কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। উকিল, মৃৎশিল্পীদের শুভ। সংক্রমণ থেকে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। আর্থিক ... বিশদ
বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে এর প্রতিষ্ঠাতা সোনম ওয়াংচুকের কথা। ১৯৬৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর জম্মু ও কাশ্মীরের লে জেলায় তাঁর জন্ম। নয় বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কোনও স্কুলে পড়েননি। কারণ তাঁর গ্রামে কোনও স্কুল ছিল না। মায়ের হাত ধরে মাতৃভাষাতেই শুরু হয়েছিল তাঁর বুনিয়াদি শিক্ষা। তাঁর বাবা সোনম ওয়াঙ্গিয়াল একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। যিনি পরবর্তীকালে মন্ত্রীও হন। শ্রীনগরে থাকতেন। এসময় সোনম ওয়াংচুককেও শ্রীনগরে নিয়ে আসা হয়। তিনি সেখানকার স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু বাঁধাধরা নিয়ম, কৃত্রিম ঝলমলে দৃশ্য — এসব তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি কোনওদিনই। তিনি সবসময়ই ভাবতেন রূঢ় বিবর্ণ বাস্তবের কথা। ভাবতেন নিজ এলাকার শিক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সোনম যেখানে থাকতেন সেখানকার বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরাই দশম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষায় অকৃতকার্য হতো। তাদের পক্ষে দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তি তো দূরের কথা, পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো তারা।
ওয়াংচুকের মতে, পরীক্ষায় খারাপ ফলের পিছনে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, সমানভাবে দায়ী অসামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থাও। শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার ও অকৃতকার্য ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার মূল স্রোতে ফেরানোর স্বপ্ন দেখতেন সোনম। ১৯৮৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পরই সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিলেন। নিজের মনের মতো একটি আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করলেন। নাম দিলেন ‘স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ’, সংক্ষেপে এসইসিওএল।
লাদাখের ফে গ্রামে বিশ একর জমির ওপর গড়ে উঠল এসইসিওএল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বই-খাতার অপেক্ষা হাতে-কলমে পড়াশোনাই বেশি শেখানো হয়। একজন ছাত্র শুধু বইয়ের শিক্ষা নয় বরং বইয়ের শিক্ষাকে যাতে বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারে এটাই এই প্রতিষ্ঠান মূল উদ্দেশ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা হয় সৌরশক্তি দিয়ে। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের খাবার, বাসস্থানের ব্যবস্থা করে। গ্রিন হাউসের মাধ্যমে উৎপাদন হয় ফল ও সব্জি। গোরু, ছাগল সহ বিভিন্ন গবাদি পশু পালন করে ছাত্রছাত্রীরা। তাদের থাকার ঘর মাটি ও ছোট কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি। তাই শীতকালে ঘরের ভেতর বেশি তাপমাত্রা এবং গরমকালে কম তাপমাত্রা থাকে। তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় সব জিনিস নিজেরাই তৈরি করে। ছোট বাজার তৈরি করে প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রিও করে তারা।
এসইসিওএল-এর নিজস্ব ট্রাভেল এজেন্সিও রয়েছে, যার নাম ‘অ্যারাউন্ড স্টুডেন্টস উইদ লাদাখ’। এই হাতে-কলমে শিক্ষাই একজন শিক্ষার্থীকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলে। ফলস্বরূপ তারা জীবনের যেকোনও পরিস্থিতিতে, যেকোনও পরিবেশে মানিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। কেউ করছেন ব্যবসা, কেউবা সাংবাদিকতা। কেউ হয়তো কোনও সংস্থার কর্ণধার। চলচ্চিত্র নির্মাতাও আছেন এঁদের মধ্যে। সকলেই একাধিকবার মাধ্যমিকে অকৃতকার্ষ হয়ে এখানে এসেছিলেন। স্রোতের বিপরীতে হেঁটে এই সাফল্য অর্জন বিশ্বের কাছে নিঃসন্দেহে একটি উদাহরণ। এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সামনে রেখেই জনপ্রিয় সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়েটস’ তৈরি হয়েছিল। সমাজের কাছে, পরিচিতদের চোখে যখন কেউ ইডিয়েট হিসেবে পরিণত হয়, তাদের সেই বোকামিও যে কীভাবে বদলে দিতে পারে সবার ধারণা, পাল্টে দিতে পারে সেই ইডিয়েটদের জীবন, তাদের স্বপ্নগুলোকে কীভাবে বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, থ্রি ইডিয়েটস সেই চিত্রটাই দেখিয়েছে রুপোলি পর্দায়। আর বাস্তবের মাটিতে সেটা করে দেখিয়েছে এসইসিওএল।
নিজের পছন্দের বিষয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নেওয়ায় বাবার সঙ্গে মতবিরোধ হয় সোনমের। তাই নিজের পড়াশোনার ব্যয়ভার নিজেই সামলেছেন। তবু তিনি হাল ছাড়েননি। সাফল্যের সঙ্গে কৃতকার্য হয়েছেন, তাঁর স্বপ্নকেও সাকার করেছেন। ফ্রান্সের গ্রেনোবেলে ক্যাটার স্কুল অব আর্কিটেকচারে উচ্চতর অধ্যয়ন করেছেন তিনি। সাসপোলের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কুল সংস্কার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এসইসিওএল সরকারি শিক্ষা বিভাগ ও গ্রামের জনসাধারণের সহায়তায় অপারেশন নিউ হোপ চালু করে। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ওয়াংচুক এমএস-এর শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি বরফের স্তূপের একটি প্রোটোটাইপ উদ্ভাবন করেন। প্রোটোটাইপটি হল এমন এক কৃত্রিম হিমবাহ, যা শীতকালে নষ্ট হওয়া স্রোতের জলকে বিশালাকার বরফ শঙ্কু বা স্তূপের আকারে সংরক্ষণ করে। আবার বসন্তের শেষে যখন বরফ গলতে শুরু করে তখন প্রচুর পরিমাণ জল এই স্তুপ থেকে নিষ্কাশিত হয় যা কৃষিকাজে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
জম্মু ও কাশ্মীর স্টেট বোর্ড অব স্কুল এডুকেশনে ২০১৩ সালে তিনি নিযুক্ত হন। পরের বছর জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য শিক্ষা নীতি এবং ভিশন ডকুমেন্ট প্রণয়নের জন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেলেও তাঁর স্থান হয়। ২০১৬ তে ফার্মস্টেস লাদাখ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেন। লাদাখের ছাত্রছাত্রীদের বারবার অনুরোধে তিনি এনএলএম-দি নিউ লাদাখ মুভমেন্ট- এর প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। এর মূল লক্ষ্য, শিক্ষার পরিবেশ প্রস্তুত ও অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা। ২০০২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গ্লোবাল অ্যাওয়ার্ড ফর সাসটেইনেবল আর্কিটেকচার, রোলেক্স আওয়ার্ড ফর এন্টারপ্রাইজ, রিয়াল হিরোস অ্যাওয়ার্ড, অশোকা ফেলোশিপ ফর সোশ্যাল এন্টারপ্রেনারশিপ, রামন ম্যাগসাইসাই প্রভৃতি বিভিন্ন পুরস্কারের ভূষিত হন ওয়াংচুক।স্রোতের বিপরীতে হেঁটে, গড্ডালিকা প্রবাহে না ভেসে, শেষ হয়ে যাওয়া হিসেব থেকে অঙ্কটাকে শুরু করে কীভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করা যায়, জীবনের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়িত করা যায়— সেই পথ আমাদের দেখিয়েছে সোনম ও তাঁর প্রতিষ্ঠান এসইসিওএল-এর শিক্ষানীতি।