সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় জটিলতা বৃদ্ধি। শরীর-স্বাস্থ্য দুর্বল হতে পারে। বিদ্যাশিক্ষায় বাধাবিঘ্ন। হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য আফশোস বাড়তে ... বিশদ
একটা বিশালকায় জানোয়ারের মতো ফুঁসছে আকাশটা। ভয়ঙ্কর কালো মেঘপুঞ্জটা একটা বুনো জন্তুর মতো দ্রুত বেগে ছুটে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ থেকে একটা প্রকাণ্ড ফানেলের মতো মেঘের ঘূর্ণি পাক খেতে খেতে নেমে এল মাটিতে। তারপরেই শুরু হল তাণ্ডব। বাতাসের গর্জনে, বিদ্যুৎ-চমকে আর সেই মাতালের মতো আকাশ থেকে নেমে আসা ঘূর্ণির দাপাদাপিতে চোখের সামনে সবকিছু তছনছ হতে শুরু করল। চোখের সামনে আলোকিত পৃথিবীটায় নেমে এল নিকষ রাত! বড় বড় বাড়ি, গাড়ি, গাই-বাছুর বাতাসে ছিটকে গিয়ে পড়ল বহু দূরের প্রান্তরে! প্রকাণ্ড সেই ঘূর্ণিটার নাম টর্নেডো! ভয়াবহ টর্নেডোর পিছু নিতে শুরু করল বিল হার্ডিং আর ডঃ জো হার্ডির লাল গাড়িটা। গাড়ির মাথায় রাখা আছে টেনিস বলের আকৃতির কতকগুলো সেন্সর বল! কোনওভাবে গাড়িটাকে টর্নেডোর কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারলেই সেন্সর বলগুলো টর্নেডোর ফানেলের সঙ্গে ঘুরতে শুরু করবে। আর তখনই বোঝা যাবে টর্নেডোর মতিগতি, তার গতিপথ! বিষয়টা শুনতে যত সহজ, ব্যাপারটা তত সহজ নয়। টর্নেডোর অত কাছে যাওয়ার আগেই হয়তো গাড়ি ছিটকে যাবে দূরে কোথাও! দেখতে দেখতে বিশালকায় টর্নেডোটা একটা খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ঢুকে পড়ল ভুট্টার খেতে! আবহাওয়াবিদ বিল আর জো নিজেদের গাড়িটাও ঢুকিয়ে দিল ভুট্টা খেতে। তারপর ইঞ্জিন চালু রেখেই তারা ঝাঁপ দিল গাড়ি থেকে! কিছুক্ষণের মধ্যে টর্নেডো গাড়িটিকেও টেনে নিল নিজের দিকে! ঝড়ের মধ্যে গাড়িটা হারিয়ে গেলেও সেন্সরগুলো ঘুরতে শুরু করল টর্নেডোর সঙ্গে! আনন্দে লাফিয়ে উঠল ওরা দু’জনে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা বুঝল একটা গণ্ডগোল হয়েছে। ওই সেন্সরগুলোর কারণেই ধরা গেল, বিশালাকায় টর্নেডো আসলে ধেয়ে আসছে বিল আর জো এর দিকেই। বিপদ বুঝে ভুট্টা খেতের মধ্যে দিয়ে ছুটতে শুরু করল জো আর বিল...
দৃশ্যটা ১৯৯৬ সালের বিখ্যাত হলিউড ছবি ট্যুইস্টার-এর। চাইলে তোমরাও ছবিটি ডাউনলোড করে দেখে নিতে পারো। আজও ছবিটি দেখলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আবহাওয়াবিদরা ঠিক কতখানি কাজ পাগল হন তা বোঝা যায় ছবিটি দেখলে! ঝড় নিয়ে পরে আরও অনেক ছবি হয়েছে। তবে ঝড় নিয়ে সবচাইতে আলোচিত ছবি ছিল বোধহয় ‘দ্য ডে আফটার টুমোরো’ নামে হলিউড ছবিটি। সেই ছবিতে দেখা যায় পৃথিবীতে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাব। এক বিরাট হ্যারিকেনের দাপটে সারা বিশ্বে ফিরে আসে তুষার যুগ! ২০০৯ সালেও ‘ইনটু দি স্টর্ম’ নামে ছবিটিও যথেষ্ট আতঙ্ক জাগানো ছিল। অতএব, বোঝাই যাচ্ছে, যুগ যুগ ধরে ঝড় নিয়ে মানুষের মনে রয়েছে নানা জিজ্ঞাসা। প্রশ্ন হল কীভাবে তৈরি হয় বিধ্বংসী ঝড়?
ডেরেচো ঝড়
এই ঝড়ের ধ্বংস করার ক্ষমতা মারাত্মক। তবে এই ধরনের ঝড়ে হ্যারিকেন বা টর্নেডোর মতো এলোমেলো বাতাস বয় না। এই ঝড়ে বায়ু বয়ে যায় সোজা পথে। বাতাসের গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ৫৯ মাইল থেকে ১৩০ মাইল পর্যন্ত! আসলে ডেরেচো শব্দটি স্প্যানিশ। শব্দের অর্থ ‘সোজা পথে’। সাধারণত গরমকালেই এমন ঝড় দেখা যায়। বজ্রবিদ্যুৎ পূর্ণ মেঘ থেকে বৃষ্টি পড়ে নীচের দিকে। এই ধরনের মেঘ তার আশপাশে থাকা শুকনো বাতাসের সংস্পর্শে আসে। শুকনো বাতাসের মধ্যে থাকা জল বাষ্পীভূত হয়ে যায়। ফলে সেই বাতাস ঠান্ডা হয়। ঠান্ডা বাতাস ভারী। তাই সেই বাতাস উপর থেকে মাটির দিকে নেমে আসে ও ফের সামনের দিকে দ্রুত বেগে ছুটে যায়। অনেকটা জলপ্রপাতের জল যেমন ওপর থেকে নীচে পড়ে সামনের দিকে বয়ে যায়, তেমনই। এই ঠান্ডা বাতাস আসলে আরও শুকনো বাতাসকে ঠেলে ওপরের দিকে উঠে যেতে সাহায্য করে। শুকনো বাতাস বজ্রবিদ্যুৎ ভরা মেঘের সংস্পর্শে আসে। বাতাসের জলীয়বাষ্প থেকে মেঘ আরও বড় হয়। আরও বেশি মাত্রায় ঠান্ডা বাতাস নীচের দিকে নামে। বড় ঝড়ের সৃষ্টি হয়। এভাবে বিরাট বড় এলাকা জুড়ে ডেরেচোর দাপট চলতে পারে। কমপক্ষে মোটামুটি ২৪০ মাইল এলাকা জুড়ে চলতে পারে ডেরেচোর তাণ্ডবলীলা!
মধ্য ও পূর্ব আমেরিকায় এমন ঝড় বেশি হতে দেখা যায়। ঘরবাড়ির বেশ ক্ষতি করে ডেরেচো। বাতাসের ধাক্কায় বড় বড় গাছও পড়ে যায়। তবে উপগ্রহের পাঠানো ছবি দেখে এই ঝড় সম্পর্কে আগাম সতর্ক হওয়া যায়।
তুষারপাত ও ঝড়
সকালে উঠেই দেখলে চারিদিকে পড়ে আছে বরফ! বাড়ির ছাদে, জানলার গ্রিলে জমে আছে সাদা তুষার! কেমন হয়? ব্যাপারটা বেশ মজার। আসলে চারিদিকে তুষার জমে যাওয়ার মূল কারণ হল তুষার ঝড় ও তুষারপাত! কীভাবে হয় তুষারপাত? তুষারপাতে আসলে বৃষ্টির বদলে পড়ে তুষার! এক্ষেত্রে যে অঞ্চলে তুষারপাত হবে, সেখানকার তাপমাত্রা হতে হবে শূন্যের নীচে। মোট কথা মাটি থেকে মেঘ পর্যন্ত অংশে তাপমাত্রা থাকতে হবে শূন্যের নীচে! তুষারপাতও আসলে বৃষ্টি হওয়ার প্রক্রিয়া মেনেই চলে। মূলত জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু বায়ুমণ্ডলের উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। সেখানে পৌঁছে জলীয়বাষ্প ধূলিকণাকে আশ্রয় করে জলকণায় পরিণত হয়। তবে সেখানে তাপমাত্রা এতটাই কম থাকে যে সেই জলকণা বরফের কেলাসে পরিণত হয়। এই কেলাসের সংস্পর্শে আরও জলকণা আসে ও কেলাসের আকার বড় হতে থাকে। এরপর তা খুব ভারী হয়ে গেলে তুষারকণা হিসেবে পড়তে থাকে মাটির দিকে। তবে মাটির দিকে তাপমাত্রা শূন্যের বেশি হলেই তুষার গলে বৃষ্টি আকারেই মাটিতে পড়তে থাকে! সাধারণত তুষারপাত হয় শীতপ্রধান দেশে ও পার্বত্য অঞ্চলে। কারণ সেখানকার তাপমাত্রা সবসময় শীতল থাকে। তুষার ঝড়ের ক্ষেত্রে বাতাস খুব দ্রুত বইতে থাকে। ফলে বাতাসের সঙ্গে তুষার উড়তে থাকে ও চোখে কিছু দেখা যায় না।
হ্যারিকেন-টাইফুন-সাইক্লোন
হ্যারিকেন, টাইফুন ও সাইক্লোন মোটামুটি একই ধরনের ঝড়। সবকটি ঝড়ই তৈরি হয় ট্রপিকাল এরিয়া বা পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলে। অর্থাৎ পৃথিবীর যে অংশে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে সেখানে। তাহলে ঝড়ের তিনটে আলাদা নাম কেন! আসলে ঠিক কোন জায়গায় ঝড় তৈরি হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে সেই ঝড়কে কোন নামে ডাকা হবে। উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরে তৈরি হওয়া ঝড়কে বলে হ্যারিকেন। উত্তর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে তৈরি হওয়া ঝড়কে বলে টাইফুন। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে তৈরি হওয়া ঝড়কে বলে সাইক্লোন। তিনটি ক্ষেত্রেই মোটামুটি ঝড়ের গতিবেগ থাকে কমপক্ষে প্রতি ঘণ্টায় ১১৯ কিলোমিটার। উমপুন, যশ, তাউতে সবই সাইক্লোন।
কীভাবে তৈরি হয় ঝড়?
সাধারণভাবে বোঝার জন্য বলা যেতে পারে, এই ধরনের ঝড় তৈরি হওয়ার জন্য বিরাট অংশ জুড়ে অন্তত ৫০ মিটার গভীর সাগরের জলের উষ্ণতা হওয়া উচিত ২৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাগরের জলের তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণে সেখানকার উষ্ণ বায়ু উপরে দিকে উঠতে থাকে। ফলে সেখানে একটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়। এবার সেই ফাঁকা জায়গা দখল করার জন্য চারপাশ থেকে ছুটে আসে অপেক্ষাকৃত শীতল আর্দ্র বাতাস। নানা দিক থেকে বাতাস ছুটে এসে সেই উষ্ণ ফাঁকা জায়গাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে (বাতাসের এভাবে ঘোরার কারণ হল কোরিওলিস এফেক্ট। সহজভাবে বললে, পৃথিবী নিজের অক্ষের চারিদিকে ঘোরে পশ্চিম থেকে পূর্বে। এভাবে ঘোরার কারণে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু থেকে যে ঠান্ডা বাতাস পৃথিবীর উষ্ণ মণ্ডলের দিকে ছুটে আসে তা সোজাসুজি না এসে বেঁকে যায়। এভাবে বেঁকে যাওয়া বাতাস উষ্ণ ফাঁকা জায়গার দিকে ছুটে আসার কারণেই তৈরি হয় ঘূর্ণি)। শীতল বাতাস কেন্দ্রে এসে উষ্ণ হয়ে উপরে উঠে যেতে থাকে। সঙ্গে বাতাসের জলীয়বাষ্প উপরে গিয়ে তৈরি করতে থাকে মেঘ। এই প্রক্রিয়া ক্রমাগত চলতে চলতে তৈরি হয় বিরাট মেঘপুঞ্জ এবং সাইক্লোন ঘূর্ণি। কমপক্ষে ১০০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে তৈরি হতে থাকে এমন ঘূর্ণি। তিন থেকে সাতদিন এমন ঝড় বইতে পারে। সাগরে তৈরি হওয়া ঝড় উপকূলে বা ডাঙায় ঢোকার পর ধীরে ধীরে থেমে যায়। কারণ তখন আর ঝড়ের যে মূল উৎস অর্থাৎ সাগরের গরম জল, তা আর থাকে না। সাগরে এইভাবে হ্যারিকেন, টাইফুন বা সাইক্লোন তৈরি হলে তার ছবি উপগ্রহ মারফত বিজ্ঞানীদের কাছে পৌঁছয়। ফলে আগে থেকেই এই ধরনের ঝড় সম্পর্কে তথ্য জানা যায়। সাইক্লোনের মতো ঘূর্ণিঝড়গুলির নামকরণ করে এশিয়ার ১৩টি দেশ।
টর্নেডো
টর্নেডো তৈরি হয় বজ্রবিদ্যুৎপূর্ণ মেঘ থেকে। তবে সাধারণ মেঘ নয়। উল্লম্ব বা বিরাট লম্বা মেঘ থেকে তৈরি হয় টর্নেডো। এই ধরনের মেঘকে বলে সুপার সেল। অন্তত ৫০ হাজার কিলোমিটার লম্বা হতে পারে এমন মেঘপুঞ্জ। এমন বিরাট উচ্চতাবিশিষ্ট মেঘপুঞ্জের ভিতরে বাতাস নানা দিকে বইতে থাকে। ফলে মেঘের ভিতরে একটা শোওয়ানো সিলিন্ডারের মতো বাতাসের ঘূর্ণি তৈরি হয়।
এখন সূর্যের তাপে মাটি খুব উষ্ণ হয়ে ওঠে। ফলে মাটির কাছকাছি থাকা বাতাসও খুব উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ও তা দ্রুতবেগে উপরের দিকে উঠতে থাকে। উপরের দিকে ওঠা এই বাতাসের বেগ বেশি থাকলে তা মেঘের ভিতরে সিলিন্ডারের মতো ঘূর্ণিকে ধাক্কা মেরে শোওয়ানো অবস্থা থেকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। মেঘের ভিতরে থাকা ঠান্ডা বাতাস এই ঘূর্ণিকে নীচে নেমে আসতে সাহায্য করে। ফলে মেঘ থেকে ফানেলের মতো ঘূর্ণি নেমে আসে জমির দিকে। পৃথিবীর জমি স্পর্শ করলেই জন্ম হয় টর্নেডোর। টর্নেডোর গতিবেগ ঘণ্টায় ২০০ থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে! ঘূর্ণি থেমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার অবধিও পাড়ি দিতে পারে। যশ সাইক্লোন আসার আগে হুগলিতে এমন টর্নেডো দেখা গিয়েছিল! উত্তর আমেরিকা মহাদেশ হল টর্নেডোপ্রবণ মহাদেশ। টর্নেডো আসবে কি আসবে না তা আগে থেকে বলা মুশকিল। তবে ডপলার রেডারের মাধ্যমে মেঘপুঞ্জ কীভাবে তৈরি হচ্ছে তা বোঝা যায়। এভাবে সতর্ক বার্তা জারি করা যায়।
সব শেষে একটা কথাই বলা যায়। সব ঝড়ই মানুষের ক্ষতি করে। পরিবেশবিজ্ঞানী থেকে আবহাওয়াবিদ— সকলেই বলছেন, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর প্রভাবে ভবিষ্যতে ঝড় আরও মারাত্মক রূপ নেবে। আমাদের ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং রুখতে হবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং রুখতে হলে বায়ুদূষণ বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে কলকারখানা, গাড়ির জ্বালানির জন্য আমাদের নির্ভর করতে হবে সূর্যের আলো, বায়ুর শক্তি থেকে তৈরি বিদ্যুতের উপর। এভাবেই রোখা যাবে বায়ুদূষণ।