স্বদেশের বা বিদেশের নামী প্রতিষ্ঠানে বিদ্যালাভের সুযোগ পেতে পারেন। সব কাজে কমবেশি সাফল্যের যোগ। আয় ... বিশদ
উনিশ শতকের গোড়ার দিককার কথা। পত্র-পত্রিকার জন্য ছবি তুলে সেটা ছাপানোর কথা তো দূরে থাক, সে সময় মেয়েরা ঘরের বাইরে বেরনোর কথাই সেভাবে ভাবতে পারত না। তখন যাঁরা নারীদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে পথ দেখিয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম হোমাই ভিয়ারাওয়ালা। যিনি ছবি তোলাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা চিত্র সাংবাদিক। ২০১৭ সালে তাঁকে সম্মান জানিয়ে তৈরি করা হয়েছিল গুগল ডুডল আর্ট, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ফার্স্ট লেডি অব দ্য লেন্স’।
হোমাই নামের থেকেও তিনি ডালডা ১৩ নামে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯১৩ সালে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর, তিনি প্রথম ছবিও ১৩ বছর বয়সেই তুলেছিলেন। প্রথম গাড়ির নম্বর ছিল ডিএলডি-১৩। এই ১৩ সংখ্যা তাঁর জীবনে ঘুরে ফিরে এসেছে বলেই ছদ্মনাম নেন ডালডা ১৩।
তাঁর বাবা দোসসাভাই হাতিরাম ছিলেন উর্দু-পার্সি মঞ্চের অভিনেতা। তিনি ট্রাভেলিং থিয়েটারে কাজ করতেন, তাই প্রায়শই তাঁদের ঠিকানা বদল হতো। হোমাইয়ের মা, সুনাভাই হাতিরাম। ঘরে অভাব অনটন সত্ত্বেও হোমাইকে কখনও কোনও কাজে বাধা দেননি বাবা মা।
তাঁকে ছবি তোলা শেখান তাঁর প্রেমিক মানেকশ ভিয়ারাওয়ালা, যিনি একটি ইংরেজি দৈনিকে কর্মরত ছিলেন। যখন তিনি কলেজে পড়তেন সেই সময় একটি পিকনিকে ছবি তোলার অ্যাসাইনমেন্ট পান। সেগুলো ছাপা হয় ‘দ্য বম্বে ক্রনিকল’ নামে স্থানীয় সংবাদপত্রে। তারপর তিনি ফ্রিলান্স কাজ শুরু করেন।
প্রথমদিকে হোমাই যে ছবিগুলো তুলতেন, সেগুলো নিজের নামে ছাপাতে সংকোচ বোধ করতেন। একে মেয়ে, তায় অপরিচিত— তাই নিজের তোলা ছবি মানেকশ-র নামে ছাপাতেন। নাগরিক জীবন এবং আধুনিক তরুণীদের নিয়ে তোলা তাঁর ছবি সেই সময় ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’ এবং ‘বম্বে ক্রনিকল’-এ বের হতো। ১৯৪২ সালে তিনি ব্রিটিশ ইনফর্মেশন সার্ভিসে যোগ দিয়ে দিল্লি চলে যান। তারপর থেকেই নিজের নামে ছবি ছাপাতে শুরু করেন তিনি।
স্বাধীন দেশে গড়ে ওঠা স্টিল প্ল্যান্ট, বাঁধ, লালকেল্লায় প্রথম জাতীয় পতাকার উত্তোলন, রাষ্ট্রপতি ভবনে মাউন্টব্যাটেনের গান স্যালুট, মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুসজ্জা, বিংশ শতকে ভারতে আসা বিখ্যাত মানুষদের ছবিও ক্যামেরাবন্দি করেছেন তিনি। মার্টিন লুথার কিং থেকে শুরু করে মার্শাল টিটো, জুনিয়র হো চি মিন, ক্রুশ্চেভের মতো নেতাদের ছবিও তুলেছেন তিনি। ১৯৫৬ সালে ভারতে আসেন দলাই লামা। হোমাই ‘টাইম-লাইফের’ জন্য দলাই লামার ছবি লেন্সবন্দি করেন। ভারতের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘অনলুকার’ এবং ‘কারেন্ট’ হোমাইয়ের কাছে জনপ্রিয় সুদর্শনা নারীদের ছবি তুলে দেওয়ার অনুরোধ করলে তিনি রানি এলিজাবেথ এবং আমেরিকার ফার্স্ট লেডি জ্যাকি কেনেডির ছবি তুলেছিলেন। ছবি তোলার সময় শাড়ি পরতেই ভালোবাসতেন তিনি। এই শাড়ি পরার জন্য সহকর্মীরা ঠাট্টা করে মাম্মি বলে ডাকতেন তাঁকে!
হোমাই মনে করতেন এক বর্ণের ছবি অনেকদিন টিকে থাকে। সেই কারণে তিনি সাদা-কালো ছবি তুলতে বেশি পছন্দ করতেন। দিল্লির ‘দ্য অ্যালকাজি ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস’ কর্তৃপক্ষ হোমাই-এর তোলা আলোকচিত্রগুলো তাদের ‘চিরকালীন সংগ্রহ’ হিসাবে সংরক্ষণ করে তাঁকে সম্মান প্রদান করেন। পেশাগত জীবনে বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি।
১৯৯৬ সালে হোমাইয়ের জীবন অবলম্বন করে ডালডা থার্টিন (Dalda 13) নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে ‘ব্রিটিশ আর্ট কাউন্সিল’। এবং ২০০৬ সালে ‘ইন্ডিয়া ইন ফোকাস: ক্যামেরা ক্রনিক্যালস অব হোমাই ভিয়ারাওয়ালা’ নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে।
হোমাই ভিয়ারাওয়ালার ছবি তোলার পেছনে প্রেরণা ছিলেন তাঁর স্বামী মানেকশ। ১৯৭০ সালে মানেকশর মৃত্যু হয়, আর তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ছবি তোলাও ছেড়ে দেন হোমাই। শেষ জীবনে তিনি জন্মস্থান গুজরাতে চলে আসেন। বরদাতে একটি ছোট্ট বাসা বানান। ২০১২ সালের ১৫ জানুয়ারি ৯৮ বছর বয়সে মৃত্যু হয় ফার্স্ট লেডি অব দ্য লেন্স হোমাই ভিয়ারাওয়ালার।