নরেন্দ্র মোদি বিজেপির দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী। বিজেপি হল আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা। অর্থাৎ এই দলটিই সঙ্ঘের রাষ্ট্রচিন্তা বাস্তবায়নের হাতিয়ার। গান্ধীহত্যা এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসে অভিযুক্ত ছিল আরএসএস। সংগঠনটি একাধিকবার নিষিদ্ধও ঘোষিত হয়। তারপরেও ১৯৯৮ সালে ভারতবাসী বিজেপিকে ভারত-শাসনের ক্ষমতা দিয়েছিল। কোনও সন্দেহ নেই, সেটা সম্ভব হয়েছিল বাজপেয়ির সৌজন্যে। তিনি সঙ্ঘের অনুগামী হলেও দেশবাসী ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ। তিনি নিজেকে সমস্তরকম রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। ছ’বছরের শাসনকালে তাঁর সরকার দেশ-শাসনের যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখিয়েছিল সেটাই হয়ে উঠেছিল বিজেপির ভবিষ্যতের পুঁজি। মনমোহন সিংয়ের বদলি হিসেবে ২০১৪ সালে মানুষ ফের বিজেপিকেই তুলে আনে। এটা বাজপেয়ি জমানারই ডিভিডেন্ড। বাজপেয়ি জমানার বিশেষত্ব কী ছিল? বাজপেয়ি সবার আগে গুটিয়ে রেখেছিলেন তাঁর উগ্র হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডা। তাঁর আমলে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চায় কংগ্রেস, এমনকী বামেদের সঙ্গেও তফাত কিছু ধরা পড়েনি। ‘নরম’ মানুষটি আদবানিকেও ট্যাঁফো করতে দেননি। যথার্থ ‘রাজধর্ম’ পালনই ছিল তাঁর অগ্রাধিকার। বিভেদকামিতার দায় মাথায় নিয়ে তাঁকে সরতে হয়নি। মূলত দ্রমূল্য বৃদ্ধির ধাক্কাতেই ক্ষমতার অলিন্দ থেকে সরে গিয়েছিলেন ‘ফিল গুড’-এর প্রবক্তা। অর্থাৎ অটলবিহারী এই ইমেজ গড়ে দিয়ে গিয়েছেন যে, ক্ষমতার আসনে পৌঁছে গেলে বিজেপি যথেষ্ট দা‌঩য়িত্ববান। কংগ্রেস, বাম বা অন্য পাঁচটা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দলের উনিশ-বিশ। মোদি জমানার সূচনার জন্য গেরুয়া শিবিরের এই ভাবমূর্তিটাই জরুরি ছিল। কিন্তু শুরুতেই দাঁত নখ বের করেছে মোদি জমানা। মোদি সবেতেই ‘ওয়ান ইন্ডিয়া’ চান। এটাই সঙ্ঘ পরিবারের রাষ্ট্রচিন্তা। আপাতনিরীহ স্লোগানটি আকর্ষণীয়ও বটে। বহু ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির দেশকে সংহত রাখার মন্ত্র তো বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। আজকের শাসক তো সেটাই বলছে। তাহলে এত বিতর্ক কেন? ১৩৫ কোটি মানুষের এই দেশে অনেকগুলি রাজ্য। রাজ্যগুলির সঙ্গে কেন্দ্র অনবদ্য এক সাংবিধানিক ব্যবস্থা দ্বারা সঙ্ঘবদ্ধ। ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলির ক্ষমতা, এক্তিয়ার, কর্তব্য-দায়িত্ব প্রভৃতি সুন্দরভাবে বণ্টিত হয়েছে। রাজ্যগুলির উপর কেন্দ্রের প্রভুত্ব করার কোনও সুযোগ নেই। সংবিধানের মূল নীতি হল কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলির মধ্যে সুসমন্বয়। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, সাম্য, গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, সার্বভৌত্ব রক্ষার জন্যই সংবিধানের এই বিচক্ষণতা। তবু রাজ্যগুলির অধিকার ও এক্তিয়ারে কেন্দ্রর অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশের অভিযোগ বহু পুরনো। কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতিবাদ রাজ্যগুলি বারবার করেছে। সুরাহার দাবিতে মামলা হয়েছে, গঠিত হয়েছে কমিশন, সংশোধিত হয়েছে সংবিধান। নাছোড় বিতর্কের ভিতরেও ভারসাম্য রক্ষার বিশেষ সদিচ্ছা ছিল ইউপিএ সরকার অব্দি। চমকসর্বস্ব শাসনে বিশ্বাসী মোদি সরকার সব দৃষ্টান্ত, ট্রাডিশন ভেঙে ফেলতে মরিয়া। এদের হাতিয়ার উগ্র জাতীয়তাবাদ। এক দেশ, এক আইনের আড়ালে বিজেপি আসলে সবাইকে একমাপের জুতো পরাতে চায়। স্বপ্ন দেখে, সারা দেশে চলবে একটাই দলের সরকার। ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার’ নাম দিয়েছেন মোদি। এইভাবে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়ে বিজেপি কায়েম করতে চায় প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম বা একনায়কতন্ত্র। এই রাষ্ট্রচিন্তার সঙ্গে ফ্যাসিবাদের তফাত কোথায়? জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে সরকার-বিরোধী যেকোনও শক্তিকে জব্দ করার অনুশীলনে বিজেপি ইতিমধ্যেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম! উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত, অসম, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যে এমন দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি। তাই মোদি সরকারের যেকোনও ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ মানুষকে প্রথমেই উদ্বেগে রাখে। পর্দার পিছনের আসল খেলাটি নিয়ে মানুষ ভাবতে বাধ্য হয়। যেমন সীমান্তবর্তী তিন রাজ্যে (পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ, অসম) বিএসএফের ‘অপারেশনাল’ ক্ষমতার চৌহদ্দি বাড়িয়ে নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সীমান্ত থেকে মূল ভূখণ্ডের ৫০ কিমি পর্যন্ত এলাকায় অপারেশনাল কাজকর্ম অর্থাৎ সার্চ, সিজার এবং অ্যারেস্ট করতে পারবে বিএসএফ। আগে যা ছিল মাত্র ১৫ কিমি। ১১ সেপ্টেম্বর এই সংক্রান্ত গেজেট নোটিফিকেশন জারি হয়েছে। অপারেশনাল কাজকর্মের চৌহদ্দি বেড়ে যাওয়ায় সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য পুলিসের সঙ্গে বিএসএফের সংঘাত প্রায় অনিবার্য হতে চলেছে। বিষয়টি নিয়ে ঘনিষ্ঠ মহলে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তের দৈর্ঘ্য ২,২১৭ কিমি। সীমান্তবর্তী জেলাগুলির একাংশে সাধারণ মানুষের উপর বিএসএফের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ পুরনো। কেন্দ্রের নয়া ফরমানে তা বেড়ে যাওয়ারই আশঙ্কা থাকছে। ব্যাপারটি রাজ্যের এক্তিয়ার এবং অধিকার খর্ব হওয়ারও শামিল একইসঙ্গে। ইডি, আইটি, সিবিআই, এনআইএ, এনসিবির সঙ্গে সন্দেহের তালিকাভুক্ত হল এবার বিএসএফ। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অক্ষুণ্ণ রাখা এবং সীমান্ত সুরক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির স্বার্থে কেন্দ্রের উচিত, বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা। এমন স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই।