সিপিএমের ৩৪ বছর দেখেছি। সফল অপারেশন বর্গা থেকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে বুদ্ধদেববাবুর অহেতুক দুঃস্বপ্নের ধ্বংসলীলা পর্যন্ত। এখন তৃণমূলের অপ্রতিরোধ্য ৮ বছরের শাসনকাল দেখছি। চতুর্দিকে উন্নয়ন আর অনুপ্রেরণার লহর। এখনও এই বাংলার অকুতোভয় আপসহীন জননেত্রীর নাম মমতা বন্দোপাধ্যায়। অতি বড় নিন্দুকেও স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে বঙ্গেশ্বর জ্যোতি বসু অস্তাচলে যাওয়ার পর আসমুদ্রহিমাচল, এমনকী বিদেশেও চেনে আলোচনা করে এমন একজনই নেতা বা নেত্রী আছেন এই বাংলায়, তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর আর যাঁরা লাফাচ্ছেন, বিস্তর রঙ্গ-তামাশা করে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছেন তাঁদের দূরবীণ দিয়েও খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেই তালিকায় আছেন সূর্যকান্ত মিশ্র থেকে বিমান বসু, সোমেন মিত্র থেকে দিলীপ ঘোষ। এঁরা কেউ সর্বক্ষণের ভালো কর্মী, কেউ তুখোড় বক্তা, পার্টি অফিসে ২৪ ঘণ্টা আঠা লাগিয়ে বসে থাকা নির্ভেজাল সংগঠক, কিন্তু কেউই জননেতা বা নেত্রী নন। তাঁদের একার আহ্বানে জাতি আবেগে ভাসে না, একাত্মও হয় না। জ্যোতি বসু চলে গিয়েছেন ৯ বছর অতিক্রান্ত। বুদ্ধদেববাবু গুরুতর অসুস্থ, পথে নেমে সংগ্রাম আন্দোলন করার ক্ষমতা আর নেই। বামপন্থীদের টানতে পারে এমন কোনও শক্তিশালী মুখ আজ অমিল। বিজেপি শুরু থেকেই এরাজ্যে দল ভাঙার পার্টিতে পরিণত। এই কঠিন রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে একটা নামেই ৪২টা আসনেই ঝড় উঠতে পারে, রাজ্যের বাইরেও নিমেষে তার অভিঘাত পৌঁছে যায় এমন জন-আকর্ষণী ক্ষমতা বোধকরি এই বঙ্গে তৃণমূল নেত্রী ছাড়া আর কারও নেই।
ইদানীং তা একটু টোল খেলেও তাঁর উপস্থিতি ও ব্যক্তিত্বই এখনও এরাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী ভোট ক্যাচার। নীচের তলার সিন্ডিকেট, তোলাবাজি আর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ত্র্যহস্পর্শে কিছুটা জন-আকর্ষণী ক্ষমতার ক্ষয় হলেও এখনও এই হতভাগ্য বাংলা তাঁর বিকল্প খুঁজে পায়নি। তবে, ঘোলাজলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা। উত্তর ভারতে শিকড় আলগা হতেই বিজেপির চোখ পড়েছে পূর্বের বাংলা, বিহার, ওড়িশার দিকে। বিস্তর টাকা ছড়িয়ে, দল ভেঙে গেরুয়া দলের অগ্রগতি কতটা সম্ভব হয়, তাই এবারের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতির সবচেয়ে চর্চিত বিষয়। ঘরে বাইরে সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, এত ঢাক ঢোল পিটিয়ে এরাজ্যে বিজেপি ক’টা আসন পাবে বলুন তো? আট-দশটা আসনে জিতবে, না কি টাকা ছড়িয়ে নানা প্রলোভন দেখিয়েও দুটি আসনের দল হয়েই থেমে থাকবে এরাজ্যের গেরুয়া সংসার!
এতদিন জানতাম আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ অত্যন্ত নীতিনিষ্ঠ একটি সংগঠন। এবং, এই সংগঠনই বিজেপি তথা গেরুয়া শিবিরের মেরুদণ্ড। প্রাণভোমরাও বটে। ধীরে ধীরে দীর্ঘ অনুশীলন, কঠোর প্রশিক্ষণ আর শৃঙ্খলাপরায়ণতার মধ্যে দিয়ে আরএসএস তার প্রতিটি কর্মীকে গড়ে তোলে। এরাই পরে সংগঠনের হাল ধরে, বিস্তারক হিসেবে জেলায় জেলায় গেরুয়া শিবিরের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। কেউ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বে আসীন হন, আবার কেউ বিস্তারক হিসেবেই জীবন কাটান। কিন্তু, সেই শৃঙ্খলাপরায়ণ, নীতিনিষ্ঠ দল কী করে শুধু অন্যের ঘর ভাঙিয়ে প্রার্থী তালিকা তৈরি করে তা অকল্পনীয়। মুখে বলছে তৃণমূল খারাপ, নারদা-সারদার তদন্ত চাই, সবাইকে জেলে পুরব। আর দল ভাঙানো থেকে শুরু করে প্রার্থী তালিকা তৈরির যাবতীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁকে যিনি সারদা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত। একাধিকবার সিবিআই তাঁকে জেরা করেছে। সে-সময় বিজেপি নেতারা মঞ্চে দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়েছেন ‘ভাগ ... ভাগ’! মমতার ব্যাগ বওয়া এবং মমতার করুণায় দেশের মন্ত্রী হওয়া নিমেষে রং বদলানো সেই মানুষটি কী করে বিজেপির সোনার বাংলা গড়ার মূল কারিগর হবেন? সত্যি বলতে কী, অকৃতজ্ঞ, বিশ্বাসঘাতকদের দিয়ে কোন সোনার বাংলা অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদি গড়বেন? তাহলে কি মামলা থেকে বাঁচতে মোদি-অমিত শাহের চরণে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেওয়াই লক্ষ্য, আর সব ফাঁকি। এভাবে পরিবর্তনের বাংলা গড়া কোনওদিন সম্ভব হবে না, হতে পারে না। ক্ষমতা দখলের নেশায় বিষবৃক্ষ বপনের এই দায় একদিন বঙ্গ বিজেপির উপর বর্তাবে। বর্তাবেই। সেদিন দিলীপ ঘোষরা কী বলবেন? নাকি সবটাই চাপিয়ে দেবেন ভিনরাজ্য থেকে আসা এখানকার রীতি পরম্পরা না-জানা অবাঙালি নেতৃত্বের উপর।
এত ঢাক ঢোল পিটিয়ে বিজেপির পক্ষ থেকে কোচবিহারে যাঁকে প্রার্থী করা হল দুর্নীতিমুক্ত বাংলা গড়ার জন্য তাঁর খতিয়ান আরও ভয়ঙ্কর। বিরোধীরা বলছে, সিবিআইয়ের খাতায় তাঁর নাম আছে বেআইনি অস্ত্র ও মানুষ পাচারের অভিযোগে। একাধিক ফৌজদারি মামলা ঝুলছে। কোচবিহারের অপরাধজগৎকে যিনি হাতের তালুর মতো চেনেন, সেই নিশীথ প্রামাণিক হবেন পরিবর্তনের বাংলা গড়ার কাণ্ডারী, কেউ বিশ্বাস করবে? সেই তালিকায় আছেন বারাকপুরের বাহুবলী প্রার্থী অর্জুন সিংও। সবাই তাঁকে চেনে ভাটপাড়ার রবিনহুড হিসেবে। এই সেদিন পর্যন্ত বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারও তৃণমূলের এই গুন্ডাগর্দির বিরুদ্ধে সরব ছিল। সন্ত্রাসের নাগপাশ থেকে বাংলাকে মুক্ত করার অঙ্গীকার করেছিল, আর আজ তৃণমূলের সন্ত্রাসের অন্যতম একটি মুখই তাঁদের সংগঠন বিস্তারের প্রধান ভরসা। কী পরিবর্তন হবে? এ তো খাড়া বড়ি থোড় আর থোড় বড়ি খাড়া!
আর একজনকে নিয়েও এই মুহূর্তে জোর চর্চা চলছে। তাঁর দলবদলের ‘লুচি আলুর দম’ কবে পরিণতি পাবে এখনই বলা না-গেলেও বিধাননগরের তৃণমূল মেয়র সব্যসাচী দত্ত হয়তো বা মনের দিক দিয়ে বিজেপির দিকে পা বাড়িয়ে রেখেছেন। তাঁর কিছু অনুগামী ও পরিবারের তাড়নায় একটু বিলম্ব হচ্ছে হয়তো। সেখানেও আছে সিন্ডিকেটের দখলদারি এবং বারাসত কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী কাকলি ঘোষ দস্তিদারের বনিবনা না-হওয়ার কারণে একটা বিরাট দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সবটাই সংকীর্ণ স্বার্থের লড়াই। বাংলা বাঁচানোর কোনও তাড়না থেকে নয়। শঙ্কুদেব পাণ্ডা, দুলাল বর দল বদলে বিজেপিতে গেলেও প্রার্থীপদ জোটেনি। অর্থাৎ তাঁদের এদিকও গেল, ওদিকও গেল। যেমন সিপিএম ভেঙে বিজেপিতে যাওয়া বিধায়ক খগেন মুর্মু উত্তর মালদহে প্রার্থী হয়েছেন। জেতার আশা কতটা তা জানা নেই, তবে লড়াই হবে। গিয়েছেন সিপিএম থেকে বিতাড়িত বর্ধমানের নেতা আইনুল হক। প্রার্থী হয়েছেন দলত্যাগী হুমায়ুন কবিরও। দল ভাঙানোর এই তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমনকী, পুরুলিয়ায় এবার বিজেপির সংগঠন শক্তিশালী হলেও শেষপর্যন্ত প্রার্থী ঘোষণা থমকে শুধু দল ভেঙে ভিন দলের এক বিধায়কের যোগদানের জন্য। তাজ্জব ব্যাপার! দার্জিলিং কেন্দ্রে যাঁকে গেরুয়া পার্টি প্রার্থী করেছে তিনি মণিপুরের ছেলে। ব্যবসা করেন দিল্লিতে। বিরাট টাকার মালিক। কিন্তু, বিমানবন্দরে নেমেই বললেন, এরাজ্যের ‘৫০টি আসনেই’ নাকি বিজেপি জিতবে! এরাজ্যের লোকসভার আসন সংখ্যা কোন জাদুবলে ৪২ থেকে বেড়ে তাঁর কথায় ৫০ হয়ে গেল, তা তিনিই বলতে পারবেন। একথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, বিজেপি যাঁদের দাঁড় করিয়েছে তাঁদের বাংলা সম্পর্কে ধ্যানধারণা কতটা প্রখর তা তুলে ধরা। এঁদের উপর ভর করে ভবিষ্যতের বাংলার স্বপ্নকে কতটা সাকার হবে বা হওয়া সম্ভব তা অত্যন্ত কষ্টকল্পিত ব্যাপার। তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২৩ মে পর্যন্ত।
তবে একটা জিনিস খুব পরিষ্কার, যিনিই জিতুন এরাজ্যটা ক্রমশ অন্ধকারেই ডুবে যাবে। কোনও রাজনৈতিক দলই নিজের আখের ছাড়া আর কিছু ভাবছে না। যে-কোনও উপায়ে আসন দখলই আজ গণতন্ত্রের একমাত্র লক্ষ্য। কেন পাশ করে এরাজ্যের ছেলেরা এরাজ্যে কাজ পাবে না, তা নিয়ে কারও চিন্তা করার সময় নেই। তার ফলে পুনে, বেঙ্গালুরুতে বাঙালি ছেলেমেয়েদের স্রোত বাড়বে। আর রাজনীতির এই টানাপোড়েনে কমবয়সিরা রাজ্য ছেড়ে পালাবে, রাজ্যটা বৃদ্ধাশ্রমে পরিণত হবে!