ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বাধায় চিন্তা ও উদ্বেগ। বেকারদের ভালো প্রতিষ্ঠানে কর্মপ্রাপ্তির প্রবল যোগ। ... বিশদ
চৈত্রমাস পড়লে মামাবাড়ির দিনগুলোতে ফিরে যেতাম। শুধু কী ফিরে যেতাম। উদগ্রীব হয়ে উঠতাম। মনে মনে শুরু হয়ে যেত দিনগণনা। হাতের কর গুনে গুনে হিসেব রাখতাম—কদিনের দিনে পড়বে চৈত পরব। চৈত্র সংক্রান্তি তিথি। সেই মতো পরবের দিন কতক আগে সাইকেল ছেড়ে দিতা মামাবাড়ির উদ্দেশে। মামাবাড়ির গ্রামটি অদ্ভুত সুন্দর। নামখানিও। বান্দরবনি। লালগড়ের উপকণ্ঠে।
কাঁসাই নদীর ওপারে লালগড়। এই পারে মামাবাড়ির গ্রাম। বান্দরবনি। কেউ কেউ বাঁদরবনিও ডাকে। অবশ্য শুরুতে এ গাঁয়ের নাম এমন ছিল না। সুদুর অতীতে কোনও একসময় কাঁসাই নদী তখন কী গভীরতায়, কী চওড়ায় আড়ে বহরে ফুলে ফেঁপে টইটম্বুর ছিল। তখনকার দিনে বড় বড় সব নৌকা ভিড়ত। এমনকী জাহাজও নাকি ভিড়ত তখন। বান্দরবনির ঘাটে। তখন এ নদীর নাম আজকের কাঁসাই হয়নি। তখন এ নদীর নাম ছিল কপিশা। দামোদর তখন দামুন্দা। ওদিকে তখন বাণিজ্য বন্দর বলতে তাম্রলিপ্ত। হলদি রূপনারায়ণ হয়ে কাঁসাই বা কপিশায় এসে ভিড়ত বাণিজ্য তরী। এখানকার জঙ্গলের সুঠাম শাল বল্লরি চালান হয়ে চলে যেত বিদেশ বিভূঁইয়ে। ক্রমে জায়গাটি চোরা বন্দর হিসেবে পরিচিতি পায়। সেই বন্দর থেকে হয় বন্দর বন। তারপর আজকের বান্দরবনি।
আমাদের সেইসব কিশোর দিনে টাঁড় টিকর মাতিয়ে রাখত। বিশেষ এই চৈতালি ঝুমুর।
‘এই তেল মাখামাখি, আর হল্যদ মাখামাখি। চইত পরব চলে আইলো হে, হবেক দেখাদেখি।।’
দশ বিশ দূরের গাঁয়ে ঢোল নাগড়ার গম্ভীর আওয়াজ পৌঁছে দিতে সবচেয়ে বড় আকারের জোড়া ধামসা বা নাগড়াতে চলত তেল মাখামাখি। এই তেল মাখানো দেখতে তখন আমি আর মামাতো দাদা বুড়োদা’র সঙ্গে চলে যেতাম সাইকেলে করে ছেঁড়াবনি। কখনও ‘নহর খাল’ ডিঙিয়ে গিয়ে উঠতাম মাটিহানা গ্রামে। চৈত্র পরবের আগের প্রস্ততি, মুহূর্তগুলো উপভোগ করতেই ছুটে যেতাম কেঁউদি হয়ে গঙ্গাধর পুর। ছো নাচের বিশেষ গ্রাম।
রেষারেষি চলত এই দুটিতে। একটি ‘মাটিহানা ছো নৃত্য পার্টি’। অন্যটি ‘গঙ্গাধরপুর ছো নৃত্য দল’। রেষারেষি চলত নাচের সঙ্গে বাজনার। বাজনার সঙ্গে শূন্যে বাজির। বীররসের সঙ্গে করুণ রসের। কসরত চলত গানে আর সখীনাচে। ছো এর আখড়ায় সখীনাচের মেয়ে সাজত যেসব ছেলেরা তাদের কাঁচা হলুদ লেপন করা হতো হাতে, পায়ে এবং নাভীর উপরিভাগে। তারপর যখন পুকুরে কিংবা খালে হালকা অবগাহন সেরে গায়ে লাল গামছা চড়িয়ে গোচারণের মাঠে আসত সব দল বেঁধে। নাচ অনুশীলন করত। তারিয়ে তারিয়ে দেখতাম। তখন ওদের কী রূপ, কী রূপ। রাতে নাচের আসরে তো চিনতেই পারতাম না। এরা ছেলে না মেয়ে। গান শুরু হতো— ‘বঁধার গায়ে লাল গামছা চটক দেখে মরি রে... ’
চৈত্রমাস পড়লে মায়েদের মধ্যেও তখন তুমুল ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত। কেননা পরবের জন্য চাল, চিড়া, মুড়ি এসবের তো দরকার। চালের পাত্র পরিপূর্ণ রাখা চাই। মুড়ির পাত্রও পরিপূর্ণ না হলে চলবে না। এইসময় একটু বেশিই মুড়ির জোগাড় রাখতে হবে। মুড়ি পিশে তো ছাতু হবে। ছাতু কুঁড়া না হলে কীসের চৈত্র পরব। অতএব, বিকেলবেলা শাল জঙ্গলে গিয়ে শুকনো ডালপালা জোগাড় কর। তারপর ধান ভাপাও। ভাপানো হলে ফের গরম জলে ভিজিয়ে রাখ। ভোরবেলা উঠে ‘ভুসচুলা’তে এবার সেদ্ধ কর। তারপর রোদে শুকাও। মেশিনে ভানাও। কুলোতে পাছড়াও। চাল তো হল। এবার সে চালে লবণ গোলা জল আর খাওয়া সোডা মাখিয়ে ফের রোদে দাও। মুড়ি ভাজ। এবার ঢেঁকিতে লাইন দাও। এইভাবে নানান হ্যাপা সামলে মায়েরা ভাবল এবার নিস্তার। সন্তান স্বামী আর পরিবারের মুখে ছাতু তুলে দিতে পারলে বেঁচে যায়। ততক্ষণে চৈত্র গাজনের বাদ্যি বেজে যায় যে। আর যে বছর পরিবারের কোনও প্রিয়জন মারা যায়। সেবছর ছাতু পরব মানানো হয় না। তখন খুব কষ্ট হতো। প্রতিবেশী কেউ এসে ছাতু দিয়ে যাক। এমনটাই চাইতাম তখন। মায়েরাও হয়তো চাইত সন্তান আর পরিবারের জন্য।
বর্তমানে রেডিমেড ছাতু প্যাকেটবন্দি হয়ে বাজারে এসে গেছে। যেটাতে মায়ের হাতের ছোঁয়া নেই। কোথাও চৈত্র-সংক্রান্তির দিন, কোথাও তার একদিন আগে সারহুল পরব মানানো হয়। দিনটি কৌম সমাজের মানুষের কাছে নিয়ম নিষ্ঠার ও পালনীয়। শুভক্ষণ এলেই আমরা সারহুল মানাই। পরব মানি। পূর্বপুরুষ ও কৌম সমাজের আদিপিতার উদ্দেশে ‘ভূত পিঁড়া’ তে অর্পণ করা হয় আম, মহুল, আর শালফুল। ওইদিন গ্রামের জাহিরা বা গরাম থানে হয় বিশেষ পুজো। যার পূজারী লায়া।
সারহুল দুটি শব্দ দিয়ে গঠিত। সার এবং হুল। সার মানে সরাই বা শারোই ফুল। হুল মানে বিপ্লব। এভাবেই সাখুয়া ফুলের বিপ্লবকে সারহুল বলা হয়। মুণ্ডারি, সাঁওতালি ও হো-ভাষায় সরহুলকে বলা হয়‘বা’ অথবা ‘বাহা পরব’, ‘খাদি’ বা ‘খেখেল বেঞ্জা’, ‘কুডুখ’, ‘নাগপুরী’, ‘পাঁচপারগানিয়া’, ‘খোর্টা’ ও কুড়মালি ভাষায় এই উৎসবকে বলা হয় ‘সারহুল’।
এই সারহুল পুজো সাঙ্গ হলে লায়া তার উৎসর্গিত শালফুল নিয়ে কুড়মি গ্রামের প্রত্যেকটা ঘরে গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় তা রেখে আসেন। এবং পরম্পরাগত ভাবে লায়া মহাশয়ের পা ধুইয়ে হলুদ ও তেল মাখিয়ে সম্মাননা জানান আর কী।
অনুরূপ, সাঁওতাল মুন্ডা ও হো সমাজে এটিকে বলা হয় বাহা। সমাজের নির্দিষ্ট সারনাস্থানে অর্পণ করা হয় অরণ্যের প্রথম ফুল ও পাতা। মেয়েরা মাথায় ফুল গুঁজে। প্রিয় পুরুষের জন্য সাজে। হলুদ শাড়ি আর বাহারি বনফুলে আর পাহাড়ি ঝুমকো লতার ফুলে সেজে ওঠে। শেষ বিকেলের আলোয় নেচে উঠে গোটা মহল্লা।
দুই
—বুড়াবাবার চরণে সেবা লাগে মহাদেব।
—কার সেবা?
—বাবার সেবা।
—কে লাগায়?
—বাবার ভক্ত।
—কে হয়?
—গাজনের সন্ন্যাসী।
—কেমন সন্ন্যাসী?
—সিদ্ধিখোর, ভাঙখোর
—বাবার তরে কী চাই?
—একছিলিম গঞ্জিকা আর দেবেন কলিকা।
—মা গো সেবা দাও।
—কী সেবা?
—চাল দাও।
—আর?
—তেল দাও।
—তেল দি কী হবেক?
—ওমা তাও জাননি। তেল দি তেল হলদা হবে গো।
বুড়া বাবা আমাদের আদিপিতা। যিনি সৃষ্টি করেছেন কামনা বাসনা। যিনি শিখিয়েছেন চাষবাস। আমার বাবা। বাবার বাবা। তারও বাবা। বুড়া বাবা। এই বুড়া বাবাই ভোলে মাহাদেব। শ্মশানে মশানে থাকেন। ছাইভস্ম মাখেন। এমনিতে তিনি হিমশীতল। রাগলে রূদ্র। সংসার বিবাগী। আবার সংসার জীবনের পরীক্ষকও তিনি। বাবা সন্ন্যাসী। এমন সন্ন্যিসী জীবনের সাধনা মনুষ্যলোকে দুর্লভ। ভোগ বাসনায় ডুবে থাকা জীবন হাঁপিয়ে ওঠে। সব ছেড়ে সন্ন্যাসী হতে চায়। পারে না। উল্টে হয়ে যায় গাজনের সন্ন্যাসী। কয়েকদিনের শুদ্ধাচার জীবন যাপন। নুন খাবে না। মেয়ে মানুষের শরীর ছোঁবে না। তেল ছোঁবে না। মাটি মাখবে। মাটিতে শয়ন করবে। বাবার কাছে বৃষ্টি চাইবে। মাঠভর্তি ফসল চাইবে। তিনবেলার আহার চাইবে। আর কিচ্ছু না।
ভোগ বাসনায় পরিপূর্ণ সংসারী জীবন শুধু খেয়েই চলেছে। দিনভর খাওয়া। এমনকী রাতেও। এদিকে তুমুল খাদ্যসংকট। এমতাবস্থায় বাবা পাঠালেন তাঁর প্রিয় ষাঁড়কে। বলে পাঠালেন মনুষ্যসমাজ যেন ধর্মচর্চা করে। একবেলা আহার গ্রহণ করে আর তিনবেলা স্নান করে। ষাঁড় তো মর্তের আবাদ খেয়ে বেমালুম ভুলে গেল। উল্টে বলে বসল— ‘হে মনুষ্যজাতি তোমরা সব তিনবেলা আহার কর। আর একবার আচমন কর।’
বাবা বুঝলেন মহা কেলেঙ্কারি। এমনিতেই খাদ্যসংকট। ষাঁড়ের বুদ্ধিতে দেখছি আর দেশ চলবে না। যা ভুল করলি, তোর উত্তরপুরুষ বংশ পরম্পরায় খেটে মরবে মানুষের গোয়ালে।
বাবার কী, এমনিতেই ভিক্ষে মেলে না। রইল ঝোলা চলল ভোলা।