অদিতি বসুরায়: শিবের দাদার মৃতদেহ থেকে যে রক্ত রাস্তাকে লাল করেছিল, হুবহু সেই রঙের রক্তই লতিফের আব্বার মৃত্যুর কারণ। লতিফের ক্রোধ তাকে টেনে নিয়ে যায় সন্ত্রাসবাদের পথে। সপরিবারে শিব বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদের প্রায় সবটাই যে শাসকের চক্রান্ত তা বুঝতে পারে না, যারা গীতা বা কোরানের অজুহাতে মানুষ মারে। বুঝতে পারে না, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান এই পরিচয় দিয়ে মানুষকে ঘর-ছাড়া করা, হত্যা করা অন্যায়। শুধু জন্মসূত্রে হিন্দু হওয়ার ‘অপরাধে’ দীর্ঘদিনের প্রতিবেশীকে জ্বালিয়ে দেওয়া যতখানি অন্যায়, ঠিক ততখানিই অন্যায় মসজিদে যাওয়া মুসলিমকে কেটে ফেলা। ট্র্যাজেডি হল, গত কয়েক শতক ধরে পৃথিবী অচল করে দেওয়া গণহত্যা এবং সন্ত্রাসের অন্যতম কারণ হিসেবে যে জিনিসটা উঠে এসেছে, তার নাম ধর্ম। একে ভিত্তি বানিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে রাজনীতি। তাই নিজের মহল্লা থেকে এক ঘণ্টার নোটিসে উঠে যেতে হয় শিবকুমারের মতো প্রায় চার লক্ষ কাশ্মীরি পণ্ডিতকে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত উচ্চকোটির এই সম্প্রদায় মুহূর্তের মধ্যে এমন অবস্থায় পৌঁছে যায় যে, রিফিউজি ক্যাম্পে পাওয়া একটিমাত্র টোম্যাটো হয়ে ওঠে তাঁদের সারাদিনের আহার। রাতারাতি সর্বস্ব হারিয়ে ফেলা মানুষ তবু বাঁচার চেষ্টা করে! রিফিউজি ক্যাম্পে ইস্কুল বসে। শাড়ি দিয়ে দেওয়াল তৈরি হয়। বিধুবিনোদ চোপড়া ‘শিকারা’ ছবিতে শিবকুমার ধরকে কেন্দ্র করে যে কাহিনী বুনেছেন, তা অনেকটাই বাস্তবে গত শতক থেকে কাশ্মীরে ঘটে চলা ঘটনাবলির পুনর্নির্মাণ। শিবকুমার এবং শান্তির জীবন আরও প্রায় চার লক্ষ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের থেকে ব্যতিক্রমী নয়। বরং তাদের সঙ্গে ফুটে উঠেছে সেই সব অসহায় কাশ্মীরির কথা, যারা আজও বাড়ি ফিরতে পারেনি। কোনওদিন ফিরতে পারবে কিনা তারও ঠিক নেই। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলে-পুড়ে গিয়েছে। তবে এই জ্বলন্ত হিংসার মাঝে শিকারা নিটোল ভালোবাসার গল্প বলে। শিবকুমার ও শান্তির প্রেমের গল্প। মুহূর্তে রিফিউজি বনে যাওয়া এই কাশ্মীরি পণ্ডিত দম্পতি বুলেট- তলোয়ারের প্রেক্ষাপটে পরস্পরের হাত ধরে রাখতে অঙ্গীকার করে।
উপত্যকায় বিদ্বেষের সমান্তরালে বয়ে চলা মানবিক জীবনপ্রবাহকে নিয়ে ছবি আগেও আমরা দেখেছি। সেই দিক থেকে পরিচালক বিধুবিনোদ চোপড়া নতুন কিছু করতে পারেননি। তবে তাঁর নির্মোহ গল্প বলার পদ্ধতিটি সুখকর। তিনি কোনও পক্ষ যেমন অবলম্বন করেননি তেমনই তাঁর বক্তব্যও জোরালো হয়ে উঠতে পারেনি। রূপকথার মতো একটি প্রেমের গল্প বলতে চেয়েছেন – যেখানে প্রায় সবকিছুই মোলায়েম এবং সুন্দর। তাই শরণার্থী শিবিরের দৃশ্যগুলি তেমন কষ্ট তৈরি করতে পারে না। বরং জম্মু যাওয়ার পথের দৃশ্যটি তুলনায় অনেক সংবেদনশীল। রিফিউজি ক্যাম্পে এক বৃদ্ধের ঘরে ফেরার আকুতি মান্টোকে মনে পড়িয়ে দিতে বাধ্য। শিব এবং শান্তির ভূমিকায় আদিল খান ও সাদিয়া দু’জনেই প্রথম ছবিতে ভালো কাজ করেছেন। এ আর রহমানের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর যথাযথ। ছবিটির বক্তব্য এবং বেশ কিছু দৃশ্য সর্বজনীন ও অতুলনীয়। ‘শিকারা’-কে ভালোবাসার গল্প হিসেবে ধরে নিতে পারলে, নৌকা ভেসে যাবে— আগুন আর বায়ু থেকে রসদ খুঁজে নিয়ে।