—'যুদ্ধটা কোনও পথ নয়' এই মতে মিস্টার জি বিশ্বাসী কি না। এটাই সম্ভব যে পিএলএ মিস্টার জি-কে বুঝিয়েছে, ভারতকে একটা সীমিত যুদ্ধ-গোছের ধাক্কা দেওয়া দরকার। তাহলে লালফৌজের পক্ষে 'দু'কদম এগিয়ে গিয়ে এককদম পিছিয়ে আসা'র সুযোগ গ্রহণ সহজ হবে।
সাম্প্রতিক অতীতের পৃষ্ঠা থেকে দু'টো উদাহরণ দেব: ডেপসাং (২০১৩) এবং ডোকলাম (২০১৭)। ডেপসাংয়ে চীনাদের যে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল চীন তা পুরোপুরি খালি করে দিয়েছিল। কিন্তু ডোকলামে? প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) শিবশঙ্কর মেননের মতে, '২০১৭-তে দু'পক্ষ যে পয়েন্টে সম্মুখসমরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল (ফেস-অফ পয়েন্ট), আমাদের দু'তরফের সেনা প্রত্যাহারের আপস-মীমাংসার শুরুটা করেছিলাম সেই ডোকলাম থেকে। ফেস-অফ পয়েন্ট থেকে সরল বটে, অতঃপর ওই মালভূমি অঞ্চলে তাদের জবরদস্ত এবং স্থায়ী উপস্থিতি প্রমাণ করতে চীনারা মরিয়া হয়ে উঠল।'
শিবশঙ্কর মেনন ডোকলামের বিষয়ে নিজেই সরকারকে বললেন যে, 'সত্যি কথা বলতে কী, চীন এটা জেনে গেছে যে ভারত সরকার যদি তাদের প্রচারসর্বস্ব জয় (প্রোপাগান্ডা) নিয়ে মেতে থাকতে পারে, তবে চীন তার বাস্তব উদ্দেশ্যটা হাসিল করে ফেলবে।' সরকারের সঙ্গে সাক্ষাতের (১৩ জুলাই, ২০২০) ছ'দিন বাদে ডোকলামের বাস্তব পরিস্থিতিটা সরকার ব্যাখ্যা করল না। ডোকলাম মালভূমিতে চীনারা কি তাদের জবরদস্ত, স্থায়ী উপস্থিতির প্রমাণ দিয়েছিল? অসহায়তার কারণে ভুটান কি চীনাদের উপস্থিতি নিয়ে চুপ ছিল এবং ভুটানের তরফে ভারতও জোর গলায় কিছু বলবে না? এসমস্ত প্রশ্নের উত্তর যখন ছিল না তখন একটা অসত্য কথা প্রচার করে দেওয়া হয়েছিল যে, ডোকলাম থেকে চীনাদের ভারতই খেদিয়ে দিয়েছিল। অতএব, এটা মোদিজির তত্ত্বাবধানে একটা তাৎপর্যপূর্ণ 'জয়'!
কোথা থেকে কোথায়?
সম্প্রতি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর বহু জায়গায় সেনাদের যে মুখোমুখি অবস্থান (ফেস-অফ) ঘটেছিল সেটা হয় ডেপসাংয়ের পথে যেত অথবা যেত ডোকলামের পথে। পরের কথাগুলো পড়ার আগে, আপনাকে মনে রাখতে হবে যে এলএসি-র দু'টো 'পারসেপশন' বা 'ভার্সান' (এখানে 'মত' ধরে নেওয়া যেতে পার) আছে। একটা চাইনিজ পারসেপশন, অন্যটা হল ইন্ডিয়ান পারসেপশন। সোজা কথায়, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বলতে চীনারা একরকম বোঝে, ভারতীয়রা বোঝে অন্য-একরকম। মনের ভিতরে এই যে গুরুত্বপূর্ণ ফারাক, এটা দিয়েই ঘটনার বিচার করুন। কোনও সংশয় নেই যে, দু'পক্ষই সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কোথা থেকে প্রত্যাহার করে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
চীনের দিক থেকে শুরু করা যাক। যদি চীনা বাহিনী এলএসি অতিক্রম না করে থাকে (ওদের পারসেপশন অনুসারে) তবে মানেটা এইরকম দাঁড়াচ্ছে যে, তারা চীনা ভূখণ্ডের ভিতর থেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে চীনা ভূখণ্ডেরই ভিতরে কোথাও মোতায়েন করছে। তাদের তরফে ভূখণ্ড খোয়ানোর মতো কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু চীনা বাহিনী যদি এলএসি পেরিয়ে থাকে (ওদের পারসেপশন অনুসারে) তবে সত্যিই তারা অবৈধভাবে অধিকৃত ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে সরে যাচ্ছে।
ভারতের অবস্থান এই যে ভারতের পারসেপশন অনুসারে ভারতীয় সেনারা কখনওই এলএসি পেরয়নি—এমনকী এই জুনের ১৫-১৬ তারিখেও নয়। ভারতীয় ভূখণ্ডের ভিতরে চীনাদের স্ট্রাকচার নির্মাণে আপত্তি তুলেছিলেন কর্নেল সন্তোষ বাবু এবং তাঁর টিম। তাঁদের পদক্ষেপকে ভারত সমর্থন করেছিল। ৫ জুন দু'পক্ষের কমান্ডার স্তরের মিটিংয়ে সেগুলো সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সুতরাং নির্ভুল উপসংহারটা এই যে, ভারত তার নিজের ভূখণ্ড থেকে সেনা সরিয়ে নিজেরই ভূখণ্ডে রাখছে।
পূর্বস্থিতি কত দূরে?
কমন সেন্স বলে যে, দু'পক্ষের সেনাদের হালফিল অবস্থানের মাঝে একটা 'নো ট্রুপস ল্যান্ড' (যা, 'নো ম্যানস ল্যান্ড' কথাটির সমার্থক) তৈরি করা হবে। এটা সেই জায়গা, চীনা অথবা ভারতীয় মতে (পারসেপশন অনুসারে) যেখানে এলএসি-র অবস্থান। এই পরিসরটা সীমান্তে শান্তি ও সুস্থিতির পথ সুগম করতে পারে, কিন্তু এটা সীমান্ত সংক্রান্ত প্রশ্নের সমাধান করতে পারবে না। এটা পরিষ্কার যে, কোনও ধরনের একটা 'বাফার জোন' সৃষ্টি করা হচ্ছে।
এই বাফার জোন সৃষ্টিটা কিন্তু ভারতের ঘোষিত লক্ষ্য (৫ মে, ২০২০ তারিখের পূর্বস্থিতি বা স্টেটাস কো অ্যান্টি) নয়। অন্তত এই মুহূর্তে, সেটা দূরবর্তী ব্যাপার বলেই মনে হয়। ভারত যদি ইতিমধ্যেই অনেকটা পিছু হটে গিয়ে থাকে তবে সেসব আর কখনও ফিরে পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। প্রক্রিয়া আর প্রগতির উপর আপনার তীক্ষ্ণ নজর থাকা উচিত।