অর্থকড়ি প্রাপ্তির যোগটি বিশেষ শুভ। কর্ম সাফল্য ও চিন্তার অবসান। দেবারাধনায় মন। ... বিশদ
বড্ড গরম পড়েছে আজকাল। একবিন্দু শীতল আদর নেই কোথাও। আগে কি এমন দুঃসহ গরম ছিল? জানি না। কিছুদিন আগেও তো শুনতাম লু নাকি শুধুই দিল্লি আর রাজস্থানে হয়। আর এবার পানাগড় গরমে হারিয়ে দিয়েছে জয়পুরকে। শুধু মনে পড়ে, আমাদের সেই বেড়ে ওঠার ঝিম ধরা দুপুরে লোডশেডিং হয়ে যেত প্রায়ই। আর লোডশেডিং মানেই আজ আর ‘ছুটি ছুটি’ দেখা হল না। গাছের লিচুতে পাক ধরত। দুপুরে ভাতে জল ঢেলে কাঁচা বা শুকনো লঙ্কা, পেঁয়াজ, কাসুন্দি, ভাজা আর চচ্চড়ি দিয়ে খেয়ে মেঝে জুড়ে ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে মোছা শীতলপাটি পেতে মা আর ঠাকুমা ঘুমাচ্ছেন। আঁচল এলিয়ে পড়েছে। অন্যঘরে লাল কুচি কুচি কাপড়ের বর্ডার দেওয়া হাতপাখা নাড়তে নাড়তে চোখ বুজে বিশ্রামের চেষ্টায় আমার পিতামহ। মাঝেমাঝেই হাত থেমে যাচ্ছে। হাতের আগল পেরিয়ে পাখা পড়ছে মাটিতে। অমনি জেগে উঠছেন তিনি। যদি পাশে শুয়েও পড়তাম, ঘুম আসত না। যে বিকেল আসতে তখনও বেশ অনেকটা দেরি, তার রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষায় ছটফট করতাম বিছানাজুড়ে। গায়ে পাখার বাড়ি লাগত। আর লাগলেই তিনবার বিছানায় পাখা ঠুকে দিতেন ঠাকুরদা। গায়ে পাখার বাড়ি নাকি দুর্লক্ষণ। সেটা কাটাতেই এই উপায়। গরমের ছুটিতে বোলতা উড়ত সারা বাড়িময়। পাশের বাড়ি জামরুল গাছটায় লাল সাদা অদ্ভুত মিষ্টি জামরুল ধরত। আমি পাঁচিলে দাঁড়িয়ে পেড়ে পেড়ে খেতাম। মা বকত। পড়ে গেলে পা ভাঙবে। তবুও। সেখানে প্রতি বছর বোলতার বাসা হতো। বাসা ভাঙতে পারত না সবাই। লোক ডাকা হতো। জয়দেবকাকু। একটু খোঁড়া মতন। বেঁটে। এসেই বড্ড যত্ন নিয়ে হাতের কঞ্চিটায় কাপড় জড়াতো। তারপর পরম মমতায় কাপড়ের গায়ে ঢালত কেরোসিন। খানিক তাকিয়ে থাকত। পকেট থেকে দেশলাই বার করে ধরিয়েই ‘সবাই ঘরে যাও’ বলে সেই আগুনকাঠি ছুঁইয়ে দিত বোলতার বাসায়। দৌড়ে ফিরে আসতে আসতে চার-পাঁচটা বোলতা কামড়ে দিত। কাকু ভ্রূক্ষেপ করত না। ফোলা জায়গায় কাঁচা পেঁয়াজের রস বোলাতো। সেদিন পেট ভরে খাওয়া আর কুড়ি টাকা পেত কাকু। অন্যদিন শুনেছি জনমজুরের কাজও করত। একবার আমিও ভাবলাম বোলতা মারব। চাকে ঢিল দিতেই রাশি রাশি বোলতা ঘিরে ধরে সে এক কাণ্ড! শেষে ডাক্তার-বদ্যি করে ঝামেলার একশেষ।
তবু দুপুরটা আমাদের একান্ত নিজের ছিল। সেই ছেলেবেলায় রবি যেমন বলেছিলেন, দিনের বেলার রাত। তেমনি। রঙিন বই, ফেটে যাওয়া বল আর রং পেনসিলের সে জীবনে অন্য কেউ ঢুকতে পারত না। সবুজ মলাটের বাঁধানো রুলটানা পায়োনিয়ার খাতা ছিল একটা। কাউকে না জানিয়ে লেখার জন্য ওই দুপুরের জুড়ি নেই।
তামাটে বিকেল পড়তে না পড়তেই গাছপালারা অদ্ভুতভাবে নীরব হয়ে যেত। সারা গা থেকে ঝরে পরা স্বেদবিন্দুরা বারবার ভিজে গামছা বোলানোতেও শান্তি দিত না। কুঁজোর জল খেতাম ঢকঢকিয়ে। কোনও কোনওদিন আমার পিতামহ আকাশের ঈশান কোণে চেয়ে বলতেন, ‘পূর্বদিকের মেঘ ইস্পাতের মতো কালো। পশ্চিম দিকের মেঘ ঘন নীল। সকালে রৌদ্র ছিল, নিশ্চিন্ত ছিলাম। দেখতে দেখতে বিস্তর মেঘ জমেছে।’ সহজ পাঠের এই লাইনগুলো কণ্ঠস্থ ছিল তাঁর। মা তাড়াতাড়ি উঠে পড়তেন। প্রায় দৌড়ে ছাদের তারে মেলা কাপড় কোনওক্রমে তুলে পাহাড় করে রাখতেন ঘরের ভিতর। এদিকে, আকাশজুড়ে তখন এক সর্বনাশী মেঘ করেছে। আমি নিশ্চিত জানতাম, খানিক বাদেই বুবান, মিঠুনরা এসে ডাক দেবে, ‘আম কুড়াতে যাবি না? এখন না গেলে আর ভাল আম পাওয়া যাবে না। ওপাড়ার সন্তু আর বিকিরা এসে গেলেই হয়ে গেল।’
মা কিছু বোঝার আগেই পালাতে হতো। পিছনের সব ‘কোথায় যাচ্ছিস? মাথায় আমডাল পড়ে গেলে মাথা ফেটে দু’খানা হবে। এক্ষুনি ঘরে আয়’-কে উপেক্ষা করে। আমবাগানে পৌঁছতেই দেখি বাগানের বিভিন্ন কোণে আমাদের মতো জনাদশেক তখনই দাঁড়িয়ে। সবাই আড়চোখে সবাইকে দেখছে। আর দেখছে, কোন গাছের আম কতটা ফলন্ত হয়েছে।
এদিকে বড় একখানা চাদরের মতো ঘন কালো মেঘ ঢেকে ফেলেছে গোটা আকাশ। আমবাগানের অন্ধকারে কেউ কাউকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না। এতক্ষণ যে সামান্য গরম বাতাস বইছিল, সেটাও আচমকা বন্ধ। আমগাছের পাতা তিরতির কাঁপতে শুরু করল। সবাই জানি এর পরেই আসল খেলা শুরু। কেউ যেন রেডি- স্টেডি বলে হুইসেলটা বাজানোর আগে জিরিয়ে নিচ্ছে একটু। তারপরেই হাড়হিম করা এক ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়। গাছগুলো চঞ্চল হয়ে তীব্রবেগে মাথা দোলাতে থাকে। দূরের সুপারি বনের চুলের মুঠি ধরে কে যেন প্রচণ্ড রাগে নাড়াচ্ছে ক্রমাগত। গোটা আমবাগান জুড়ে খড়খড় সরসর এক অদ্ভুত শব্দের মাঝেই দূরে কোথাও ‘ধুপ’ করে একটা শব্দ হল। এ শব্দ সবার চেনা। ‘আম পড়েছে’, ‘আম পড়েছে’ করে অনেকেই দৌড় দিল সেদিকে। কিন্তু তারা কাঁচা খেলোয়াড়। এ খেলার ভেটেরানরা জানে বেশি দৌড়াদৌড়িতে পায়ের ব্যায়াম হয় ঠিকই, কিন্তু লাভের বেলায় ঘণ্টা। তারা পাকা মেছুড়ের মত তিন-চারটে গাছ টার্গেট করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। হাওয়ার বেগ বাড়ে। তাদের দেহের প্রতিটি মাংসপেশি টানটান হয়ে থাকে। কান খাড়া। আম মাটিতে পড়তে না পড়তে শিকারি বাজের মতো ছোঁ মেরে তুলেই হাতের ব্যাগে চালান। মুশকিল হতো, এক খাপে দুই তলোয়ারের মতো এক বাগানে দুই ওস্তাদ থাকলে। এমনিতে এদের এরিয়া ভাগ করা থাকত। কিন্তু গ্রহের ফেরে কোনওদিন হয়তো ‘আজ দু’জনার দু’টি পথ’ একই দিকে বাঁকত। আর তখন বাকিরা প্রমাদ গুনত। আম পড়ামাত্রেই প্রায় সমান সময়ে দু’জনেই দুর্লঙ্ঘ্য নিয়তির মতো চলে আসত সেই আমের কাছে। কিন্তু যে আগে হাত লাগাবে, আম তার। অন্যে যাতে হাত না লাগাতে পারে সেই জন্যে শ্লীল-অশ্লীল কোনও প্রচেষ্টাই বাদ রাখা হতো না। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমারই চোখের সামনে বুবান একটা ডাইভ মারতে যেতেই সন্তু প্রায় ডব্লুডব্লুই-র আন্ডারটেকারের কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর প্যান্ট ধরে মারল এক টান। সরসর করে সেটা চলে এল সন্তুর হাতে। কিন্তু বুকে ভর দিয়ে প্রায় হেঁচড়ে বুবান এর পরেও যেভাবে আমটাকে ব্যাগস্থ করল, দেখলে অগ্নিপথের অমিতাভ বচ্চনও লজ্জা পেতেন। একটু বাদেই সন্তু সাঁইত্রিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে লাফ মেরে উড়ন্ত একটা আম পাকড়াবার আগেই তার নাকের ডগা দিয়ে খপাত করে সেই আম ক্যাচ ধরে নিল মিঠুন। এ আমার নিজের চোখে দেখা। নেহাত ভারতে রাগবি খেলার চল নেই। তা না হলে আমাদের পাড়া থেকেই সেরা রাগবি প্লেয়ারদের জন্ম হতো। আমার মতো কিছু আনাড়ি প্রচুর ছুটে কিছু ছোট ছোট আমের কুশি ছাড়া কিছুই জোগাড় করতে পারত না। সেগুলোই পকেটে পুরে অপেক্ষা করতাম কখন ওস্তাদদের কৃপা হবে।
এখানে ঝড়ে আম কুড়ানোর আর একটা ‘থাম্বরুল’ বলে যাই। বৃষ্টি শুরু হলে আর আমবাগানে থাকতে নেই। তখন বেড়িয়ে এসে সেই সব ওস্তাদের পিছনে পিছনে ঘুরতে হয় অন্তত এক পিস ভালো আমের জন্য। বারণ না শুনে পালিয়ে আসাকে আম দিয়ে জাস্টিফাই না করতে পারলে বাড়ি ফিরে কপালে যা জুটবে, তা কহতব্য নয়। তাই ঝুপ্পুস বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার ধারের এক কালভার্টে এক পা তুলে বসে আম ভাগাভাগি হতো। দেখা হতো কে কেমন আম পেল। ‘আরে, তুই সন্তুর দলে ছিলি না? আমাকে কনুই মারলি। এখন আমের ভাগ নিতে এসেছিস! ভাগ এখান থেকে।’ সে বেচারা তখন প্রাণপণে প্রমাণ করতে ব্যস্ত ‘আমি তোমাদেরই লোক।’ চিঁড়ে ভেজে না। আমায় নেহাত দুধভাত বলে একখানা মাঝারি আম দেওয়া হয়। সেটা নিয়েই বীরদর্পে, মানকচুর পাতা মাথায় ঘরে ফিরি।
সামনের বকুল গাছটা, যেটায় একটা বসন্তবৌরী এসে ঘুরে ঘুরে যেত, নেচে বেড়াত টিয়াপাখিরা, সেটা ঝড়ে উল্টে গোটা রাস্তাজুড়ে আছে। এলাকাজুড়ে ঘন অন্ধকার। লোডশেডিং। খান দু’-এক খোলা জানলা দিয়ে হলদে লন্ঠনের আলো উঁকি মারছে। বাড়ি ফিরেই আগে স্নান করে নিতে হতো। তারপর মায়ের বকার মধ্যেই সেই আম আর আমের কুশি থেঁতো করে নুন, মিষ্টি, অল্প সর্ষের তেল আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে খেয়ে ঝালে শিষোতাম। মা প্রথম দিকে রেগে বলত খাবে না। পরে ‘দে একটু টেস্ট করি’ বলে ঠিকই খেত। মামাদের মুখে শুনেছি, আম কুড়োনোতে মায়ের নাকি জুড়ি ছিল না গোটা অঞ্চলে। সে কথাই মনে পড়ে যেত হয়তো। পরদিন সকালে দোমড়ানো অ্যান্টেনা, ভেঙে যাওয়া বাংলাদেশি বুস্টার আর উঠোনভরা পাতা নিয়ে ঝকঝকে সকাল যেন সদ্য স্নান করে ওঠা শিশুর মতো হেসে উঠত।
এসব কেমন গতজন্মের কথা মনে হয়। জয়দেব কাকু এখনও বেঁচে আছে কি না, জানি না। পাঁচিলের ধার ঘেঁষা পাশের বাড়ির জামরুল গাছটা কাটা পড়েছে। ওখানে এখন তীব্র রোদ। বোলতারা বাসা বাঁধতে আসে না আর। দুপুর হতে না হতেই নতুন এক গুনগুন শুরু হয় সব বাড়িতে। বোলতার ডানার না, ঠান্ডা এসি মেশিনের। প্রকৃতির নিয়ম মেনে কালবৈশাখী আসে। সন্তু, বুবান, মিঠুনরা ফেসবুকের এক ক্লিক কিন্তু আদতে অনন্ত মাইল দূরে। কবে তারা দূরতর নক্ষত্রমালা হয়ে গেল, টেরই পেলাম না। আমাকে কেউ আর আম কুড়াতে ডাকে না।
দু’বছর হল, সেই আমবাগান বিক্রি হয়ে বিরাট মার্কেটিং কমপ্লেক্স হয়েছে। তার ফ্রিজে থরে থরে রাখা বহুজাতিক কোম্পানির সিলপ্যাক করা কাঁচা আমের আমপান্না। ‘খেয়ে দেখুন। একেবারে ফ্রেশ মাল’—দোকানদার বলল সেদিন।