শেয়ার প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে অর্থাগমের সম্ভাবনা। সন্তানের কর্ম প্রাপ্তির সুখবর পেতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে জটিলতা কিছুটা ... বিশদ
এই হল সিরি ফোর্ট। রাজধানী দিল্লির অভিজাত পাড়া। একদিকে পঞ্চশীল। অন্য প্রান্তে হৌস খাস। একদিকে অরবিন্দ মার্গ। আর অন্যদিকে খেল গাঁও মার্গ। খেল গাঁও কেন? কারণ, ১৯৮২ সালের এশিয়ান গেমসের আসর বসেছিল এখানেই। সেই থেকে এই এলাকার একটি অংশের নাম গেমস ভিলেজ এরিয়া। সিরি ফোর্ট মানে কি কোনও কেল্লা? ছিল। এখন ধ্বংসাবশেষ। প্রাচীন সেই দুর্গ-রাজধানীর প্রায় অবলুপ্ত প্রাচীনত্বের পাশেই গড়ে উঠেছে আধুনিকতম প্রেক্ষাগৃহ। সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়াম।
শীতের কুয়াশাঘেরা নির্জনতা। গ্রীষ্মের দহনকালের নীরবতায়। বসন্তের আগমনধ্বনির সুবাতাস যাপন। যে কোনও মরশুমে একাকী অথবা যুগল পদচারণার দৃশ্য দেখা যায় এই সিরি ফোর্টে। ৭০০ বছর পুরনো এই ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীর বাতাসে ৮ হাজারের বেশি অলীক দীর্ঘশ্বাস কি আজও নেই? কাদের দীর্ঘশ্বাস?
জালালউদ্দিন খিলজি তাঁর ভাইপো আলাউদ্দিনকে শুধুমাত্র যে নিজের অন্যতম সেনাপতি করেছেন তাই নয়। আগেই বিয়ে দিয়েছেন নিজের কন্যার সঙ্গে। অর্থাৎ এখন তিনি আলাউদ্দিনের কাকা এবং শ্বশুর দুইই। শ্বশুর সদয় হলেও শাশুড়ি নয়। আলাউদ্দিনের শাশুড়ি অর্থাৎ সুলতান জালালউদ্দিনের বেগম সাহিবা মোটেই পছন্দ করতেন না এই জামাইকে। কারণ সে স্বভাবতই খল, দুশ্চরিত্র, নিষ্ঠুর স্বভাবের ও স্বার্থান্বেষী। অবশ্য তিনিও স্বীকার করতেন, একমাত্র যে গুণ ও বৈশিষ্ট্য জামাইয়ের মধ্যে রয়েছে, সেটি অতুলনীয়। সেটি হল বীরত্ব। এরকম বীর যোদ্ধা আর নেই। সুলতান জালালউদ্দিনের সেনাবাহিনীতে একজন আলাউদ্দিন খিলজি থাকলেই যথেষ্ট।
শাশুড়ির এই স্বভাব নিজের পত্নীর মধ্যেই দেখতে পান আলাউদ্দিন। সুলতান জালালউদ্দিনের আদরের কন্যা মালিক-ই-জাহান। যখন আলাউদ্দিনের হাতে কোনও ক্ষমতাই নেই, সেই ১২৯০ সালেই জালালউদ্দিন তাঁর সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দিয়েছিলেন। আর আলাউদ্দিন নিজেই জানেন যে, মালিকা-ই-জাহান তাঁর জীবনে সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে। কারণ সলতনতে তাঁর যা কিছু উন্নতি ঘটেছে, সবই বিয়ের পর।
কিন্তু হলেই বা কী? যা দম্ভ ও উন্নাসিকতা এই মালিকা-ই-জাহানের মধ্যে? তাঁর মায়ের মতোই সেও অত্যন্ত বলিষ্ঠ চরিত্রের। আমার পিতার জন্যই তোমার এই উন্নতি। সুতরাং আমার কথা মতোই চলতে হবে তোমাকে। এই ছিল মালিকা-ই-জাহানের মনোভাব। আলাউদ্দিনের কোনও ক্রোধ, অভিযোগ, ধমককে গ্রাহ্যই করে না মালিকা। আলাউদ্দিন নিজেকে সরিয়ে নিলেন মানসিকভাবে। বিয়ে করলেন মাহরুকে। সে আবার বিপরীত। স্বামীর অনুগত ও নম্র। অন্যতম সেনাপতি আলপ খানের বোন। যতই চরিত্রগতভাবে উন্নাসিক ও অহংকারী হোক কোনও নারী, স্বামীকে ছিনিয়ে নিচ্ছে অন্য এক নিছক কোমল স্বভাবা কন্যা, এটা কে সহ্য করবে? অতএব জ্বলে উঠলেন মালিকা।
একসঙ্গে বৈকালিক ভ্রমণের উদ্দেশে কেল্লার উদ্যানে মাহরুকে ডেকে নিলেন মালিকা। একথা সেকথার পর আচমকা আক্রমণ। কোমরে ছিল ছুরি। মাহরু আতঙ্কে পড়ে গেল। কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল আর্তনাদ। ছুটে এল প্রহরীরা। সর্বনাশ। আলাউদ্দিনের প্রিয়তমা ছোট বেগমকে হত্যার চেষ্টা করছে বড় বেগম? প্রহরী আর দাসদাসীদের চরম ধর্মসঙ্কট। একদিকে আলাউদ্দিনের রোষ। অন্যদিকে স্বয়ং সুলতানের কন্যা হলেন বড় বেগম। সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে কোনও নালিশ তোলা মানেও তো প্রাণ যাবে! কিন্তু সংবাদ তো চাপা থাকবে না। কারণ মাহরু অচেতন। আহত।
ঘটনার কথা জানতে পেরে সর্বসমক্ষে মালিকা-ই-জাহানকে চড় মারলেন আলাউদ্দিন। গোটা কেল্লা স্তব্ধ। আলাউদ্দিন আর বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করবেন না। তিনি বেরিয়ে পড়লেন রাজ্য থেকে রাজ্যে সাম্রাজ্য বিস্তারে। একমাত্র ক্ষমতা এবং আরও ক্ষমতাই দিতে পারে তাঁকে এমন শক্তি যে, একদিন এই সুলতান জালালউদ্দিন আর তাঁর দুর্বিনীত কন্যাকে শায়েস্তা করা যাবে। যত বেশি দেশীয় রাজ্যকে নিজের পদানত করবেন আলাউদ্দিন, তত বেশি শক্তিসঞ্চয় হবে। তারপর করবেন বিদ্রোহ। তাঁর এই শক্তিবৃদ্ধিতে সবথেকে বেশি চিন্তিত হলেন বেগম সাহিবা। আলাউদ্দিনের শাশুড়ি। তিনি বুঝতে পারছেন জামাইয়ের মনে কোনও এক পরিকল্পনা আছে। এভাবে নয়তো দিগ্বিজয়ে বেরনোর অর্থ কী? তিনি সুলতানকে বললেন, আলাউদ্দিনকে দিল্লিতে ফিরতে বলুন। আর সাম্রাজ্য বিস্তারের দরকার নেই।
ফিরলেন আলাউদ্দিন। জালালউদ্দিন বললেন, আমি আসছি তোমার কাছে। তোমাকে স্বাগত জানাতে। এভাবে খিলজি সুলতানতকে বৃদ্ধি করার জন্য তোমাকে সংবর্ধনা দিতে হবে। কিন্তু বেগম সাহিবা এত আবেগাপ্লুত নন। তিনি ভয় পাচ্ছেন। ওই জামাইকে বিশ্বাস নেই। যদি মনে কোনও চক্রান্ত থাকে! অতএব জালালউদ্দিন যেন সম্পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই তৈরি হয়ে যান।
সেকথা কানে যেতেই আপত্তি তুললেন আলাউদ্দিন। বললেন, না। সুলতান নন। একজন শ্বশুর আসবেন আমার কাছে। একজন কাকা আসবেন আমার কাছে। কিন্তু রণসাজে সজ্জিত সুলতান নন। জালালউদ্দিন আর কী করেন। নিরস্ত্র হয়েই আলাউদ্দিনের কাছে গেলেন। আলাউদ্দিনের ব্যক্তিগত রক্ষীদের আগে থেকেই মন্ত্রণা দেওয়া ছিল। তারা সুলতান জালালউদ্দিনকে হত্যা করল টুকরো টুকরো করে।
সিংহাসনে বসেই আলাউদ্দিন স্থির করলেন নতুন রাজধানী করব। শুরু করলেন আলাই দরওয়াজা দিয়ে। যা কুতুব মিনার কমপ্লেক্সের মধ্যেই। কিন্তু নিজের ছাপ রাখতে হবে তো! অতএব বেছে নিলেন নতুন স্থান। নতুন কেল্লা। নতুন রাজধানী। কিন্তু তাঁর রাজধানীর দিকে কেউ যেন চোখ তুলে তাকানোর সাহস না পায়! বিশেষ করে তুর্কি আর মুঘলদের স্বভাব আছে, যখন তখন হিন্দুস্তানে হামলা করা। অতএব আলাউদ্দিন অভিনব পন্থা নিলেন সকলকে আতঙ্কের বার্তা দিতে। তাঁর বন্দিশিবিরে বন্দি থাকা আট হাজারের বেশি মুঘল সেনার শিরশ্ছেদ করার নির্দেশ দিলেন।
সেইসব ধড়হীন মস্তক ফেলা হল কেল্লার ভিতে। সেই ভিতের উপর গড়ে উঠল আলাউদ্দিন খিলজির নতুন রাজধানী ও দুর্গ। সিরি ফোর্ট। অতএব সাবধান! যেখানে পা ফেলছেন আজকের সিরি ফোর্টের ধ্বংসাবশেষ দেখতে এসে, সতর্ক থাকতে হবে। কে বলতে পারে সেই মাটির নীচে কোন মুঘল সেনার মস্তক রয়েছে!