পরমের ভোগেচ্ছায়ই বিশ্ব বিকাশ। পারমাত্মিক সত্ত্বাই আত্মিক সত্ত্বায় দেহের দেহীরূপে আসিলেন ভোগ করিতে। দেহটা আত্মারই ভোগায়তন। এই ভোগধারাকে পরিপুষ্টি দিতেছে কাল (time)। জীবনটাকে সুষ্ঠু ও বলিষ্টভাবে ভোগ করিতে বিভিন্ন সময়ে সে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার উহা তো কালেরই অভিব্যক্তি। ত্যাগের নামে এই কালধর্ম্মকে যদি অস্বীকৃতি দিতে হয় তাহা হইলে আদি মানুষের আরণ্যবৃত্তিতেই ফিরিয়া যাইতে হইবে সমাজকে। একদিকে যেমন কালধর্ম্মী জ্ঞানের বিকাশকে অস্বীকার করা দুরূহ, অপরদিকে তেমনি ত্যাগের নামে সকল বিষয়ভোগ হইতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া নগ্নবাদিতায় ফিরিয়া গেলেও দেহরূপ বিষয়কে তো অস্বীকার করা সম্ভব নয়। মানুষী ধর্ম্মে মনকে বাদ দিয়া শুধু দেহের পোষণ হয় না। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায় দেহ-পোষণের সাথে সাথে আগাইয়া চলা কালধর্ম্মে মানুষের মনও উত্তরোত্তর পাইয়া যাইতেছে প্রতিভার দীপ্তি। জীবনকে সুন্দরতম ভাবে ভোগ করিতে বিকাশ নিতেছে বিভিন্ন ধারায়। শুধু কি তাহাই? মানুষকে বাদ দিলেও কত বর্ণ, গন্ধ, গানে ভরা এই বিশাল প্রকৃতি সমুল্লসিত হইতেছে সম্ভোগ সংবাসে। ভোগেই বিকাশের উৎস। সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম। একমোদ্বিতীয়ম্। সকলই ব্রহ্মময়। এক ভিন্ন দুই নয়। জগত আর জীবন। বিষয় আর বিষয়ী। জ্ঞান আর জ্ঞাতা হইয়া একেরই প্রকাশ। বিচ্ছেদ বিভিন্নতা। অখণ্ডের অস্বীকৃতি। সার্ব্বভৌমত্বের সংহৃতি। জৈবী-দৃষ্টিতে যখন দেখা—তখন দুই, জগত আর জীবন। দৈবীদৃষ্টিতে যখন দর্শন তখন অপরাঙ্মুখী অনুভূতি। একক অদ্বৈতবোধের প্রকাশ; দ্বিতীয়ের দ্বিধাহীন অস্বীকার। যেই অভিলসিতের জন্য অনশন, সেই অন্ন হইয়াই তো তিনিই। তাই ত্যাগ বলিতে জৈবী-দৃষ্টির অপনয়ন আর দৈবী-দৃষ্টির উন্মীলন। বিষয় বা বস্তুতে থাকে সম্ভোগ।
ভোগের দুইটি রূপ—একটি বিজয়ীর ভোগ, অপরটি বিজিতের ভোগ। বিজয়ীর ভোগে আছে ভূমার অভিযাত্রা। অনন্তের উৎস সন্ধান, আত্মার লসন। আর বিজিতের ভোগে হয় ইন্দ্রিয় লসিত, মানস অপরিচ্ছন্ন। মোহ আর আসক্তিতে সীমাহীন স্বার্থপরতা দেখা যায় প্রতি পদক্ষেপে। বিস্মৃতি আসে রূপ হইতে রূপান্তরে অস্মিতার স্পন্দিত চেতনায়। ভূমির মোহে ভূমার অভিসরণ হয় ব্যাহত। বিবর্ত্তন চক্রের কেবল মানসলোকেই চলে জীবনের পরিক্রমা। মানবের মহামানবতায় রূপান্তর লোকান্তরেও সম্ভব হয় না। কিন্তু উভয়তই রহিয়াছে ‘‘নাল্পে সুখমস্তি’’ ভাব। তবে একটিতে আছে সঙ্কোচন হইতে প্রসারণ, কেন্দ্রিকতা হইতে পরিব্যাপ্তি, মানস হইতে অতি মানসে গমন। সেখানে নাই কোন বন্ধন, আছে মুক্তি, আছে শাশ্বত আনন্দের অনুরণন। অপরটিতে রহিয়াছে জীবন ছাড়িয়া জগতে আবর্ত্তন, বিস্তৃতি হইতে সঙ্কোচন, প্রজ্ঞা ছাড়িয়া অজ্ঞানতার পরিশীলন। আছে মোহ, আছে ক্ষয়, আছে আসক্তিজাত সংস্কারের বন্ধন। আছে স্বাধীনতা ছাড়িয়া ইন্দ্রিয়াধীনতায় জীবনের পরিবহন। উভয় ধারায়ই আছে গতি, আছে অতৃপ্তি। বিজয়ীর বা বিজিতের বর্দ্ধিষ্ণু বা ক্ষয়িষ্ণু সকল ভোগেই জীবনের যে অতৃপ্তি উহাই নির্দ্দেশ করে জীবনের ভূমাধর্ম্ম, আত্মার অমৃতস্যন্দী অনন্ত অখণ্ড সত্ত্বা।
মহর্ষি প্রেমানন্দের ‘গীতায় ভগবান’ থেকে