শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
গড়পড়তা বাংলাদেশের মানুষকে জিজ্ঞাসা করুন, বলবেন, পুজোর মরশুমে পাড়ায় পাড়ায় লতা মঙ্গেশকরের গলায়, ‘মঙ্গলদীপ জ্বেলে অন্ধকারে দু’চোখ আলোয় ভরো প্রভু’ শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন। ঘনীভূত আঁধার-তাড়ানোর উজ্জীবন মন্ত্র খুঁজে পেয়েছেন এই গানের মধ্যে। উৎসব মানেই ব্যাকুল অপেক্ষার শেষ। যা মানুষকে মেলায়, দূরত্ব কমায়। বাংলাদেশে পঞ্চাশের দশকেও দুর্গাপুজো ছিল গ্রামকেন্দ্রিক এক আনন্দঘন আয়োজন। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই পুজো হতো এবং স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ধর্মীয় ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠে সার্বিক সহযোগিতা করতেন। দুর্গাপুজো মণ্ডপের আঙ্গিনায় রামায়ণ কীর্তন, পালাগান, কবির লড়াই হওয়ার দৃশ্য ছিল গ্রামের সব অংশের মানুষের মাঝে আনন্দঘন এক মহামিলনের কেন্দ্রবিন্দু। দুর্গাপুজো উপলক্ষে মেলাপ্রাঙ্গনে বসত আনন্দমেলা, তাতে নাগরদোলা থেকে আরম্ভ করে মুরগি লড়াই—সবই ছিল বিশাল আয়োজনের অংশ। বাংলাদেশে যাঁদের বয়স এখন ষাটের বেশি, তাঁরা সবাই বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এই উৎসবকে উপভোগ করেছেন। নারকেলের বিভিন্ন রকমের ছাঁচের সন্দেশ, নাড়ু, নানা রকমের পিঠে-মিঠাই-মণ্ডা সবই ছিল বাংলার শারদীয় উৎসবের প্রধান আকর্ষণ এবং মিলনমেলার অংশ। এখন অবশ্য দুর্গাপুজো মূলত শহরকেন্দ্রিক। বাংলাদেশে রোজার মাস না আসতেই যেমন শুরু হয় ঈদ-সংখ্যা প্রকাশের প্রস্তুতি, তেমনই আজকাল পুজো বা শারদসংখ্যা প্রকাশের আয়োজনও চোখে পড়ার মতো। পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে শুরু করে নতুন ঢাকায় গুলশন-বনানী পুজোমণ্ডপ থেকেও প্রকাশ হতে শুরু করেছে ঢাউস মাপের পুজোবার্ষিকী। অনলাইন পত্রিকাতেও চলছে শারদীয়ার নানা আয়োজন। ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উৎসবের উন্মুক্ততা। মন্দিরকেন্দ্রিক দুর্গোৎসব ছাপিয়ে এখন ঢাকার মাঠেও বসছে পুজোর আয়োজন। গত কয়েক বছর ধরে কলাবাগান বা গুলশন-বনানী মাঠে পুজোমণ্ডপের বিস্তৃতি এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঢাকাবাসীর একে অপরকে আপন করে নেওয়ার প্রবণতা বুঝিয়ে দিচ্ছে, উৎসব এসেছে সর্বজনীন আবাহনে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গুলশন-বনানী পুজোমণ্ডপে প্রবেশের দৃশ্য দেখলে বোঝা যায়, অসাম্প্রদায়িক মিলন সরণীতেই বাঙালির প্রকৃত অধিবাস।
ঢাকার বনানীতে আয়োজিত সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটি প্রকাশ করে ‘বোধন’ নামে একটি সঙ্কলন। গত বছর এই সঙ্কলনেই অভিনেতা ফেরদৌস স্মৃতিচারণ করে লিখেছিলেন, ‘আমার এলাকা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। নারায়ণগঞ্জে বেড়ে ওঠার সময় থেকেই পুজোয় প্রচুর আনন্দ করতাম। ঈদ আর পুজো আমাদের কাছে তখন সমার্থক ছিল। প্রতিমা তৈরি, বিশাল আয়োজন, ঢাকের বাদ্যি, সব কিছু কী যে ভালো লাগত! সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল প্রসাদ দেওয়ার সময়টা। আমাদের মধ্যে কে হিন্দু আর কে মুসলমান, সেটা বড় কথা নয়। উৎসবটাই আসল।’ দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে কত পরিবারে পুজোর গল্প ছড়িয়ে রয়েছে এপার বাংলায়। আর ওপারে? দগ্ধ প্রাণের মরণ চিৎকার হয়ে ওঠা সেই জামাত বাহিনীর ধর্মান্ধতার মিছিলের হুঙ্কার। জঙ্গি হামলার আতঙ্কের মেঘ। মৌলবাদীদের নাশকতা, অসহিষ্ণুতা, নিষ্ঠুরতার মহামারীকে উপড়ে ফেলে আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্লোগান তুলতে হয়, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়ে দিয়েছেন, আসন্ন দুর্গোৎসবে গোটা দেশে পুজো মণ্ডপগুলির নিরাপত্তায় থাকবেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ নিরাপত্তা কর্মী। এবার বাংলাদেশে পুজো মণ্ডপের সংখ্যা ৩১,১০০। গত বছরের তুলনায় এবার এক হাজার বেশি। শুধু ঢাকা মহানগরীতেই গত বছরের তুলনায় ২৩৭টি পুজোমণ্ডপ বেড়েছে। এসব পুজো মণ্ডপের আশপাশে পুলিস, র্যা ব ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মীরা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন। সঙ্গে মণ্ডপে মণ্ডপে সিসিটিভি’র নজরদারি। এছাড়া হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর ও আর্চওয়ে স্থাপনের জন্যও বলা হয়েছে। প্রতিটি মণ্ডপে স্থানীয়দের সমন্বয়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটি গড়া হবে। স্বেচ্ছাসেবকও থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তারা সমন্বয় করে কাজ করবে। এবার পুজোমণ্ডপে মহিলা স্বেচ্ছাসেবকও থাকছে। জেলা সদর ও উপ জেলা সদরে খোলা হবে পুলিস কন্ট্রোল রুম। সব মিলিয়ে সাজ সাজ রব।
ব্যস্ত এখন রাজশাহীর প্রতিমা শিল্পী, বরিশালের পুজো উদযাপন কমিটি ও খুলনার প্যান্ডেল-মঞ্চের কারিগররা। সেজে উঠছে ঢাকেশ্বরী মন্দির, রমনা কালীবাড়ি, রামকৃষ্ণ মিশন, বনানী পুজো মণ্ডপ, কলাবাগান পুজো মণ্ডপ, শাঁখারিবাজার, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, ব্রাহ্মসমাজের পুজো মণ্ডপ। পুরনো ঢাকার পুজো মণ্ডপে দেখা মেলে ঐতিহ্যের। সঙ্গে থাকে ইতিহাস। সেখানে বনানী মাঠে খোঁজ মেলে আধুনিকতার। মেলা বসে পুরনো ঢাকার শাঁখারিবাজার এলাকায়। শাঁখারিবাজার, তাঁতিবাজার, সূত্রাপুর এলাকা ভরে ওঠে মণ্ডপে মণ্ডপে। এলাকার মন্দিরগুলিও সাজানো হয়। ধনীর দুয়ার থেকে কাঙালিনীর কুটির—একইভাবে দেখা দেন জগৎজননী। হোক না, পুজো থেকে ঈদ, সাহিত্য থেকে সংবাদ, সব ক্ষেত্রেই এপার ওপার আলাদা। আলাদা, তবে এর মধ্যেও যে শিকড়ের টান জুড়ে রেখেছে দুই বাংলাকে, তার মূল্যও তো কম নয়। শারদোৎসব ঘিরে সেই ঐক্যের সুর কখনও সীমান্তের কাঁটাতার মানেনি। এপারের মতো ওপারেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণের চণ্ডীপাঠেই দুর্গাপুজো শুরু হয়। আজও। বাংলাদেশে দুর্গাপুজোর উৎসব শুধু হিন্দুদের নয়, সবার।