কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। উকিল, মৃৎশিল্পীদের শুভ। সংক্রমণ থেকে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। আর্থিক ... বিশদ
কলেজ জীবনে খুব পপুলার ছিলেন। ডিবেট, স্পোর্টস, কালচারাল প্রোগ্রাম সবেতেই তাঁর মুখ্য ভূমিকা থাকত। জুনিয়ররা অপাদি বলতে অজ্ঞান ছিল। সমবয়সিরাও অপরাজিতার গুণগান করতে পিছপা হতো না। অথচ সেই অপা আজ নিজেকে মূর্খ ভেবে বসে আছেন।
বিশেষ করে তার দশ বছরের নাতি পুপুল যখন তাকে নিয়ে টানাটানি করে আর বলে, ‘চল চল ঠাম্মা আমি তোমাকে পড়াব। আমি তোমাকে শেখাব।’ ‘ওরে আমার মাস্টারমশাই পুপুলবাবু। এক সরস্বতীর পুজোর দিনে আমিই তোর হাতেখড়ি দিয়েছিলাম, জানিস?’
‘জানি, জানি। কতবার শুনেছি। তোমার কাছেই তো আমার ছোটবেলার পড়াশোনা।’ ‘হাতে ধরে তোকে এ বি সি ডি শিখিয়েছি। অ আ ক খ শিখিয়েছি।’ ‘তাও জানি। তাই বলে কি আমি তোমাকে পড়াতে পারি না? আমিও হাতে ধরে শেখাব।’
‘না, দরকার নেই আমার ওই শিখে। আমি মূর্খ আছি, ওরকমই থাকব।’ ঠাকুমার রাগ-অভিমানকে পুপুল বেশি পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। সে টানাটানি করেই চলে।
মিলি আর রমেন হাসাহাসি করে।
রমেন প্রথম দিন বুঝতে পারেনি। মিলিই বুঝিয়ে দেয়, ‘পুপুল ঠাকুমাকে কম্পিউটার না শিখিয়ে ছাড়বে না আর মাও শিখবেন না। এই নিয়ে দু’জনের টানাটানি চলেছে।’
মাঝে মাঝে অপরাজিতা পুপুলকে শাসন করার জন্য বলেন, ‘সব সময় ওই যন্ত্রটার সঙ্গে ফটর ফটর করিস কেন? পড়াশোনা নেই তোর? এবার তো সিক্স হবে।’
পুপুল অবাক উত্তর দেয়, ‘আরে, পড়াশোনাই তো করছি। জানো না, এখন পড়াশোনা সব অনলাইনেই চলে। এসো তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।’
‘অঙ্কও কি তোর ওই কম্পিউটারে শেখানো হয়? খাতা-পেন লাগে না, অঙ্ক কষতে?’ ‘খাতা-পেন নিয়ে অসুবিধা হয়। তার চেয়ে কিবোর্ডেই বেশি সুবিধা হয়। সময়ও কম লাগে। এসো না, দেখ। ক্যালকুলেটার করলে আরও সহজ।’
পুপুল ঝপাস করে বসিয়ে দিল ঠাকুমাকে চেয়ারটায়। তারপর বলল, ‘আগে অ্যালফাবেটটা দেখ, প্রথম লাইনে রয়েছে কিউ, ডব্লু, ই, আর, টি, ওয়াই...।’ ‘থাম পুপুল থাম, তোর ওই কিবোর্ডের অ্যালফাবেট কিউ দিয়ে শুরু? প্রথম লাইনে কিউ, ডব্লু..?’
‘হ্যাঁ, তাই তো।’
‘থাক বাছা, তোমার অ্যালফাবেট আমি শিখতে চাই না। আমাদের শেখা অ্যালফাবেট এ দিয়ে শুরু। ওই এ বি সি ডি-ই মনে থাক আমার। কিউ, ডব্লু, ই আর টি দিয়ে শেখার ইচ্ছে নেই।’
রাগ করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন অপরাজিতা। পুপুল দেখল বাবা মুখ টিপে হাসছে। সেটা দেখে ও আরও মজা পেয়ে গেল। জেদের গলায় বলল, ‘পালালে কী হবে, আমি ঠাম্মিকে কম্পিউটার শেখাবই শেখাব।’
অপরাজিতা মনে মনে ভাবেন, ওইটুকু ছেলে, সারাদিন কম্পিউটার চালায়। কখনও কখনও মায়ের ল্যাপটপেও হাত লাগায়। বিশেষ করে মিলি যখন বলে, ‘দেখ তো পুপুল, দরকারি চিঠিটা লিখছিলাম হঠাৎ মাঝের প্যারাগ্রাফটা কোথায় চলে গেল। আনতে পারবি?’
‘এখনই ঠিক করে দিচ্ছি মা।’ পুপুল ছুটে এসে মায়ের ল্যাপটপে হাত লাগাল আর দু’ মিনিটেই সফল। মিলির গলায় আহ্লাদ, ‘বাব্বা, কী করে আনলি রে? আমি তো ভাবলাম দরকারি অংশটা হারিয়েই গেল!’ ‘হারাবে কেন? এই দেখ মা, এইভাবে তুমি....।’
ব্যাস, মা আর ছেলে দু’জনের মুণ্ডু কম্পিউটারের সামনে মিলে মিশে গেল। অপরাজিতা ভাবেন, এত খটমট জিনিসটা কী করে জলভাত করে ফেলল তার ছোট্ট নাতিটা!
আর হয়েছে এক জ্বালা। যেখানেই কোনও কাজে যাবেন অমনি শুনতে হবে, ‘একটা মেল করে দিন না আন্টি।’
‘আবার মেল কেন? আমি তো অ্যাপ্লিকেশনটা লিখেই এনেছি। জমা নিয়ে নিন। তাহলেই তো হয়।’
‘ওই অ্যাপ্লিকেশন কে পড়বে এখন? পড়েই থাকবে। তার চেয়ে মেল করে দিন। দু’ দিনেই কাজ হয়ে যাবে।’
ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন অপরাজিতা। মেল করতে হলে তাঁর দ্বারা হবে না। কাউন্টারের ছেলেটি বলল, ‘বেশ, আপনার মেল আইডিটা বলুন। দেখি কীভাবে সাহায্য করতে পারি।’
‘আমার কোনও মেল আইডি নেই।’ গম্ভীর মুখে বললেন অপরাজিতা। ‘আপনার মেল আইডিও নেই?’ এমন গলায় বলল ছেলেটি যেন অপরাজিতার মান-সম্মানই নেই। তারপর অনেক করুণা করে বলে উঠল, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে, ছেলে কিংবা মেয়ে কিংবা বাড়ির যে কারও একটা মেল আইডি বলুন, আমি ম্যানেজ করছি।’
মাথা নাড়লেন অপরাজিতা। তাও নেই তার কাছে। একেবারে হদ্দ ভিখিরি যেন সে। মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল অফিসটা থেকে।
আর একদিন অপরাজিতা ব্যাঙ্কে গেছেন টাকা তুলতে। চেক নিল না কর্মীটি, ‘লিঙ্ক নেই, কোনও কাজ হবে না।’
‘লিঙ্ক নেই? কাজ হবে না? ঠিক আছে পরে টাকা তুলে নেব। আমার পাশবইটি এন্ট্রি করে দিন। দেখি, কত ব্যালেন্স আছে।’
‘বললাম না লিঙ্ক নেই! কোনও কাজ হবে না।’
‘হাতেই আপ টু ডেট করে দিন না। আগে যেমন লিখে দিতেন।’
‘ওভাবে আর হয় না।’ পাশবুকটি হাতে নিল সে, তারপর বলল, ‘বারকোড লেখা আছে তো, বাইরে কিয়স্ক থেকে আপ টু ডেট করে নিন।’ ওসব কি করেছেন কখনও অপরাজিতা?
পারলেন না। বাড়ি ফিরে এলেন।
রমেন সব শুনে বলে উঠল, ‘তুমি পারলে না মা? যাক গে, পুপুলকে দিও। ও স্কুল যাওয়া-আসার পথে করে আনবে।’
ক্লাস সিক্সের নাতির বিদ্যার পাশে অপরাজিতার ইউনিভার্সিটির ডিগ্রিটাকে খেলো আর খোকলা মনে হবে না এর পরেও!
একটা মোবাইল ফোন আছে অপরাজিতার।
যেটা দিয়ে ফোন করতে আর ফোন ধরতে পারেন। কিন্তু মেসেজ করতে জানেন না। হোয়াটস অ্যাপ কী বোঝেন না। অথচ তার সঙ্গীসাথীরাও বেশ শিখে গেছে এগুলো। অপরাজিতা মনে মনে ভাবেন, তাঁকেও এইসব শিখতে হবে। জানতে হবে অনেক কিছু। কিন্তু কীভাবে? কার কাছে মাথা নত করবেন?
বহু সাধ্যসাধনার পর পুপুলের জয় হয়েছে। অপরাজিতা তাঁর ছোট্ট নাতিটিকে তাঁর গুরুমহাশয় বলে স্বীকার করে নিতে রাজি হয়েছেন।
সামনেই সরস্বতী পুজো। সেই দিনই নাতি পুপুলের কাছে ঠাকুমা অপরাজিতার কম্পিউটার শেখার হাতেখড়ি হবে।
পুপুল বলেছে, প্রথমে ছোট কিছু দিয়েই শুরু করবে। স্মার্ট ফোনের কিপ্যাডে মেসেজ লেখা শেখাবে সে ঠাম্মিকে প্রথম দিন। তারপর ধীরে ধীরে সব শেখাবে ঠাম্মিকে। একেবারে হাতে ধরে ধরে।
সরস্বতী পুজোর দিন অপরাজিতা চান করে নতুন শাড়ি পরে লাজুক মুখে অপেক্ষা করছেন তার গুরুমশাইয়ের। কখন সে এসে হাতেখড়ি দেবে তাঁর।