লোকসভা ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হল ১১ মার্চ। তার দু’দিন আগে টালা ব্রিজে আটক করা হয় এক হাজার কেজি বিস্ফোরক বোঝাই একটি লরি। কলকাতা পুলিসের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) সেদিন ওইসঙ্গে গ্রেপ্তার করেছে লরির চালক ও খালাসিকে। এসটিএফ এরপর খোঁজখবর করতে করতে শনিবার রাতে ওড়িশা থেকে গ্রেপ্তার করেছে বিস্ফোরক পাচারের মূল পাণ্ডাকে। মুস্তাফা শেখ ওরফে বোম মুস্তাফা নামে ওই দুষ্কৃতী দাঁতনের বাসিন্দা। পুলিসি তদন্তে প্রকাশ, ওই বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ওড়িশার থেকে আনা হচ্ছিল। পাঠানো হচ্ছিল উত্তর ২৪ পরগনায়। মতলব ছিল—ভোট জালিয়াতি করার জন্য বোমা বানানো। বিশাখাপত্তনমের একটি সংস্থার নামও এই জড়িয়ে গিয়েছে এই ঘটনায়। সেখান থেকেও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের জেরা করে পুলিসের চক্ষু চড়ক অবস্থা! তারাই ফাঁস করে দেয় মুস্তাফার নাম। তাদের বয়ান অনুসারে, মুস্তাফাই হল এই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক কারবারের মাথা। বিভিন্ন জায়গার দুষ্কৃতীদের গ্যাং বিস্ফোরক সংগ্রহের অর্ডার তাকেই দেয়। তার মাধ্যমে প্রায় রোজই হাজার হাজার কেজি বিস্ফোরক বিভিন্ন জায়গায় পাচার করা হয়। কলকাতায় এই লরি ধরা পড়তেই মুস্তাফা দাঁতন ছেড়ে পালিয়ে যায়।
তদন্তে পুলিস জানতে পারে, এই কীর্তিমান মানুষ মারার সরঞ্জাম যাদের সাপ্লাই করে থাকে তাদেরই কোনও একটি ডেরায় শেল্টার নিয়েছে এবং ডেরা পাল্টে পাল্টেই পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে চলেছে। তার ফলে একাধিক বার প্রায় নাগালে পেয়েও এই ধূর্তটাকে তারা ধরতে পারেনি। তবু, হাল ছেড়ে দেয়নি পুলিস। একটু দেরিতে হলেও অবশেষে তাকে পাকড়াও করেছে এসটিএএফ। মুস্তাফার হাতযশে পশ্চিমবঙ্গের বেআইনি বাজি কারখানাগুলি যেমন চনমনে থাকে, তেমনি তার কদর অন্যকিছু রাজ্যের দুষ্কৃতীমহলেও। ভিন রাজ্যের কারা এবং কী উদ্দেশ্যে এত বিস্ফোরক সংগ্রহ এবং মজুত করত তা জানা জরুরি। আরও জানা দরকার, মুস্তাফার মতো গুণধরের সঙ্গে জেহাদি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির সম্পর্ক কী। কারণ, গোয়েন্দাদের কাছে খবর হল—নাশকতার সঙ্গে জড়িত একাধিক জঙ্গি সংগঠন মুস্তাফার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক কিনেছে। আরও ভয় এই কারণে যে, উত্তর ২৪ পরগনা হল বাংলাদেশ-লাগোয়া এলাকা। হাসিনা সরকার জেহাদি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির উপর বরাবর খড়্গহস্ত। তাই তাদের অনেকে ভারতে শেল্টার খুঁজে থাকে। অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশি জঙ্গিদের সবচেয়ে সুবিধা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করা। তারপর সেখান থেকে তারা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে। একাধিক জঙ্গি সংগঠনের মডিউল এই বঙ্গে সক্রিয়। স্লিপার সেলের সদস্যরা বিস্ফোরক তৈরির টেনিং নিচ্ছে বলেও পুলিসের হাতে তথ্য উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে। স্লিপার সেলের সদস্যদের বোম মুস্তাফা কীভাবে সাহায্য করত—পুলিস তা জানার চেষ্টা করছে। এদের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা অভিজ্ঞতা অত্যন্ত খারাপ। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন এক তীব্র বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল বর্ধমান শহরের অদূরে খাগড়াগড়। ওই ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হয়। ঘটনাটি ঘটেছিল একটি বাড়ির ভিতরে। সেখান থেকে পুলিস উদ্ধার করে ৫৫টি ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস, আরডিএক্স, বোমা তৈরির আরও নানাবিধ সরঞ্জামসহ অনেক কিছু। ঘটনাটিতে বাংলাদেশ সরকারও নড়েচড়ে বসে। কারণ, এই ঘটনায় যুক্তরা মূলত বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে আসা জেএমবি জঙ্গি। ঘটনাটির রেশ এখনও কাটেনি। খাগড়াগড় বিস্ফোরণে জড়িত একজনকে গত ফ্রেবুয়ারিতেও ধরা হয়েছে। অসমের বাসিন্দা হলেও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কেরল থেকে। তার কিছুদিন আগে দু’জন ধরা পড়েছে হুগলি থেকে।
পরিস্থিতি যখন এই, তখন বোম মুস্তাফার গ্রেপ্তারের ঘটনাটিকে হালকা করে দেখার সুযোগ কোনোভাবেই নেই। ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ রাখার প্রয়োজনে আপাতত জানা দরকার—মুস্তাফার গ্যাংয়ের মাধ্যমে আর কত জায়গায়, কাদের কাছে এবং কী পরিমাণ বিস্ফোরক মজুত হয়েছে। সেইমতো পদক্ষেপ নিতে হবে। তার পরেই আসবে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার পরিবেশ স্বাভাবিক রাখার প্রশ্ন। আশা করা যায়, রাজ্য প্রশাসন সেইমতোই সতর্ক এবং তৎপর রয়েছে।