কর্মে ও ব্যবসায়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য। কৃষিপন্ন বিক্রেতা ও ডাক্তারদের অর্থকড়ি প্রাপ্তি হবে সর্বাধিক। বন্ধুকে টাকা ... বিশদ
এই সুজলা সুফলা সময়েই দীপাবলির ঠিক আগে তাঁর ‘কীর্তি’ ২৭৩ দিনে শত কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা। আগেও কেউ করতে পারেননি, পরেও কোনও রাষ্ট্রনেতার পক্ষে এ রেকর্ড ছোঁয়া অসম্ভব! হাবভাবটা এমনই। মনমোহন সহ আগের আর সব প্রধানমন্ত্রী এই সাফল্যের পাশে নিতান্তই খর্বকায়। অথচ চীন কিন্তু অনেক আগেই একশো কোটির বেঞ্চমার্ক পেরিয়ে গিয়েছে অবলীলায়। ছুটছে ২০০ কোটি ডোজের দিকে। আর আমাদের লোক সংখ্যার তিরিশ শতাংশও কিন্তু এখনও ডবল ডোজ পাননি। আমাদের জনসংখ্যা ১৩০ কোটি। বহু মানুষ এখনও একটি ডোজও পাননি। ১০০ কোটি ডোজ মানে একশো কোটি মানুষের টিকা পাওয়া নয়। ধাঁধাটা এখানেই। অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ মানুষের টিকার একটি ডোজ পাওয়ার আখড়া কবে পার হবে কে জানে! তবু তালি তো বাজাও। সব বিরুদ্ধ প্রচার এক নিঃশ্বাসে ঢেকে দাও। বলো এটাই সর্বোত্তম। ঐতিহাসিক! অভূতপূর্ব! গত সাত বছর ধরে অক্লেশে এই প্রচারেরই তুফান মেল ছোটাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, একটাও সাংবাদিক সম্মেলন না করেও তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। থালা বাসন যার যা আছে তাই নিয়েই আওয়াজ তোলো।
এত বড় সাফল্য একটা জাতির উদ্দেশে ভাষণ হবে না, তাও কি হয়। তাই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গত শুক্রবার বেলা দশটাতেই শুরু হল তাঁর দেশবাসীকে সম্বোধনের উজ্জ্বল রংমশাল মেলে ধরা। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় যা ছিল প্রতি মাসের রুটিন, সেই জাতির উদ্দেশে ভাষণের ফের পুনরাবৃত্তি আবার দেখল দেশ। মহামারী বিদায় নিক আর নাই নিক, তৃতীয় ঢেউ মাথা তুলুক আর নাই তুলুক লালকেল্লা থেকে হাওড়ার ব্রিজ, আলোর রোশনাইয়ের অভাব নেই। এমনই তীব্র এই প্রচার যে যাবতীয় অপ্রিয় প্রশ্ন উধাও। গত মে মাসে অক্সিজেন, হাসপাতালের বেড না পেয়ে শতশত মানুষের গঙ্গাপ্রাপ্তি সব হারিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির গর্ভে। যাঁর সংসার ভেসে গিয়েছে, বেদনাটা আপাতত তাঁর হোক একান্ত ব্যক্তিগত। সে সব ভুলে আগুয়ান সরকারের সব প্রচারযন্ত্রে যেন একটাই প্রতিধ্বনি, মোদি হ্যায় তো গঙ্গামে লাশ ভি মুমকিন হ্যায়!
সমালোচনা দেখলেই সব মিথ্যে প্রচার বলে দেগে দাও, ‘দেশদ্রোহী’রা পাকিস্তানে পালানোর আর পথ পাবে না। কী বললেন মোদিজি এবার? বললেন টিকাকরণের পুরো কর্মসূচিটি চলেছে ভিআইপি সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ বানপ্রস্থে পাঠিয়ে। তিনি কি সচেতনভাবে একথা বলেছেন? এইমসে টিকা পেতে তাঁর কিংবা তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের যা সময় লেগেছে, দেশের সাধারণ মানুষ প্রত্যন্ত গ্রামে সেই সময়ে ডোজ নিয়ে ফিরতে পেরেছেন? নাকি সবটাই শুধু কথার কথা। বাত কি বাত। দ্বিতীয়ত, দুই ডোজের ব্যবধান নিয়ে সরকার নিজেই বারবার যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে তার হিসেব কে দেবে? ভারত বায়োটেকের কোভ্যাকসিন আজও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি না পাওয়ায় চরম জটিলতা তৈরি হয়েছে। সরকার এই সমস্যার সমাধানে কী করেছে? শুধু বিজ্ঞাননির্ভর টিকাকরণের সমর্থনে ঢাক বাজালে কি পেট ভরবে, না মহামারী দূরে সরে যাবে? আর গতবছর তাঁর যে দাওয়াইয়ে দেশের মানুষের চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল সেই থালা বাজিয়ে মহামারীকে যে হটানো সম্ভব নয়, কার্যত সেকথা স্বীকার করে তিনি কী বললেন? প্রধানমন্ত্রীর পাল্টা গুগলি, দেশের একতাকে তুলে ধরার জন্যই তিনি দুঃসময়ে ওই নিদান দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্যের ভূমিকা নিয়ে বলতে এত কার্পণ্য কেন? বিশেষত ভ্যাকসিন কম পাওয়ার পরও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের টিকা অভিযানের সাফল্য নিয়ে একটা শব্দও তিনি খরচ করলেন না। টিকাকরণ এখনও শেষ হয়নি, এ রাজ্যে প্রায় সাত কোটি ডোজ ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়ে গিয়েছে। তাই শুধু নিজের সরকারের সাফল্যের ধ্বজা না উড়িয়ে যেসব রাজ্য ভালো কাজ করেছে তাদের কথাও প্রধানমন্ত্রীর আরও বিশদে বলা উচিত ছিল না কি? নাকি ভোট রাজনীতিতে সাফল্যের কোনও ভাগ হয় না! সামনে পাঁচ রাজ্য দখলের চূড়ান্ত যুদ্ধ, আর কে না জানে ‘নাথিং ইজ আনফেয়ার ইন লাভ, ওয়ার অ্যান্ড পলিটিক্স’।
যদি বলি, গত ফেব্রুয়ারি-মার্চে প্রথম চোটেই বিদেশে টিকা পাঠানোর ঝুঁকি না নিয়ে সরকার টিকাকরণে জোর দিত তাহলে এই শত কোটি ডোজের মাইলস্টোন ছুঁয়ে ফেলা যেত আরও দু’মাস আগেই। দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতও এমন করে গায়েই লাগত না। কথাটা কি খুব ভুল। আগে পিছে কিছু বিবেচনা না করেই প্রায় ৮০টি দেশে ভ্যাকসিন রপ্তানির সিদ্ধান্ত মোটেই ঠিক ছিল না। সরকার তা বুঝেছে, তবে দেরিতে। আর আত্মনির্ভর ভারতের বিজ্ঞাপন বলে যা প্রচার হচ্ছে তাও কতটা সঠিক? আমাদের বিজ্ঞানীদের বিন্দুমাত্র ছোট না করেই বলছি, কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের আবিষ্কর্তা তো আর সিরাম ইনস্টিটিউট নয়। ওটা অক্সফোর্ডের গবেষণার ফল। সিরাম সেই ফর্মুলা মেনে তৈরি করছে মাত্র।
নরেন্দ্র মোদি গত ডিসেম্বরে একবার ঘটা করে ঢাকি বিদায়ের মতো করোনা বিদায়ের কথা বলেছিলেন। মুখ থুবড়ে পড়েছিল সেই দাবি। তারপরই শুরু হয়েছিল বাংলায় তাঁর দখলদারির খেলা। টাকা আর পেশি শক্তির জোরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ভাঙার মরিয়া চেষ্টা। নেতা কিনে বাংলা দখলের বিষময় ফল আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কয়েক মাসের মধ্যেই। এবারও ১০০ কোটি ডোজের সাফল্য ফেরি করতে গিয়ে তিনি দেড় সপ্তাহ আগেই দেশে আগাম দেওয়ালি ডেকে এনেছেন। বোঝাই যাচ্ছে কোভিড স্মৃতি ভুলিয়ে মোদিজি দ্রুত ভোট রাজনীতির দৌড়ে ফিরতে চাইছেন। তাই ‘ফিল গুড’ ফ্যাক্টর ছড়িয়ে দেওয়ার এত তাড়া। জনগণ ঘর পোড়া গরু, যা সওয়াবে তাই সইবে নিঃশব্দে। আসলে মোদিজি যত বড় না সফল প্রধানমন্ত্রী, তার চেয়ে ঢের বড় অভিনেতা, তুখোড় ইভেন্ট ম্যানেজার। নিঃশব্দে দেশের সব মনুমেন্টে আলো জ্বেলে দিয়ে তিনি আসন্ন একঝাঁক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের ভোট প্রস্তুতিই সেরে রাখছেন। উত্তরপ্রদেশে বড় ব্যবধানে জয় এলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ রোখার ব্যর্থতা, গঙ্গায় মৃতদেহের সারি সব এক নিমেষে মুছে যাবে। তখন দ্বিধাবিভক্ত বিরোধী শক্তিকে পর্যুদস্ত করা যে তেমন কঠিন হবে না, এই কথাটা তাঁর মতো আর কে জানে! তাই আপাতত মিশন উত্তরপ্রদেশের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি। সঙ্গে দলীয় কোঁদলে বিধ্বস্ত কংগ্রেসকে পাঞ্জাবে হারানোর সুবর্ণ সুযোগ। তাই অর্থনীতির সঙ্কট, শতশত যুবকের কাজ হারানো, মূল্যবৃদ্ধি থেকে চোখ ঘোরাতেই শত কোটি ডোজের সাফল্যের স্বপ্নের উড়ানে সওয়ার তিনি। সত্যকে ভুলিয়ে দেওয়ার খেলার বাকিটা বলবে ভবিষ্যৎ।