কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। উকিল, মৃৎশিল্পীদের শুভ। সংক্রমণ থেকে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। আর্থিক ... বিশদ
‘যাহার অমর স্থান প্রেমের আসনে।
ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে।
দেশের মাটি থেকে নিল যারে হরি
দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে বরি’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁর জীবনাবসানের পর এই কথা লিখেছিলেন, তিনি হলেন অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হুগলির দেবানন্দপুরে বাবা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মা ভুবনমোহিনীদেবীর পুত্ররূপে শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল। ‘... আমার শৈশব ও যৌবন ঘোর দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। অর্থের অভাবেই আমার শিক্ষালাভের সৌভাগ্য ঘটেনি। পিতার নিকট হতে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আর কিছুই পাইনি।’—
এ কথা শরৎচন্দ্র নিজেই লিখেছিলেন। ছোটবেলায় তাঁকে এই দারিদ্র্যের কারণেই দেবানন্দপুর ও মামারবাড়ি ভাগলপুরে বারবার স্থান পরিবর্তন করতে হতো। ব্যাহত হতো পড়াশোনা। প্যারীপণ্ডিতের পাঠশালায় যদিও ভর্তি হয়েছিলেন পাঁচ বছর বয়সে। কিন্তু তারপর থেকে সিদ্ধেশ্বর মাস্টারের স্কুল, দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়, ভাগলপুর জেলা স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুল ... একের পর এক স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছিল তাঁকে। ১৮৯৪ সালে ‘এন্ট্রান্স’ পাশ করেছিলেন শেষোক্ত স্কুলটি থেকে। বরাবরই মেধাবী ছাত্র শরৎচন্দ্র পেয়েছেন ছাত্রবৃত্তি ও ডবল প্রোমোশানও। ফার্স্ট ক্লাসে পড়ার সময় মাইনে না দিতে পারার কারণে পড়া ছেড়ে বাড়ি বসে থাকতেও হয়েছিল তাঁকে। এই সময় মাত্র সতেরো বছর বয়সে সহপাঠী কাশিনাথের নামানুসারে শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন তাঁর জীবনের প্রথম গল্প ‘কাশিনাথ’।
‘এন্ট্রান্স’ পাশ করার পর কলেজেও যে ভর্তি হতে পেরেছিলেন তাও একজন আত্মীয়ার দুই ছেলেকে পড়ানোর বিনিময়ে! পাঠ্যবই কিনতে পারেননি বলে সহপাঠীদের বই চেয়ে এনে রাত জেগে পড়ে পরদিনই ফেরত দিতেন। এভাবে দু’ বছর পড়েও পরীক্ষার ফি মাত্র কুড়ি টাকা জোগাড় করতে না পারার জন্য তাঁর এফএ পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি!
পড়া ছেড়ে তখন তিনি ভাগলপুরের আদমপুর ক্লাবে মিশে অভিনয় ও খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকতেন। তাঁর বাবা অনেক ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা লিখতেন, তবে তা থাকত অসমাপ্ত। ছোটবেলায় একদিকে ঠাকুরমার কাছে যেমন শুনতেন রামায়ণ- মহাভারতের গল্প, তেমন বাবার অসমাপ্ত লেখাগুলোর শেষ কী হতে পারে তাই ভেবেও রাত জাগতেন!
ভাগলপুরে তাঁর বন্ধুত্ব হয় নির্ভীক, পরোপকারী রাজেন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গে, যাঁর প্রভাব তাঁর জীবনে অনেক! শরৎচন্দ্র তাঁর ‘ শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ‘ইন্দ্রনাথ’ চরিত্রটি এঁর আদলেই লিখেছিলেন। শরৎচন্দ্র বরাবরই দুরন্ত। খেলাধুলা, সাঁতার, কুস্তি সবেতেই চৌখস। সেই সঙ্গে পরোপকারী এবং পশুপ্রেমীও (পরবর্তীকালে কলকাতা পশুক্লেশ নিবারণী সমিতির হাওড়া শাখার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন)।
সমবয়সিদের নিয়ে শরৎচন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্য-সভা ‘কুঁড়ি-সংহতি’, হাতে লেখা পত্রিকা ‘ছায়া’, ছোটখাট চিড়িয়াখানা আর কুস্তির আখড়া। এই সাহিত্য-সভায় তিনি লিখেছেন ‘দেবদাস’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘শুভদা’, ‘বোঝা’র মতো গল্প — উপন্যাস। তাঁর ‘বড়দিদি’ গল্পটি বন্ধুবর সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় তাঁর খাতা থেকে গোপনে টুকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ‘ভারতী’ পত্রিকায়। সেখানে প্রকাশিত হতেই প্রথম পরিচিতি পেয়েছিলেন শরৎচন্দ্র।
বাবা মারা যাবার পর বার্মা (মায়ানমার) পাড়ি দেওয়ার আগে কলকাতায় মামাদের সঙ্গে দেখা করতে এসে তাঁদের অনুরোধে সামনে বসে লিখে দিয়েছিলেন ‘মন্দির’ গল্পটি প্রতিযোগিতার জন্য, তবে নিজের নাম দেননি। দেড়শো গল্পের মধ্যে এটি প্রথম হয়ে ‘কুন্তলীণ’ পুরস্কার পায়!
বার্মায় চাকরি করার সময় কলকারখানার মিস্ত্রিদের বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, বিপদে পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের ‘দাদাঠাকুর’!
১৯১২ সালে ‘যমুনা’ পত্রিকায় তাঁর ‘রামের সুমতি’ গল্পটি প্রকাশ হওয়া মাত্র খ্যাতির সূচনা হয় তাঁর! এরপর ‘ভারতবর্ষ’, ‘সাহিত্য’ প্রভৃতি কাগজে পরপর প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর অমরসৃষ্টি ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘বিরাজবৌ’, ‘পণ্ডিতমশাই’, ‘পল্লীসমাজ’ ইত্যাদি। ‘অনিলাদেবী’ ছদ্মনামে (নামটি তাঁর নিজের বড়দির) লিখেছেন ‘নারীর মূল্য’, ‘নারীর লেখা’ র মতো প্রবন্ধ। ‘যমুনা’র সম্পাদক প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম বই ‘বড়দিদি’। এরপর ‘ভারতবর্ষ’র মালিক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্সও পরপর প্রকাশ করতে শুরু করেন শরৎচন্দ্রের বই।
১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের আহ্বানে হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি হন শরৎচন্দ্র, যে পদে তিনি ছিলেন ১৯৩৬ সাল পযর্ন্ত। মাস্টারদা সূর্য সেনকে বৈপ্লবিক কাজে অর্থ সাহায্য করেছিলেন তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময়। বিপ্লবী বারীণ ঘোষ, বিপিন গাঙ্গুলী প্রমুখদের রিভলবার, গুলি দিয়েও সাহায্য করতেন তিনি। তাঁর লেখা ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটি প্রথম ধারাবাহিক ভাবে ‘বঙ্গবাণী’তে, ও পরে বই আকারে প্রকাশিত হলে পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্টের তৎপরতায় বিপ্লবের কথা প্রচারিত হওয়ার ‘অপরাধ’-এ বইটি নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করেন তৎকালীন বড়লাট।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডি – লিট’ উপাধি দিয়ে তাঁকে সম্মান জানান।
১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি যকৃৎ ক্যান্সারে জীবনাবসান হয় অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের।