দুঃসাহসিক দক্ষিণ
মেরু অভিযান
অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে আঠাশ জন সঙ্গীকে নিয়ে আন্টার্কটিকার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন শ্যাকলটন। অভিযান চলাকালীন হঠাৎ বরফ জমা সাগরে ভেঙে পড়ল জাহাজ। কী হল তারপর? লিখেছেন সুপ্রিয় নায়েক।
তুষার দেশ
দুম করে একটা শব্দ হল। কোনও কিছুর সঙ্গে জোর ধাক্কা লেগেছে জাহাজের। জাহাজটা দুলেও উঠল প্রবলভাবে। কেবিনে বসেছিলেন শ্যাকলটন। হাতের ম্যাপটা পাশে সরিয়ে রেখে সঙ্গে সঙ্গে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন ডেকে। ফের ধাক্কার শব্দ! শ্যাকলটন দ্রুত ডেক থেকে জাহাজের নীচে তাকালেন। এতক্ষণ সাগরের ওপর জমে থাকা বরফের চাদর ছিল তুলনায় পাতলা। সেই বরফের চাঙড় ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলছিল জাহাজ। তবে বরফের চাদর ক্রমশ মোটা হচ্ছে। তাই ধাক্কা লাগছে বারবার। গতি কমছে জাহাজের। শ্যাকলটন সাগরের দিকে নজর ফেরালেন।
যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই শুধু বরফ। দানবাকৃতি কিছু হিমশৈলকে দূরে ভেসে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। শুভ্র বরফে রোদ পড়ে তৈরি হচ্ছে সাতরঙা আলোর বিভ্রম! এ দৃশ্য যেমন সুন্দর, তেমনই ভয়ঙ্কর! তিন মাস্তুল আর ৩৫০ অশ্বশক্তির এই ওক কাঠের জাহাজটির নাম এনডিওরেন্স। সেই জাহাজ বরফের চাদর ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে মৃদুমন্দ গতিতে। কিন্তু জাহাজের অবস্থান ঠিক কোথায়? শ্যাকলটন ডেকে পাঠালেন ফ্র্যাঙ্ক ওর্সলিকে। ওর্সলি জাহাজের ক্যাপ্টেন। ওর্সলির কাছে জাহাজের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলেন শ্যাকলটন। ওর্সলি দিকনির্দেশক সেক্সটান্ট যন্ত্র বের করে নিজেদের অবস্থান বুঝে নিয়ে শ্যাকলটনকে বললেন— ‘আজ ১৯১৫ সালের ১১ জানুয়ারি। আমরা ওয়েডেল সাগরের পূর্ব দিকে রয়েছি। ভেহসেল উপসাগর থেকে চারশো মাইল দূরে। এভাবে চলতে থাকলে দিন দশেক পরে কূলে পা রাখা সম্ভব হবে।’
পাঁচদিনে ২০০ মাইল এগনো গেল এভাবেই। তবে ব্যাপারটা যতখানি সহজ ভাবা হয়েছিল ততখানি সহজ হল না। ১৬ জানুয়ারি হঠাৎ শুরু হল প্রবল ঝড়! ক্রুদ্ধ প্রকৃতি যেন রাগ প্রকাশের জন্য বেছে নিয়েছিল এই বিশাল তুষারাবৃত সমুদ্রকে। হাওয়ার তাণ্ডব দেখে মনে হচ্ছিল এই বুঝি খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে এনডিওরেন্স! সবকটা পাল নামিয়ে চুপটি করে বরফের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া অন্য উপায় রইল না এনডিওরেন্সের।
দুঃস্বপ্নের মতো ভয়াবহ সেই ঝড় থামল ক’দিন পর। ইঞ্জিন চালু করে এগনো শুরু হল। তখনও কেউ জানত না, সামনের দিনগুলোয় অপেক্ষা করে আছে আরও বড় দুর্যোগ। মাইল দশেক এগনোর পরে বোঝা গেল পথ বন্ধ। পুরু বরফের চাদরে, হিমশৈলে জলপথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে! জাহাজ সম্পূর্ণভাবে আটকে পড়ল সেই বরফের ফাঁদে। ক্রমশ জাহাজের ওপর বাড়তে শুরু করল বরফের চাপ। জাহাজে ছিলেন আঠাশ জন যাত্রী। প্রত্যেকেরই রাতে ঘুম এল না এক ফোঁটা। কারণ বিকট শব্দে মাঝেমধ্যেই ফেটে যাচ্ছিল বিশালাকৃতি বরফের চাঙড়! শ্যাকলটন বুঝতে পারছিলেন যে কোনও সময় বরফের চাপে দেশলাই বাক্সের মতো গুঁড়িয়ে যাবে কাঠের এনডিওরেন্স! তারপর কী হবে কেউ জানে না। যা ভয় করা হয়েছিল তাই ঘটল। মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ল এনডিওরেন্স। কনকনে ঠান্ডা জল ঢুকতে শুরু করলে জাহাজে। শ্যাকলটন সকলকে জাহাজ ছেড়ে বরফে নেমে আসতে বললেন। তবে নামার আগে জাহাজ থেকে তিনটে ছোট নৌকা, বেঁচে থাকা খাবারদাবার নামিয়ে নিতে বললেন। এভাবেই সভ্যজগৎ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে, তুষার ও মারাত্মক ঝড়ের সাম্রাজ্যে সম্পূর্ণ অদৃষ্টের হাতে পড়ল আঠাশ জন মানুষ। কিন্তু কে এই শ্যাকলটন? পৃথিবীর কোন প্রান্তে এসে আটকে পড়লেন তাঁরা?
অভিযান
পৃথিবীর যে কোনও অংশে, আজকাল বিপদে পড়লে মোবাইল ফোনের সাহায্যে ডেকে নেওয়া যায় বিপর্যয় মোকাবিলা দলকে। একশো বছরের বেশি সময় আগে জীবন এত সহজ ছিল না। পরিবহণ ব্যবস্থাও এতটা সহজ হয়নি। যে কেউ যখন খুশি যেখানে সেখানে যেতে পারত না। এরোপ্লেন তখন সবে আবিষ্কার হয়েছে। রেডিও ব্যবস্থারও তেমন উন্নত হয়নি। স্যাটেলাইট আর মোবাইল ফোন তো অনেক দূরের ব্যাপার। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল টেলিগ্রাম, চিঠি আর ল্যান্ডলাইন টেলিফোন। তারপরেও মানুষ দুঃসাহসিক অভিযানে বেরিয়ে পড়তে ভয় পেত না। হিংস্র প্রকৃতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা অজানা, দুর্গম প্রদেশকে চিনে নেওয়ার, জয় করার নেশা ছিল মানুষের রক্তে। আর্নেস্ট শ্যাকলটন ছিলেন এমনই একজন। আয়ারল্যান্ডে এক অ্যাংলো-আইরিশ পরিবারে জন্ম শ্যাকলটনের। পরে তাঁরা দক্ষিণ লন্ডনে চলে আসে। বড় হয়ে শ্যাকলটন নানা ভয়ঙ্কর অভিযানে শামিল হয়েছিলেন। তাঁর বুকে ছিল অ্যাডভেঞ্চারের প্রবল নেশা। ১৯১৪ সাল নাগাদ শ্যাকলটন ঠিক করলেন দক্ষিণ মেরুর দিকে যাত্রা করবেন। শুরু হল জোগাড়যন্ত্র। সঙ্গে নিলেন ভরসার কিছু মানুষ, বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, আবহাওয়াবিদ, ভূ-বিদ, রান্নার লোক। পরিকল্পনা মতো ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে শুরু হল যাত্রা।
পরিকল্পনা
শ্যাকলটন পরিকল্পনা করেছিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া ডক থেকে এনডিওরেন্সকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। যাত্রা শুরুর দু’মাস পরে সমুদ্রপথে তাঁরা পৌঁছবেন আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ারসে। সেখান থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে পৌঁছবেন দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপে। দ্বীপের একদিকে খাড়া বরফে ঢাকা পাহাড়। অন্য প্রান্তে একখানি ছোট বন্দর। বন্দর সংলগ্ন জায়গায় রয়েছে কয়েকটি কারখানা। এই কারখানায় তিমি মাছের তেল বের করা হয়। আসলে সেই সময় তিমি মাছই ছিল জ্বালানি তেলের অন্যমত উৎস। শ্যাকলটনের পরিকল্পনা ছিল, দক্ষিণ জর্জিয়া থেকে তাঁরা যাবেন দক্ষিণ মেরুর গা ঘেঁষে থাকা ওয়েডেল সাগরে। তারপর ভাসতে ভাসতে পৌঁছবেন ভেহসেল উপসাগরে। এরপর তীরে নামার পর পায়ে হেঁটে পোঁছবেন দক্ষিণ মেরুতে। দক্ষিণ মেরুর মাঝামাঝি বিন্দু স্পর্শ করবেন। তারপর এগিয়ে যাবেন সামনে। থামবেন দক্ষিণ মেরুর অপর প্রান্তের রস সাগরে। সেখানে পরিকল্পনা মতো দাঁড়িয়ে থাকবে অরোরা নামে একখানি জাহাজ। সেই জাহাজে চেপে কাছাকাছি মহাদেশে পা রাখবেন।
বরফের সাম্রাজ্যে
পরিকল্পনা মতোই ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপে নোঙর করল এনডিওরেন্স। যাত্রা শুরুর পর থেকে ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে প্রায় চার মাস। দক্ষিণ জর্জিয়ায় আরও মাসখানেক কাটিয়ে শ্যাকলটন বেরিয়ে পড়লেন ওয়েডেল সাগরের দিকে। ১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ওয়েডেল সাগরে প্রবেশের পর বরফ ঠেলে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। তারপরেই আন্টার্কটিকা মহাদেশের ভূখণ্ড থেকে প্রায় ১০০ মাইল দূরে তাঁদের জাহাজ আটকে পড়ল বরফে। লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছেও তাঁদের হাল ছাড়তে হল।
টিকে থাকার যুদ্ধ
জাহাজ আটকে পড়ায় বরফে নেমে আসতে হয়েছে সবাইকে। শ্যাকলটনের তখন একটাই উদ্দেশ্য— যে করেই হোক সঙ্গীদের সভ্য জগতে পৌঁছে দিতে হবে। তিনি হিসেব করে দেখলেন তাঁদের কাছে রয়েছে তিনটি নৌকা। শ্যাকলটন জানতেন গ্রীষ্মকালে বরফ গলতে শুরু করবে। তখন নৌকায় চেপে কাছাকাছি কোনও দ্বীপে আশ্রয় নেওয়া যাবে। ততদিন যেভাবেই হোক টিকে থাকতে হবে। কিন্তু টিকে থাকার জন্য দরকার খাদ্যের। অথচ যেটুকু খাবার ছিল তার সবটাই প্রায় শেষ হতে শুরু করল। পায়ে হেঁটে বরফের ওপর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কারণ বরফের চাদরে সব জায়গায় সমান পুরু নয়। যখন তখন ফাটল ধরছে বরফে। তৈরি হচ্ছে বিরাট ফাঁক। যে কোনও সময় তলিয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা। তার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই ক্যাম্পে আক্রমণ করছে সামুদ্রিক চিতা! এখানেই শেষ নয়। প্রকৃতি এখানে সর্বদাই ক্রুদ্ধ। ফলে একটানা ঝড়, তার সঙ্গে তুষারপাত ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সূর্যের মুখ প্রায় দেখাই যেত না। কয়েকজনের শরীরে নোনা জল আর বরফ লেগে তৈরি হল দগদগে ঘা। গরম জামাকাপড়গুলিও ক্রমশ ছিঁড়ে যেতে শুরু করল। আর প্রবল ঠান্ডায় প্রত্যেকের রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হতো। শ্যাকলটন দেখলেন এভাবে চললে সবাই বেঘোরে মারা পড়বে। ওদিকে খাবারের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। শরীরে রক্ত যাতে না জমে যায় তাই তিনি সকলকে শারীরিক প্ররিশ্রমের কাজে যুক্ত করলেন। খাদ্য সংগ্রহে কয়েকজনকে পাঠালেন সিল মাছ শিকারে। বেশ কয়েকটা সিল মাছ পাওয়া গেল। তাই দিয়ে কয়েকদিনের খাদ্য সঙ্কট দূর হল। তবে সবসময় কি আর সিল মাছ মেলে? কখনও কখনও খালি হাতেও ফিরতে হতো। অনাহার, অর্ধাহারে থেকে ক্রমশ শীর্ণকায় হয়ে যাচ্ছিলেন অভিযাত্রীরা। এভাবে শেষ হয়ে গেল ১৯১৫ সাল। অর্থাৎ যাত্রা শুরুর পর থেকে কেটে গেল প্রায় দীর্ঘ দেড় বছর।
ইতিমধ্যে বরফ গলতে শুরু করল। আর ওর্সলি একটা জরুরি তথ্য শ্যাকলটনকে জানালেন। তাঁরা বরফের চাদরের উপরে ক্যাম্প করে আছেন ঠিকই। তবে বরফের চাদর আসলে ভাসছে সাগরের জলের ওপর। সাগরের স্রোত সেই বরফের চাদরকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে ক্রমশ এলিফ্যান্ট আইল্যান্ডের দিকে। শ্যাকলটন চোয়াল শক্ত করলেন। কারণ এলিফ্যান্ট দ্বীপের অবস্থান আন্টার্কটিকা মহাদেশের ভূমি থেকে অনেক দূরে। তাছাড়া ওই দ্বীপের কাছের সমুদ্র সর্বদাই থাকে প্রবল উত্তাল। ভয়ঙ্কর ঝড়ের দাপটে সেখানে কী হবে কেউ জানে না। এদিকে বরফের চাদর আরও গলে গেল। শেষ পর্যন্ত আর বরফে ভেসে থাকা যাবে না বুঝে তিনটি নৌকায় উঠে পড়লেন সকল যাত্রীরা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল প্রবল ঝড়। চারদিক আঁধার হয়ে এল। প্রবল হাওয়ায় দাপটে নৌকা ডুবে যাওয়ার জোগাড়! জল ঢুকতে শুরু করল নৌকার ভিতরে। তবে মৃতপ্রায় ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় সকলে এলিফ্যান্ট দ্বীপে পৌঁছতে সক্ষম হলেন।
এলিফ্যান্ট দ্বীপ
বসবাসের জন্য এলিফ্যান্ট দ্বীপ অনুপযুক্ত। সর্বক্ষণ সামুদ্রিক ঝড় আছড়ে পড়ছে দ্বীপে। তার সঙ্গে খাদ্যের অভাব তো আছেই। শ্যাকলটন কয়েকদিন এলিফ্যান্ট দ্বীপে রইলেন। অভিযাত্রীদের নির্দেশ দিলেন পাথর দিয়ে ঘর তৈরি করার। সব ব্যবস্থা পাকা করে শ্যাকলটন ঠিক করলেন, পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে নৌকা করে পাড়ি দেবেন সাহায্যের খোঁজে। ঠিক করা হল সাড়ে আটশো মাইল দূরে দক্ষিণ জর্জিয়ায় পৌঁছবেন তাঁরা। এই সেই দ্বীপ, যেখানে তিমি থেকে তেল বের করার কারখানা আছে।
একটা ছোট নৌকায় চেপে ওর্সলি এবং আরও চারজনকে সঙ্গে নিয়ে শ্যাকলটন ভেসে পড়লেন আটলান্টিক মহাসাগরের বিপদসঙ্কুল পথে। কথাটা শুনতে যত সহজ, বিষয়টা ছিল ঢের বেশি কঠিন। একটা মোচার খোলার মতোই সমুদ্রে ভাসছিল শ্যাকলটনের নৌকা। পাহাড়প্রমাণ ঢেউ বারবার নাস্তানাবুদ করতে চাইছিল শ্যাকলটনের নৌকাকে। তার সঙ্গে ছিল ভয়াবহ বৃষ্টি আর ঝড়। প্রায় প্রতি ঘণ্টায় পালা করে নৌকা থেকে জল বের করতে হচ্ছিল যাত্রীদের। একসময় খাবার জলটুকুও শেষ হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ। তৃষ্ণায় জিভ হয়ে গিয়েছিল মোটা। নৌকার দুলুনির চোটে কেউ ঘুমোতে পারত না। ২২ দিন পর, শারীরিক ও মানসিকভাবে সকলে যখন ক্লান্ত ঠিক তখনই দেখা মিলল দক্ষিণ জর্জিয়া দ্বীপের। তবে দ্বীপের যে প্রান্তে বন্দর, তার ঠিক বিপরীত প্রান্তে পৌঁছল নৌকা। দ্বীপের এই প্রান্তে বিশালকায় খাড়া পাহাড়। শ্যাকলটন হতাশ হলেন। তবে ভেঙে পড়লেন না।
বরফে ঢাকা পাহাড়
শ্যাকলটনকে এবার পৌঁছতে হবে দ্বীপের বিপরীত প্রান্তের বন্দরের কারখানায়। কিন্তু সেখানে যেতে হলে পেরতে হবে বরফে ঢাকা পাহাড়। সমুদ্রপথে ঘুরে সেখানে যাওয়া যেতে পারে। তবে তাতে সময় লাগবে অনেক বেশি। তাই শ্যাকলটন ঠিক করলেন হাঁটা পথেই পেরবেন দ্বীপ। ওর্সলি আর ক্রেন নামে এক ব্যক্তিকে নিয়ে শ্যাকলটন শুরু করলেন যাত্রা। ভয়াবহ সেই রাস্তা। কখনও তাঁদের পেরতে হচ্ছিল খাড়া পাহাড়। আবার কখনও গড়িয়ে নামতে হচ্ছিল সেই লম্বা পাহাড় থেকে। হাতে যন্ত্রপাতি বলতে ছিল একটা ছোট কোদাল আর দড়ি। সেই দড়ি দিয়েই পরস্পরকে বেঁধে শ্যাকলটন ও তাঁর সঙ্গীরা এগিয়ে চললেন তুষারে মোড়া পাহাড়ি পথে। এমনকী রাতে চাঁদের আলোয় ওরা পেরলেন বরফের চাদরে ঢাকা উপসাগর। তিনদিন একটানা পথ চলে তাঁরা পৌঁছলেন বন্দরে। ততদিনে ওদের তিনজনের অবস্থা খুব খারাপ। মাথার চুলে জট পাকিয়ে গিয়েছে। মুখে দাড়ির জঙ্গল। জামাকাপড় শতছিন্ন।
এলিফ্যান্ট দ্বীপে যাত্রা
বন্দরের লোকজন তাঁদের দেখতে পেয়ে ঘরে নিয়ে গেল। স্নান, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। দ্বীপের অপর প্রান্তের বাকি তিনজনকেও নিয়ে আসার ব্যবস্থা হল। খাবারদাবার খেয়ে, বিশ্রাম নিয়ে খানিক সুস্থ হলেন তাঁরা। তবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরেও নিজের কর্তব্য ভোলেননি শ্যাকলটন। চেষ্টা চালিয়ে গেলেন একটা জাহাজ জোগাড় করে ফেলে আসা সঙ্গীদের কাছে যাওয়ার। বহুবার ব্যর্থ হলেন। এভাবেই কেটে গেল আরও তিনমাস। অবশেষে চিলি সরকারের দেওয়া ছোট একটি জাহাজ ‘ইয়েলকো’য় চেপে রওনা দিলেন এলিফ্যান্ট দ্বীপের উদ্দেশ্যে। সঙ্গী হলেন ওর্সলি। ১৯১৬ সালের আগস্টের ৩০ তারিখে ওর্সলি তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন— ‘সকাল ১১ টা ১০ মিনিট। দূর থেকে এলিফ্যান্ট দ্বীপের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে!’
বেঁচে আছে ওরা?
দ্বীপ থেকে কয়েক মাইল দূরে জাহাজ থামল।
একটা ছোট নৌকায় চেপে শ্যাকলটন এলেন দ্বীপের কাছাকাছি। দেখলেন কূলে দাঁড়িয়ে আছেন তার কবেকার সঙ্গী ফ্রাঙ্ক ওয়াইল্ড। ওয়াইল্ড-এর ভরসাতেই বাকিদের রেখে এসেছিলেন শ্যাকলটন।
‘সবাই কেমন আছ?’— নৌকা থেকে চেঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন শ্যাকলটন।
শীর্ণকায় ওয়াইল্ড তীর থেকে জবাব দিলেন— ‘অল সেফ, অল ওয়েল’।
শ্যাকলটন কি চোখ মুছলেন? দেখা গেল না। শুধু বললেন, যে যেমন অবস্থায় আছেন তাদের সেই অবস্থাতেই নৌকায় উঠে আসতে বলুন। আমরা জাহাজে চেপে ফিরে যাব বাড়িতে।
সকলকে নৌকায় চাপিয়ে জাহাজে ওঠালেন শ্যাকলটন। এবার পূর্ণ গতিতে ছুটে চলল ইয়েলকো— সভ্য জগতের দিকে।
শ্যাকলটন ছিলেন যোগ্য নেতা। ভয়ঙ্কর দুর্যোগে, সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাতে পড়েও তিনি সঙ্গীদের ছেড়ে পালাননি। সবাইকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ঘরে। এমনকী তাঁর অভিজ্ঞতা দক্ষিণ মেরু সম্পর্কে অনেক অজানা দিক খুলে দিয়েছিল। তাই যাত্রা সফল না হওয়ার পরেও, তাঁর দুঃসাহসিক অভিযানের কথা এখনও ফেরে লোকমুখে।
29th August, 2021