প্রিয়ব্রত দত্ত: সি এইচ থ্রি মিথেন না, সি এইচ ফোর মিথেন, সেই নিয়ে তুমুল তর্ক। রমজানের দোতলা মাটির বাড়ির দাওয়ায়। অংশগ্রহণকারীরা হলেন ইন্দ্রাশিস আচার্য, লোকনাথ দে, ঋত্বিক চক্রবর্তী, শ্রেয়া সিনহা। ইন্দ্রাশিসকে ইন্ডাস্ট্রি চেনে পরিচালক হিসেবে। স্ক্রিপ্ট, মনিটর, অ্যাকশন, কাট ফেলে ইন্দ্রাশিস তখন রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপকের ভূমিকায়। বোঝাচ্ছেন, ‘সি এইচ ফোর মিথেন।’ দাওয়ায় অস্থায়ী ক্লাসঘর। দেওয়ালে ঝোলানো ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকা যৌগ চার্ট দেখে ইন্দ্রাশিস বলে চলেছেন, ‘একটা হাইড্রোজেনের ঘর ফাঁকা আছে, যে কোনও জায়গায় লাগতে পারে।’ শুনে ঋত্বিকের সংযোজন, ‘মুক্ত হাইড্রোজেন। ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র।’ অসহায়ের মতো লোকনাথের কৈফিয়ত, ‘কী যে সব বলল, হাইড্রোজেন বেরিয়ে যাবে, ক্লোরিন এসে ঢুকবে। যা বলতে বলছে বলে দিলাম। কী কঠিন কেমেস্ট্রি।’ ঋত্বিকের টিপন্নি, ‘কারে দিয়েছে মাস্টারের পাঠ’। ফের দমফাটা হাসির হুল্লোড়। 
গুলিয়ে যাচ্ছিল সব। সিনেমার শ্যুটিং নাকি কেমেস্ট্রির ক্লাস! এমন সময়ে সহকারী সৌমেনের চিৎকার, ‘শট রেডি।’ মুহূর্তে মস্করা বন্ধ। লোকনাথ একটা ঘুপচি প্রায়ান্ধকার ঘরে বেড়ে রাখা ভাতের থালার সামনে গিয়ে বসলেন। তাঁর সামনে একটা ছোট টুলে ঋত্বিক। মিনিট খানেক আগের হালকা পরিবেশ উধাও। ঋত্বিক-লোকনাথ একে অপরের প্রতিপক্ষ। উন্নয়নমুখী মাস্টারকে (লোকনাথ) সাবধান করে দিতে এসেছে রাজেন (ঋত্বিক)। সঙ্গে চ্যালা। রাগে থরথর করে কাঁপছে মাস্টার। দু’জনের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। হুমকি দিয়ে রাজেন ও চ্যালার প্রস্থান। গুম হয়ে বসে মাস্টার। ‘কাট...। এক্সেলেন্ট শট।’ বাড়ির গোয়াল ঘরে রাখা মনিটরের সামনে বসে বলে উঠলেন ইন্দ্রাশিস। 
সাজানো গোছানো ফ্লোর নয়। মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জে বেণীপুর গ্রামের জনৈক রমজানের বাড়িটিই ইন্দ্রাশিসের নতুন ছবি ‘গাজনের ধুলোবালি’র ভরকেন্দ্র। ছবিতে জায়গাটির নাম গাজন। সেখানকার জমি আন্দোলনকে ঘিরে এই পলিটিক্যাল থ্রিলার তৈরিতে ব্যস্ত পরিচালক।  বললেন, ‘এই ছবিটার আলাদা রকম ক্রাফটিং, যার অ্যাকশন, গতি, ভাষা একেবারেই আমার আগের ছবিগুলো থেকে আলাদা। মানুষের ভালোবাসা ও ঘৃণা দুটোই এখন মাত্রাতিরিক্ত জায়গায় চলে যাচ্ছে। এই দুটো জায়গা থেকেই যতরকম ভায়োলেন্সের সূত্রপাত। ছবিতে হিংসা স্বাভাবিক পরিণতিতে এসেছে। আমার আগের ছবিগুলো ছিল মানুষের ইনার কনফ্লিক্টকে কেন্দ্র করে। এটা সোসাইটির কনফ্লিক্ট।’ 
কথা হচ্ছিল খোলা প্রান্তরে। খেয়াল হয়নি গোটা গাঁয়ের মানুষ ততক্ষণে সেজেগুজে রমজানের বাড়ির সামনে হাজির। ওঁরা ‘দিদি’কে দেখতে এসেছেন। তখন দুপুর দুটো। রান্নাবান্না সকাল সকাল সেরে পাটভাঙা কাপড় পরে সেই দশটা থেকে ওঁরা ঋতুদিদির অপেক্ষায়। এদিকে ছবির নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত শটের ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছেন মাটির ঘরে। ভক্তদের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলেন না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে প্রান্তিক মানুষগুলোর উদ্দেশ্য নায়িকার জিজ্ঞাসা, ‘কেমন আছ তোমরা? আমার ভালোবাসা নিও।’ উপস্থিত প্রায় পাঁচশো কন্ঠস্বরের পাল্টা জিজ্ঞাসা, ‘তুমি কেমন আছ?’ ক্লান্ত কন্ঠে ঋতুপর্ণার উত্তর, ‘আমি ভালো আছি। এবার বাড়ি যাও সব।’ গ্রামবাসীদের মুখে তখন মুঠোয় চাঁদ ধরার উল্লাস। তা দেখে তৃপ্ত মুখে মেঠো বারান্দার কাঠের রেলিং এ ঠেস দিয়ে বসে ছবির ‘অমৃতা’ ঋতুপর্ণা বললেন, ‘এই ভালোবাসা, আশীর্বাদই আমার এনার্জি।’ 
অমৃতা গাজনে এসেছে তার নিখোঁজ সাংবাদিক স্বামীর সন্ধানে। ‘মেয়েটি একরকম মন নিয়ে আসে, আর একরকম মন নিয়ে ফিরে যায়। এই মাঝের সময়টুকুতে সে অনেক সম্পর্ককে আবিষ্কার করে। তা ভালোয় মন্দয় মেশানো। ঋতুপর্ণার ভাষায়, ‘আমি যখন ইন্দ্রাশিসের সঙ্গে ‘গুড বাই মাউন্টেন’ করছিলাম, তার আগে থেকেই ও ‘গাজনের ধুলোবালি’র স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিল। গ্রাম্য সমাজের অন্ধকার দিকটা থাকবে এখানে।’ 
নাছোড় ভক্তকূল তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। সেই দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলেন শ্রেয়া সিনহা। এই ছবির নবাগতা অভিনেত্রী। বললেন, ‘এই স্টারডমটা একদিনে হয় না। ঋতুদির সঙ্গে কাজ করতে করতে বুঝছি স্টার হতে গেলে সাধনা লাগে।’ ছবিতে শ্রেয়ার চরিত্রের নাম শ্রীতমা। অমৃতার সমান্তরাল চরিত্র। কেরিয়ারের শুরুতেই ঋতুপর্ণার সঙ্গে এতখানি স্ক্রিন শেয়ার করতে পারার উত্তেজনা ধরা পড়ল থিয়েটার কর্মী শ্রেয়ার কথায়। 
ছবি: দীপেশ মুখোপাধ্যায়