গত ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি শেষবার পোলিও রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল ভারতে। আর সেটা এই বাংলাতেই। হাওড়ায় পাঁচলার গ্রামে। রুকসা নামে ছোট একটি মেয়ের বাবা-মা হঠাৎ লক্ষ করেন যে তার ডান পা ক্রমশ কমজোরি হয়ে আসছে। রুকসার জরি শিল্পী বাবা পরে স্বীকার করেছিলেন, সরকারের তরফে নানাবিধ প্রচার সত্ত্বেও তিনি তাঁর মেয়েকে পোলিও ভ্যাকসিন খাওয়াতে অবহেলা করেছিলেন। সন্তান পোলিও আক্রান্ত হওয়ার পরই তাঁর আপশোসের শেষ ছিল না। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি পাঁচলায় ঘটলেও কলকাতা, হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনাসহ বাংলার আরও কিছু এলাকায় এই অবহেলা ছিল। পোলিও টিকাকরণে সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের নজরে এসেছিল বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের একাংশ থেকে। যদিও উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে শেষবার পোলিও আক্রমণ চিহ্নিত হয়েছিল ২০১০ সালের যথাক্রমে এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বরে। এমনকী ২০০৯ সালে শুধু উত্তরপ্রদেশেই ছয়শোর বেশি নতুন পোলিও রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। সে-বছর সারা ভারতে সংখ্যাটি ছিল ৭৪১! তারপরই সারা দেশে সচেতনতা বাড়ানোর বিজ্ঞাপনে আনা হয় অমিতাভ বচ্চনকে। তাতে সাফল্য কতখানি মিলেছিল পরিসংখ্যানেই তা পরিষ্কার—দু’বছরের মধ্যে ওই দুই বড় রাজ্যে পোলিও সংক্রমণের সংখ্যাটি শূন্যে নামিয়ে আনা গিয়েছিল।
এই রোগ একাধিক ধরনের। মানুষের শরীরে পোলিও ভাইরাসের সংক্রমণই এই রোগের কারণ। এক মানুষ থেকে আর-এক মানুষে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই রোগে মানুষের স্নায়ু এবং পেশির স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে পারে। মস্তিষ্কে সংক্রমণের পরিণাম সবচেয়ে মারাত্মক—মৃত্যুও ঘটতে পারে। নির্দিষ্ট নিয়মে টিকাগ্রহণের মাধ্যমে এই রোগ থেকে মানুষকে বাঁচানো সম্ভব। তা সত্ত্বেও ভারতসহ নানা দেশের কিছু অঞ্চলে অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে প্রচার ছিল যে—পোলিও ভ্যাকসিন খাওয়ানো আসলে এক ধরনের ষড়যন্ত্র! এই ভ্যাকসিন খাওয়ার কারণে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়! অর্থাৎ, পোলিও টিকাকরণ কর্মসূচি হল জনসংখ্যা কমানোর সরকারি ষড়যন্ত্র। ওইসঙ্গে কোনও কোনও শিশুর মৃত্যুর কারণ হিসেবে পোলিও টিকাকেই মিথ্যে করে চিহ্নিত করে দেয় কিছু মতলববাজ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু), ইউনিসেফ, ভারত সরকার এবং সব রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগ সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেয় মানুষের এই ভুল ভাঙাতে। দেশজুড়ে নিশ্চিত করা হয় পোলিও টিকাকরণ। অবশেষে ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ ভারত পোলিওমুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষিত হয়। হু একই সঙ্গে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলকেই পোলিও মুক্ত বলে স্বীকৃতি দেয়। তারপর কেটে গিয়েছে আরও পাঁচটি নিরাপদ বছর। ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এগারোটি দেশের জন্য এ এক বিরাট স্বস্তির খবর। এই সাফল্য কিন্তু এমনি এমনি ধরে রাখা যায়নি। হু জানিয়েছে, পোলিওমুক্ত ঘোষণা হওয়ার পরেও এই অঞ্চলে প্রতি বছর ৩ কোটি ২০ লক্ষ শিশুকে পোলিও টিকা খাওয়ানো হচ্ছে। শুধু ২০১৮ সালে ভারতে চার দফায় ৪৬ কোটি পোলিও টিকার ডোজ খাওয়ানো হয়েছে।
ভাবলে এখনও শিউরে উঠতে হয় যে ১৯৮৮ সালেও সারা বিশ্বে সাড়ে তিন লক্ষ পোলিও রোগী ছিল। টিকাকরণের কল্যাণে ২০০৭ সালে সংখ্যাটি কমে ১৬৫২-তে নামিয়ে আনা গিয়েছিল। ২০১৭-র হিসেবে, সংখ্যাটি ৩৩। হু জানাচ্ছে, বিশ্ব এখনও পোলিওমুক্ত নয়। পোলিও নির্মূলকরণে সাফল্যের হার ৯৯ শতাংশের বেশি। সাফল্যের বাকিটুকু অধরা রয়ে গিয়েছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া প্রভৃতি কয়েকটি দেশের উগ্র মৌলবাদীদের অন্যায় প্রতিরোধের কারণেই। হু এবং ইউনিসেফের অভূতপূর্ব উদ্যোগটিকে আরও দৃঢ়-প্রসারিত করতে হবে যাতে সারা বিশ্বকে অবিলম্বে পোলিওমুক্ত করে তোলা সম্ভব হয়। সারা পৃথিবীরও বিশেষভাবে সতর্ক থাকা দরকার। কারণ, পোলিও একবার হলে তা থেকে মুক্তির বিদ্যা আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রেও নেই। পোলিও থেকে বাঁচার আপাতত একমাত্র রাস্তাটি হল টিকাগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিরোধ। আরও আশঙ্কার কথা এই, যে-স্ফুলিঙ্গ ওই তিন দেশে রয়ে গিয়েছে তা থেকে সারা বিশ্বের পোলিওমুক্ত অঞ্চলগুলিও নতুনভাবে বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে। হু-র মতে, আগামী দশ বছরের ভিতরে, বছরে ২ লক্ষ হারে পোলিও সংক্রমণ ঘটে যেতে পারে—পোলিও ভাইরাস সংক্রমণের বিপদ এতটাই ভয়ংকর!