কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। উপার্জন ভাগ্য ভালো। কর্মে উন্নতির যোগ আছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা মিলবে। ব্যবসা ... বিশদ
কিন্তু দেশের অন্য শহর গ্রামে কেউই খুব একটা এই দলগুলির রাজ্য নেতাদের নাম ধরে চর্চা করে না। কারণ হয়তো জানেই না। সেই জনপ্রিয়তা, সেই ফায়ারব্র্যান্ড ইমেজ কেউ করে উঠতে পারছেন না। এটা বাংলার রাজনীতির অন্যতম দৈন্য। অন্য রাজ্যগুলিতে কিন্তু এরকম নেই। উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, যোগী আদিত্যনাথরা আছেন। উঠে এসেছেন নতুন দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ। রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াকে টক্কর দিতে পারেন শচীন পাইলট, অশোক গেহলট। বিহারে নীতীশ কুমারের পাশাপাশি তেজস্বী যাদবের নামটাও দেশে পরিচিত হয়ে গিয়েছে। সেটা যোগ্যতাবলেই তিনি অর্জন করেছেন। নেহাত লালুপ্রসাদ যাদবের পুত্র হলে তো তাঁর দাদা তেজপ্রতাপ যাদবও জনপ্রিয় নেতা হতেন। তা কিন্তু হননি। তেজস্বী অনেক ম্যাচিওরড হয়ে গিয়েছেন। মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহানকে হারাতে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া কমল নাথ আছেন। কর্ণাটকে কুমারস্বামী, ইয়েদুরাপ্পা সমানভাবে পরিচিত। অন্ধ্রপ্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডুর প্রধান প্রতিপক্ষ জগনমোহন রেড্ডি। কেরলে পিনারাই বিজয়ন বনাম ওমান চন্ডি। যেমন গুজরাতের একজন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শুরু করে নরেন্দ্র মোদি আজ দেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন। উঠে এসেছেন অমিত শাহ। প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়ে পরবর্তী প্রজন্মের নেতা হওয়ার সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন হার্দিক প্যাটেলও।
প্রশ্নটা হল, বাংলায় একইসঙ্গে প্রবলভাবে মাস লিডার অর্থাৎ জননেতা এবং জনপ্রিয় নেতানেত্রী আর উঠে আসছেন না। বিধানচন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে প্রবল পরাক্রমী জনপ্রিয় নেতা ছিলেন জ্যোতি বসু। সিদ্ধার্থশংকর রায়ের বিরুদ্ধে জ্যোতি বসুই ছিলেন পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দাবিদার। জ্যোতিবাবুর আমল থেকেই জনমানসে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছিল যে যদি কোনওদিন সিপিএম শাসনের অন্ত হয় তাহলে কে হবেন বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা কোনও সন্দেহ ছিল না। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকেই রাজ্য তো বটেই, দেশেই একটি পরিচিত নাম ছিলেন। আজ যাঁরা মমতাকে নিয়ে প্রতিদিন হাসিঠাট্টা করেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেন, তাঁরা জানেনই না মমতা নিয়ে মাস হিস্টিরিয়া ঠিক কী পর্যায়ে ছিল। জেলা সফরে মমতার গাড়ি চালাতেন অশোকবাবু। টাটা সুমো। দেখা যেত তাঁর সবথেকে বড় উদ্বেগ দুর্ঘটনা এড়ানো। কারণ নব্বইয়ের দশকে সাংবাদিকতার কাজে গ্রামেগঞ্জে, শহরে ব্লকে রাস্তার পাশে দাঁডানো মানুষকে মমতার গাড়ির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে আমি নিজেই দেখেছি অসংখ্যবার। জীবন বিপন্ন করে।
এই প্রতিবেদনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মহিমান্বিত করা উদ্দেশ্য নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ ক্ষমতায় আছেন। আগামীকাল হয়তো থাকবেন না। তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হবেনই। মানুষের সমর্থন না পেলে জোরজবরদস্তি করে কখনওই কেউ চিরদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। সিপিএমের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসন যে একপ্রকার অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে পারে, বঙ্গ রাজনীতিতে এই কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। তাই মমতা জয়ী হবেন কিংবা পরাজিত হবেন সেটা দেখা যাবে একের পর এক ভোটের ফলাফলে। সেটা রাজনীতির চর্চার বিষয়। আমরা এখানে রাজনীতি নয়, বরং সোশ্যাল একটি প্রবণতার দিকে আলোকপাত করতে চাইছি। একজন বাঙালি হিসেবে আমাদের এটা জানা অত্যন্ত দরকার যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি বাংলার শেষ কোনও ন্যাশনাল লিডার? জাতীয় স্তরের রাজনীতির একজন অন্যতম চরিত্র, কোনও একটি শিবিরের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর মতামত নিয়েই অনেক সিদ্ধান্ত হবে, তাঁর দলের অবস্থান সংসদের অনেক ইস্যুতেই ম্যাটার করবে এরকম কোনও নেতা বা নেত্রী কি আগামীদিনে আর আসবে না বাংলায়? যেমন জ্যোতিবাবু ছিলেন, যেমন মমতা এখন! জাতীয় স্তরে তো ছেড়েই দিলাম, কেন বাংলা থেকে কোনও রাজ্যস্তরেরও প্রবল প্রতাপ কিংবা সম্ভাবনা নিয়ে নেতা বা নেত্রী আর উঠে আসতে পারছেন না। জাতীয় স্তরের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারেন এরকম বাংলার শেষ লিডার সম্ভবত হতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন জাতীয় স্তরের এক সম্ভ্রম সৃষ্টিকারী নাম। তিনি নেহরুকে পর্যন্ত একাধিকবার অত্যন্ত কঠোর ভাষায় চিঠি লিখেছেন বাংলার স্বার্থে। জ্যোতিবাবু শুধু বাংলার জনপ্রিয় নেতা নয়, তিনি ছিলেন প্রবলভাবে জাতীয় রাজনীতিরও একটি পরিচিত ও প্রভাব বিস্তারকারী নাম। এই কারণেই নব্বইয়ের দশকে তাঁকেই তৃতীয় ফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী হতে বলেছিল বাকি সব দল। তাঁর নিজের দল রাজি হয়নি। আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে একটা চর্চা চলছে। মমতাপন্থীরা বলছেন হতেই পারেন তিনি প্রধানমন্ত্রী। আবার মমতা বিরোধীরা হাসাহাসি করছেন এই সম্ভাবনা নিয়ে।
কিন্তু তিনি চর্চার কেন্দ্রে। প্রতিটি ন্যাশনাল মিডিয়ায় জাতীয় নেতাদের তালিকায় আলোচনা অথবা সমীক্ষায় মোদি, রাহুলের পরই মমতার নাম আসছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল বাংলা থেকে আর কোনও এরকম সম্ভাবনাময় নেতা আসছেন না। আজ মমতাকে ভয় দেখানোর জন্য বিজেপিকে নরেন্দ্র মোদি কিংবা অমিত শাহের নাম উল্লেখ করতে হয়। রাজ্য বিজেপির একজনও এমন নাম নেই যাঁকে বিজেপি সমর্থকরাই মমতার বিরুদ্ধে একটি নাম হিসেবে মনে করেন। বিজেপি কর্মী সমর্থকরা মমতা সম্পর্কে টীকাটিপ্পনী করার সময় বলেন, মোদিজি টাইট দেবেন মমতাকে... মোদিজি এবার ক্ষমতায় এলে মমতার কপালে দুর্ভোগ আছে। অর্থাৎ বিজেপি কর্মী সমর্থকরা নিজেরাই স্বীকার করে স্টেটমেন্ট দিয়ে দিচ্ছেন যে মমতাকে হারাতে যদি কেউ পারেন তিনি হলেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী। অর্থাৎ তাঁদের নিজেদের রাজ্যের নেতাদের যোগ্যতা অথবা উচ্চতা সম্পর্কেই তাঁদের বিশ্বাস নেই। কংগ্রেস ও সিপিএম কর্মী সমর্থকদের তো নেইই। কারণ তাঁদের নিজেদের মধ্যে আলোচনাতেই সবথেকে বড় হা হুতাশ হল আমাদের একটা গ্রহণযোগ্য নেতা নেই। এই দুই দল ভোটের থেকেও নেতার অভাবে বেশি ধুঁকছে। এই যে নেতা নেই অর্থাৎ কংগ্রেসে নেই, সিপিএমে নেই, বিজেপিতে নেই... এটা তৃণমূলের পক্ষে অত্যন্ত আনন্দের খবর হতে পারে। কিন্তু বাঙালির কাছে মোটেই নয়। কারণ জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারেন এরকম কোনও বাঙালি চরিত্র না থাকলে আগামীদিনে বাংলার রাজনীতিও অনেকটাই দিল্লি নির্ভর হয়ে যাবে।
বাংলার রাজনীতি কোনওদিন দিল্লির শাসকের দিকে তাকিয়ে আবর্তিত হয়নি। কংগ্রেস সর্বভারতীয় দল হলেও বাংলার রাজনীতি নিজের মতো করেই পরিচালিত হয়ে এসেছে। সিপিএম আমলেও তাই। বিধানচন্দ্র রায়, সিদ্ধার্থশংকর রায়রা নিজেদের মতো করেই শাসন করেছেন। সিপিএমকেও বাংলা পরিচালনায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটির পারমিশন দরকার হয়নি। অর্থাৎ বাংলার বাজেট কী হবে, বাংলায় কোন কোন উন্নয়ন প্রকল্প করতে হবে ইত্যাদি সিদ্ধান্তগ্রহণে কখনওই দিল্লির সিলমোহরের প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু যদি জনমনে প্রতিষ্ঠিত ও প্রকৃত মাস লিডার আর না আসে তাহলে আগামীদিনে দিল্লির দিকে তাকিয়েই বাংলার রাজনীতি আবর্তিত হতে থাকবে। সেটা বাংলার পক্ষে আর্থিকভাবে, প্রশাসনিকভাবে আদৌ ক্ষতিকর কিনা সেটা অন্য প্রশ্ন। হয়তো ক্ষতিকর নয়। হয়তো ভালোই হবে। অথবা খারাপ হবে। কিন্তু বাঙালির নিজস্ব পলিটিক্যাল আইডেন্টিটি ক্রমেই ব্যাকফুটে চলে যাবে। কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম যেই ক্ষমতায় আসুন দিল্লির অ্যাজেণ্ডায় যদি বাংলার শাসনব্যবস্থা চলে সেটা হবে স্বাধীনতার পর বাংলার রাজনীতির একটি বড়সড় আইডেন্টিটি শিফট। কারণ আমাদের কোনও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জনপ্রিয় নেতানেত্রী থাকলে তাঁকে দিল্লি সমীহ করবে। তিনি বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম যে কোনও দলের হতে পারেন। তাঁর দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও তাঁর রাজ্যের জনপ্রিয়তা ও প্রভাব লক্ষ্য করে চট করে তাঁকে ঘাঁটাতে সাহস পাবেন না। সমীহ করবেন। যেমন জ্যোতিবাবুর একজন পলিটব্যুরো থাকলেও তাঁকে সেভাবে ধমক দেওয়া কিংবা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বাধ্য করেনি সেই শক্তিমান পলিটব্যুরো। তারা জানতো জ্যোতিবাবুর বিকল্প নেই। মমতার সুবিধা হল তিনি বাংলারই দল। তাঁর কোনও দিল্লি পলিটব্যুরো, দিল্লি হাইকমাণ্ড, কিংবা আরএসএস নেই। তিনি একাই সিদ্ধান্তগ্রহণকারী। একইসঙ্গে রাজ্যে প্রবল জনপ্রিয় ও ভোটের বাজারে মূল্যবান জাতীয় স্তরেও। তাই তাঁকে দিল্লি সমীহ করে। তাঁর বিরোধীরাও করে। এই যে দেখা সোশ্যাল মিডিয়ায় সারাদিন ধরে নিত্যদিন ভোর থেকে মমতাকে নিয়ে নানাবিধ মিম, কার্টুন, কবিতা শেয়ার হচ্ছে, ফরওয়ার্ড হয় এসবের মানে কী?
মানে সারাদিন তাঁদের মনকে আচ্ছন্ন করে আছেন মমতা। তাঁরা সারাদিন ধরে ভাবছেন কীভাবে মমতাকে নতুন স্টাইলে অপমান করা যায়। কিন্তু যাঁরা তাঁকে নিয়ে এসব করেন তাঁরা একবারও এটা ভাবেন না যে তাঁদের বুদ্ধিমত্তাকে মমতা গ্রাস করে ফেলেছেন। তাঁরা নিজেদের অমূল্য সময় নষ্ট করে মমতাকে নিয়ে কবিতা লিখছেন, কার্টুন আঁকছেন, মিম তৈরি করছেন। অর্থাৎ তাঁরা নিজেদের যে মেধা ও ইনটেলেক্ট সেটা মমতা কেন্দ্রিক ক্রিয়েশনে ব্যয় করে ফেলছেন। সেই সময়টায় তাঁরা নিজেদের মৌলিক গল্প, উপন্যাস, পেন্টিং, লেখালেখি, গান শোনা, উচ্চ সংস্কৃতির চর্চা, নাটক সিনেমা দেখা এসব করতে পারতেন। কিন্তু করছেন না। তাঁরা মেতে আছেন মমতাকে ঘিরে।
কখনও কি দেখা যায় আমাদের রাজ্যের আর কোনও রাজ্য নেতাকে ঘিরে এসব হয়? হয় না। কারণ তাঁরা সেই উচ্চতা বা জনপ্রিয়তায় যেতে পারছেন না যে তাঁদের সম্পর্কে পজিটিভ অথবা নেগেটিভ কোনও পাবলিসিটিই সেলেবল হবে। অর্থাৎ তাঁদের সম্পর্কে প্রশংসাই হোক অথবা নিন্দা, সেসব কেউ এনজয়ই করবে না। অর্থাৎ তাঁরা সকলেই পাবলিক ডিসকোর্সে নেহাত ইনসিগনিফিকেন্ট। আগ্রহ তৈরি হয় না তাঁদের ঘিরে। ন্যাশনাল মিডিয়া বা ট্যুইটারেও দেখা যায় মমতাকে নিয়ে কভার স্টোরি হয়, কার্টুন হয়। বাংলার আর কোনও নেতানেত্রী স্থান পায় না সেসব আলোচনায়। প্রশ্ন উঠবে তিনি তো মুখ্যমন্ত্রী! তাই গুরুত্বপূর্ণ। একদম ভুল। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে থেকেই ন্যাশনাল পলিটিক্সের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেরকম কোনও কালারফুল, মাল্টিডাইমেনশনাল চরিত্র আর বাংলায় বিরোধী নেতানেত্রী হিসেবে উঠে আসছে না কেন?
এটা একটা চরম ধাক্কা বাঙালির কাছে। আর একজন মমতা হওয়ার দরকার নেই। তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের কেউ আসুন। তাও ভালো। কিন্তু সেটাও তো পাওয়া যাচ্ছে না। এটাই আশঙ্কার। কারণ এই বার্তাটি প্রমাণ করে বাংলার সমাজ থেকে কোনও লিডার কোয়ালিটির আর জন্ম হচ্ছে না। তিনি যে দলের থেকেই আসুন না কেন? আর এটা চলতে থাকলে আগামীদিনে বাঙালির রাজনীতি শুধুই বহিরাগত নেতাদের অনুগামী হবে। নিজেরা আর নেতা খুঁজে পাবে না! কারণ বাঙালি আর লিডার হতে পারছে না। শুধুই সাপোর্টার!