সাধু-সন্তদের জীবন চর্চা সবসময়েই মহৎ ভাবের উদ্রেক করে। এর থেকে আনন্দও পাওয়া যায়। অবশ্য উচ্চতর জীবনের আকাঙ্ক্ষা যাদের মধ্যে থাকে তারাই সে আনন্দ লাভ করতে পারে। যারা জীবনের একটি অর্থ খোঁজে, এই সাধু-সন্তদের জীবন থেকে তারা জীবনের একটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সন্ধান পায়। প্রায়শই দেখা যায় একজন মানুষ প্রতিদিনের হাসি-আনন্দ, দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদির মধ্যে জড়িত থেকে সাধারণভাবেই জীবন শুরু করে। যখন তার ভোগাকাঙ্ক্ষা কিছুটা তৃপ্ত হয় এবং জীবনে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, তখন সে এমন কিছুর জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে যা তার কাছে অজ্ঞাত। যদি তার মধ্যে শুভ সংস্কার থাকে বা তার বড় হওয়ার সময়ে কোন শুভ যোগাযোগ ঘটে থাকে, তখন আস্তে আস্তে সে একটি নতুন জগৎ সম্বন্ধে এবং নতুন ধরণের ধ্যান ধারণা সম্বন্ধে অবহিত হয় এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক সত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়। এই প্রসঙ্গে সাধুদের জীবনযাত্রা এবং তাদের কার্যকলাপ বিশেষভাবে তাকে আকর্ষণ করে। সে আবিষ্কার করে যে এইসব সাধু-সন্তরা তাদের দৈহিক চাহিদাকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে উচ্চতর মহান সূক্ষ্ম কোনও এক ভাবে একেবারে মগ্ন থাকে। যতই এর চর্চা করে ততই তাদের প্রতি বিশ্বাস বেড়ে যায়। অবশেষে সাধু-সন্তদের উপলব্ধিতে তার দৃঢ় প্রত্যয় হয়। তখন তার জীবনে এক আনন্দের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। তাই আমরা দেখতে পাই যে কর্মজীবনের শেষপ্রান্তে এসে যখন বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় তখন শত শত লোক আধ্যাত্মিক জীবনচর্চায় নিষ্ঠাভরে আত্মনিয়োগ করে। যাদের সেই শুভ সংস্কার নেই তারা নানাবিধ উত্তেজনার সন্ধান করে। কিন্তু হায়, প্রায়শই এ ব্যাপারে তাদের তখন অল্পই ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকে।
সম্ভবতঃ এই কারণে সাধারণের মনে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে ধর্মজীবন কেবলমাত্র বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য। এইজন্যেই তারা সেই সনাতন ভারতীয় আদর্শের প্রশংসা করে, যেখানে জীবনে চারটি পালনীয় আশ্রমে ভাগ করা হয়েছে। এই চতুরাশ্রমের আদর্শ অনুসারে মোক্ষলাভের প্রয়াসকে জীবনের শেষ পর্যায়ের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অবশ্য এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গী সঠিক নয়। যথার্থ পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া কারো পক্ষেই সেই সাধু-সন্তদের, যারা চরম দার্শনিক সত্যে প্রতিষ্ঠিত, জীবন অনুসরণ করা সম্ভব নয়, অথবা যে কাঠোর সাধনা ও তপস্যার দ্বারা আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করা যায় তাও পালন করা সম্ভব নয়। সুতরাং সেই সনাতন ভারতীয় জীবন আদর্শের প্রথমেই ব্রহ্মচর্যের স্থান যখন কঠোর তপস্যা, নিষ্ঠা সহকারে পাঠ ও ধ্যান ধারণায় মগ্ন থাকতে হয়। মুক্তি কামনার বীজ সেই সময়েই উপ্ত হয় যা ক্রমান্বয়ে গার্হস্থ্য জীবনের মধ্য দিয়ে গিয়ে বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস জীবনে চরিতার্থতা লাভ করে। বাণপ্রস্ত আশ্রমে গৃহস্থকে ধীরে ধীরে পারিবারিক জীবন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে সস্ত্রীক বনে গিয়ে ঈশ্বরের চিন্তায় জীবনযাপন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারপর সন্ন্যাস আশ্রমে গিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করতে হয়।
স্বামী স্বাহানন্দের ‘হিন্দু উপাসনাতে প্রতীক ও অন্যান্য রচনা’ থেকে