মহাপ্রলয় আসছে
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, ষষ্ঠ মহাপ্রলয় ঘটতে আর দেরি নেই। জঙ্গল কেটে সাফ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে গাড়ি, কলকারখানার সংখ্যা। দূষিত হয়ে উঠছে পরিবেশ। গলতে শুরু করেছে কুমেরু ও সুমেরুর বরফ। মহাপ্রলয় আটকাতে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। পৃথিবীর ধ্বংস আটকানোর উপায় কী? লিখেছেন সুপ্রিয় নায়েক।
তোমরা গ্রেটা থুনবার্গের নাম শুনেছ? মেয়েটির বয়স মাত্র ১৬। কিশোরী মেয়েটি তার স্কুলে যাবে না বলে পণ করেছে। এভাবেই সে গড়ে তুলেছে আন্দোলন। সে প্রতিবাদ জানাচ্ছে প্রকৃতি ধ্বংস হওয়ার বিরুদ্ধে। গ্রেটা বলছে, মানুষের জন্যই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। রুষ্ট হতে শুরু করেছে পরিবেশ। এখনই দরকার পেট্রোল, ডিজেলের মতো জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা। দরকার বনসৃজনের। গ্রেটার পাশে দাঁড়িয়েছে গোটা বিশ্ব। কয়েকজন গ্রেটাকে নোবেল দেওয়ার কথাও বলছেন। কিন্তু কী এই গ্লোবাল ওয়ার্মিং? সেই বিষয়ে যাওয়ার আগে কয়েকটা কথা বলে নিই।
গরম বাড়ছে
আচ্ছা, তোমরা একটা বিষয় খেয়াল করেছ? দিনকে দিন পৃথিবীতে কেমন গরম বেড়ে যাচ্ছে? এমনকী বর্ষার মরশুমে বৃষ্টি পড়ছে না! শীত ছোট হচ্ছে ক্রমশ! কখনও প্রশ্ন করেছ কেন এমন হচ্ছে? ক্রমাগত এমন হয়ে চললে ফলাফল কী হতে পারে?
এককথায় এই প্রশ্নের উত্তর হল, মহাপ্রলয় ঘটবে খুব তাড়াতাড়ি! এর আগে পৃথিবীতে মোট পাঁচবার মহাপ্রলয় ঘটেছে। শেষবার ঘটেছিল ৬.৬ কোটি বছর আগে। দৈত্যাকার সব ডাইনোসররা সেই প্রলয়ে হারিয়ে যায়। সেবার কেন প্রলয় ঘটেছিল, তা নিয়ে নানা মতামত রয়েছে। তবে এবার পরিবেশ বিজ্ঞানীরা একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত যে ষষ্ঠ মহাপ্রলয় ঘটবে মানুষের জন্যই। গ্লোবাল ওয়ার্মিং সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং
আমাদের পৃথিবীর চারদিকে ঘিরে রয়েছে ওজন স্তর। ওজন স্তর পৃথিবীকে রক্ষা করে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে। এই স্তর ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে ক্লোরোফ্লুরো কার্বন গ্যাসের কারণে। এয়ার কন্ডিশন মেশিন, রেফ্রিজারেটর বিকিরণ করে ক্লোরোফ্লুরো কার্বন। ফলে সরাসরি সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি প্রবেশ করছে পৃথিবীতে। বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। এছাড়া কলকারখানার সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে পৃথিবীতে পেট্রোল, ডিজেল চালিত গাড়ির সংখ্যা। এগুলি বাড়িয়ে তুলছে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা! সিও-টু পরোক্ষে বাড়িয়ে তুলছে পরিবেশের তাপমাত্রা। একইসঙ্গে একেবারে বোকার মতো মানুষ নির্বিচারে ধ্বংস করে ফেলছে বনাঞ্চল। সমস্ত অরণ্য ধ্বংস করে পৃথিবীকে মরুভূমি বানিয়ে ফেলছি আমরা। এদিকে সবাই জানে, গাছ বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ে অক্সিজেন দেয়। আর সেই উদ্ভিদকুলকে আমরাই ধ্বংস করছি। বাতাসে শ্বাস নেওয়া আরও কঠিন করে তুলছি! ফলে বেড়েই চলেছে পৃথিবীর উষ্ণতা। বিশ্বজুড়ে উষ্ণতার এই বৃদ্ধিকেই বিজ্ঞানীরা বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বলছেন।
আগামীর দিন বড় ভয়ঙ্কর
উষ্ণতার বৃদ্ধিতে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। আর কয়েক বছরের মধ্যে সুমেরু আর কুমেরুর সমস্ত বরফ গলে জলে পরিণত হবে। সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে পৃথিবীর সমুদ্রের উপকূলবর্তী এলাকাগুলি চলে যাবে জলের তলায়। মনে রাখতে হবে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গও কিন্তু তলিয়ে যেতে পারে জলের তলায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন হলে ক্রমশ বাড়বে ম্যালেরিয়া, গোদ, কলেরা, ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ। শুরু হবে নতুন ধরনের অসুখ। সমুদ্রের জল দূষিত হতে শুরু করেছে। ক্রমশ আরও দূষণ বাড়বে। মারা পড়বে বহু সামুদ্রিক জীব। সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে প্রবাল প্রাচীর। পেঙ্গুইনদেরও সম্ভবত আমরা দেখতে পাব না। বরফ গলতে শুরু করায় মেরু ভাল্লুকরা এমনিতেই মরতে বসেছে। তিমি, হাঙররাও শেষ হয়ে যাবে একদিন। সবচাইতে বড় পরিবর্তন দেখা দেবে আবহাওয়ায়। ঘনঘন ঘূর্ণিঝড় দেখা দেবে। ক্ষতি হবে ফসলের। খাদ্যের অভাব দেখা যাবে। বাড়বে খরা ও বন্যার প্রকোপ। ক্রমশ ধ্বংস হয়ে যাবে মানবজাতি।
উপায় কী?
উপায় মূলত দু’টি। ক) মানুষের কার্যকলাপের উপর নিয়ন্ত্রণ। খ) বনসৃজন।
মানুষের কার্যকলাপের উপর নিয়ন্ত্রণ
প্রথমত কলকারখানায় কয়লার মতো জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। এছাড়া পরিবেশে কলকারখানা থেকে মেশা ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশা বন্ধ করতে হবে। এছাড়া প্লাস্টিক ব্যবহার এখনই বন্ধ করা দরকার। পেট্রোল, ডিজেল চালিত গাড়ি কমিয়ে ফেলা উচিত। এমনকী বিদ্যুৎ উৎপাদনেও কমাতে হবে কয়লার ব্যবহার। বরং বাড়াতে হবে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়ো গ্যাস, জোয়ার-ভাটা শক্তি, পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার।
বনসৃজন বা জঙ্গল উদ্ধার
আধুনিকতার নামে বন কেটে বাড়ছে মানুষের বসতি। তাই আগে শহরের বৃদ্ধি কমাতে হবে। বন কেটে আর বাড়িঘর করা যাবে না। বরং নতুন করে আরও গাছ লাগাতে হবে। অরণ্য থাকলে বিশ্ব উষ্ণায়ন আটকে দেওয়া যাবে। আর তা করা সম্ভব মাত্র ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে!
এই দ্বিতীয় কাজটি করা হল সবচাইতে সোজা। জানলে অবাক হবে, বেশ কয়েকজন আছেন, যাঁরা একটা গোটা জঙ্গলই বানিয়ে ফেলেছেন নিজের চেষ্টায়। তাঁরাই হলেন আমাদের অরণ্য মানব আর মানবী। তাঁরাই আমাদের আদর্শ, আমাদের নায়ক ও নায়িকা। এসো তাঁদের কয়েকজনকে চিনে রাখি।
যাদব পায়েং: তাঁকে সবাই মুলাই বলে ডাকে। অসমিয়া ভাষায় মুলাই শব্দের অর্থ জঙ্গল। যাদব ওরফে মুলাই একটা অসম্ভব কাজ করে ফেলেছেন। ধু ধু করা ব্রহ্মপুত্রের ন্যাড়া বালুচরে, একা হাতে গাছ লাগাতে শুরু করেন ১৬ বছর বয়স থেকে। এখন সেই জঙ্গল ৫৫০ হেক্টর জুড়ে বড় হয়েছে! যাদবের সম্মানে এই গোটা জঙ্গলটির নাম হয়েছে মুলাই কাঠনি। সম্পূর্ণ মরুভূমি হয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রের বুকে গড়ে ওঠা জঙ্গলে এখন বাস করে হাতি, গণ্ডার, চিতাবাঘ, হরিণ, অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। এভাবেই যাদব বন্যপ্রাণীদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন তাঁদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া জঙ্গল! ২০১২ সালে যাদবের এই অবদানের জন্য জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি তাঁকে ফরেস্ট ম্যান অব ইন্ডিয়া শিরোপা দেয়। ওই বছরেই ভারতের সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট এপিজে আব্দুল কালাম মুম্বইয়ে যাদব পায়েংকে আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করেন। ২০১৫ সালে তিনি পান পদ্মশ্রী পুরস্কার।
কোল্লাক্কোয়িল দেবকী আম্মা: দেবকী আম্মার বয়স এখন ৮৫। দেবকী আম্মার বাড়ি কেরালার আলাপ্পুরা জেলায়। বাড়ির পিছনে পাঁচ একর জমি ছিল তাঁর। সেই ১৯৮০ সাল থেকে তিনি সেই জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগাতে শুরু করেন। আজ সেই জমিতে তৈরি হয়েছে গভীর শান্ত বন। সেখানে নিশ্চিন্তে বাসা বেঁধেছে ময়ূর, বাজ, নীলকণ্ঠ, ডাহুক সহ নানা প্রজাতির পাখি। বাঁদর, বনবেড়াল, ছোটখাট জন্তু জানোয়ারেরও ঠাঁই হয়েছে বইকি। দেবকী আম্মার নাতিনাতনিরাও স্কুলের ছুটিতে ঠাকুমার সঙ্গে হাত লাগিয়ে সেই বনে গাছ লাগান। এই অরণ্যে রয়েছে ছোট পুকুর! জলাভূমি! দেবকী আম্মা তাঁর নিজের হাতে তৈরি অরণ্য খুলে দিয়েছেন শিক্ষামূলক ভ্রমণের জন্য। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সেখানে প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির গাছপালা দেখতে যান। আহরণ করেন প্রকৃতি নিয়ে জ্ঞান। দেবকী আম্মার এই কাজের জন্য তিনি ভারত সরকারের তরফে পেয়েছেন, ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী বৃক্ষামিত্র পুরস্কার এবং নারী শক্তি পুরস্কার। এছাড়া রাজ্য সরকারের তরফেও পেয়েছেন।
এই ৮৫ বছর বয়সেও তিনি এখনও রোজ ভোরবেলা হেঁটে যান তাঁর নিজের হাতে তৈরি বনের মধ্যে দিয়ে। এখনও গাছ লাগান মাটি খুঁড়ে!
পামেলা মলহোত্রা এবং অনিল কে মলহোত্রা: এই দম্পতি কর্ণাটকের কোদাগু জেলায়, পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় প্রায় ৩০০ একর জমিতে বানিয়ে ফেলেছেন বিশাল অরণ্য। এই অরণ্য তৈরি করতে সময় লেগেছে প্রায় ২৫ বছর। নিজেদের সমস্ত জমানো টাকাপয়সা খরচ করে অল্প অল্প করে তাঁরা জমি কিনতে থাকেন। সঙ্গে শুরু করেন গাছ লাগানো। বর্তমানে ওই জঙ্গলের নাম সাই স্যাংচুয়ারি। সেখানে বাস করে হাতি, লেপার্ড, হরিণ, সাপ, কতশত পাখি।
সেবাস্টিও রিবেইরো সালগাদো ও লিলিয়া: সেবাস্টিও একজন চিত্রসংবাদিক। তাঁর স্ত্রী’র নাম লিলিয়া। ব্রাজিলের মিনে জ়েরাইস অঞ্চলে এই মোরেস-এ সেবাস্টিওর বাপ-ঠাকুর্দার ছিল প্রায় ১৭৫৪ একর জমি। সেই জমিতে ছিল জঙ্গল। বড় বড় গাছ। কতশত পাখি আর বন্যপ্রাণীর বাস। সেবাস্টিওর বাবা ও দাদুরা নির্বিচারে সেই অরণ্যের গাছ কেটে বিক্রি করতে শুরু করলেন। ফলে একটা বড় জঙ্গল ধূসর জমিতে পরিণত হল। সেবাস্টিও বুঝলেন প্রকৃতির সঙ্গে বড় পাপ করা হয়ে গিয়েছে। তিনি আর তাঁর স্ত্রী পণ করলেন এই জঙ্গলকে ফেরাতে হবে। ধীরে ধীরে গাছ লাগাতে শুরু করলেন সেই জমিতে। ২০ বছরের চেষ্টায় ২০ লক্ষ গাছ লাগিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা। রুক্ষ জমি এখন বদলে গিয়েছে জঙ্গলে। ফিরে এসেছে কতশত পাখি, জন্তু-জানোয়ার! সালগাদো বলছেন, আমাদের গ্রহকে বাঁচাতে হলে অরণ্য ফিরিয়ে আনা ছাড়া আর কোনও গতি নেই। তিনি বলছেন, জঙ্গল উদ্ধার করলে আমরা জলবায়ুর পরিবর্তন আটকাতে পারব। পারব পৃথিবীকে ধ্বংস হওয়ার হাত থেকেও বাঁচাতে।
সবশেষে আমরা: চলো বন্ধুরা। আমরাও আজ থেকে গাছ লাগাতে শুরু করি। একটুকরো ফাঁকা জমি পেলেই তো চলবে! একইসঙ্গে কোথাও গাছ কাটা হলে তার প্রতিবাদ করি। কারণ অরণ্য থাকলেই সেখানে বাসা করবে সবুজ বসন্তবৌরি, টুনটুনি, দুর্গা টুনটুনি, কাঠঠোকরা, ধনেশ, নীলকণ্ঠ, পাপিয়া, ময়না, টিয়া, প্যাঁচা। একই সঙ্গে বন্ধ করতে হবে পুকুর বোজানো। কারণ জলেও তো বহু প্রাণী বাস করে। তারাও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। বন্ধ করি প্লাস্টিকের ব্যবহার। প্লাস্টিক জমিকে করে তোলে অনুর্বর। এসো এভাবেই আমরা আমাদের প্রকৃতি মা’কে রক্ষা করি একসঙ্গে, আজ থেকেই!
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
20th October, 2019