আশ্বিনের শারদ প্রাতে নীল-সাদা আকাশ, পুঞ্জীভূত মেঘের আনাগোনা, শিউলির হালকা গন্ধ, কাশফুলের দোলা। প্রকৃতির ‘এই অমোঘ’ রূপকে সাক্ষী রেখে ষষ্ঠীর বোধনের সকাল জানান দিল মা এসেছেন ঘরে। ঢাকের আওয়াজ, কাঁসরের বাদ্য আর নৈবেদ্যর মধ্য দিয়ে ১৪২৮ বঙ্গাব্দের শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়ে গেল। এরপর সপ্তমীতে চক্ষুদান, অষ্টমীতে পুষ্পাঞ্জলি ও কুমারীপুজো, তারপর অষ্টমী নবমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপুজো, নবমীতে দেবীর মহাপ্রসাদ বিতরণ, আর দশমী তিথিতে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে মাকে বিদায় জানানো হবে। আসমুদ্রহিমাচলের বাঙালির কাছে দুর্গাপুজো তাই বছরের শ্রেষ্ঠ উৎসব। এই কয়েকটা দিনের জন্য মার্কিন মুলুকের সানফ্রান্সিসকো থেকে ২৪ পরগনার সুন্দরবন, সারা বছর অধীর অপেক্ষায় থাকে। পুজো মানে নতুন পোশাক, পুজো মানে ভালোমন্দ খাওয়া-দাওয়া, পুজো মানে মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা দর্শনে বেরিয়ে পড়া, পুজো মানে দূর ভ্রমণের হাতছানি। বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ উৎসবে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে যে সম্প্রীতির ছবি ফুটে ওঠে এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কাকদ্বীপ থেকে কালনা, পাহাড় থেকে সমতলে এমন অনেক পুজোর আয়োজনে ভিনধর্মী মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে প্রকৃত মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছে পুজোমণ্ডপ। পঞ্জিকা মতে, বোধনের আনুষ্ঠানিক সূচনা ষষ্ঠীতে হলেও বাঙালির দুর্গোৎসব শুরু হয়ে ঩গিয়েছে মহালয়ায় দেবীপক্ষের সূচনাকাল থেকেই। এই তিলোত্তমা মহানগরী থেকে মফস্‌সল শহর—সব পথ মিশেছে মণ্ডপে মণ্ডপে। সেলফি তোলার হিড়িক, ফুচকার স্টল থেকে রেস্তরাঁয় লাইন, সকাল-সন্ধ্যা বৈঠকী আড্ডা, রাতভর পদাতিক দর্শনার্থীদের স্রোত ঘুচিয়ে দিয়েছে যাবতীয় দুঃখ, ক্লেশ, মলিনতা, বিভেদের বেড়াজাল। লোকাল ট্রেন না চললে কী হয়েছে? স্পেশাল ট্রেনের দৌলতে সন্ধ্যা নামলেই হাওড়া, শিয়ালদা স্টেশন থেকে শহরে ঢুকে আছড়ে পড়ছে উদ্বেল জনতা। কলকাতার এই জনরাশির জনবিস্ফোরণ সামলাতে পথে নেমেছে পুলিস। শারদোৎসব মানে কোথাও থিমপুজো, শিল্পীদের চোখ ধাঁধানো সৃষ্টিকর্ম এবারও চোখ টানছে দর্শকদের। তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে সাবেকি ঘরানা, একচালার প্রতিমা। বনেদি বাড়ির ঐতিহ্যবাহী পুজোর আয়োজনও পিছিয়ে নেই। পুজোর কেনাকাটায় ষষ্ঠী যেন শেষমুহূর্তের স্লগ ওভারে ব্যাট করল।
তবু এবারের শারদোৎসবের পথ যেন মসৃণ নয়। বরং ‘বন্ধুর’ পথে বিছিয়ে রয়েছে আশঙ্কার চোরাস্রোত, কিছু কাঁটা। এই মুহূর্তে মানবজাতির সবচেয়ে বড় শত্রু বোধ হয় করোনা। এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে একগুচ্ছ বিধিনিষেধ জারি রয়েছে বহু আগে থেকেই। ঘটনাও হল, এক জায়গায় বহু মানুষের জমায়েত সংক্রমণ বাড়াতে আগুনে ঘিয়ের মতো কাজ করে। দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে সেই আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে রয়েছে চিকিৎসকমহল। গত কয়েকদিন যাবতীয় বিধিনিষেধকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাস্কহীন যে বিপুল জনতাকে দেখা গিয়েছে রাস্তায়, মণ্ডপে মণ্ডপে তা এক অজানা বিপদের সঙ্কেত। প্রশাসন, পুজো কমিটি, পুলিসের সনির্বন্ধ আবেদন নিবেদনকে গুরুত্ব দিচ্ছে না এক অংশের দর্শনার্থী। ফলে পুজোর ভিড় ‘সুপার স্প্রেডার’ হয়ে আগামী দিন মাটি করে দেবে না এমন গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। এবারে করোনার সঙ্গী রাজ্যের একাংশের বন্যা পরিস্থিতি। এই শরতেও বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি এবং ডিভিসিসহ বিভিন্ন জলাধারের জল ছাড়ার কারণে দুই বঙ্গের কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেখান নম নম করে পুজো হলেও আনন্দ ফিকে। বৃষ্টির আশঙ্কার মেঘ জমেছে মানুষের মনেও। আবহাওয়ার পূর্বাভাস, অষ্টমী থেকে দশমী দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টি সব পরিকল্পনা ওলোটপালট করে দিতে পারে। অনেকটা সেই আশঙ্কা থেকেই চতুর্থী-পঞ্চমী-ষষ্ঠীতেও অষ্টমীর ভিড় রাস্তায়, মণ্ডপে। করোনা বৃষ্টির ভ্রুকুটিকে মনে মনে উপেক্ষা করা গেলেও মূল্যবৃদ্ধির ছ্যাঁকায় বঙ্গবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। গত কয়েকমাস ধরে পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম বাড়তে বাড়তে এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। দামে লাগাম পরাতে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও উদ্যোগ নেই। এর পরিণতিতে কাঁচা আনাজ থেকে যেকোনও পণ্যসামগ্রী ছোঁয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবু এসবকে যেন কয়েকদিনের জন্য ঘুলিয়ে দিয়েছে মা মৃন্ময়ীর আগমন। এই ঘোর দুর্দিনেও সন্তানদের নিয়ে তিনি ঘর আলো করে এসেছেন। তাঁর সঙ্গেই আপাতত কয়েকটা দিন সব ভুলে থাকতে চায় বাঙালি। এই আনন্দের দিনে আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল। সকলে ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। শুধু একটাই পরামর্শ—আনন্দ করুন উজাড় করে, তবে প্রতিটি পদক্ষেপ করুন সচেতনভাবে, সতর্ক হয়ে। মনে রাখবেন, আপনার আনন্দ যেন অন্যের সর্বনাশের কারণ হয়ে না ওঠে।