অর্থকড়ি প্রাপ্তির যোগটি বিশেষ শুভ। কর্ম সাফল্য ও চিন্তার অবসান। দেবারাধনায় মন। ... বিশদ
১৯৭১ সালের সাধারণ নির্বাচনে এক বিদেশি পত্রিকার সাংবাদিক ইন্দিরা গান্ধীকে প্রশ্ন করেছিলেন, এবার নির্বাচনে প্রধান ইস্যু কী? হোয়াট ইজ দ্য ইস্যু ইন দিস ইলেকশন?
ইন্দিরা গান্ধী প্রশ্নকর্তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম দ্য ইস্যু!’
অতি আত্মবিশ্বাস এবং আত্মগরিমায় ইন্দিরা গান্ধীকে টেক্কা দিতে পেরেছেন, এরকম রাজনীতিবিদ স্বাধীন ভারতে আসেননি। ১৯৮০ সালের লোকসভা ভোটে একদিনে চারটি রাজ্যে একের পর এক নির্বাচনী সভায় ভাষণ দেওয়ার পর রাত ১০টায় দিল্লি ফিরেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। মাত্র তিন বছর আগে তিনি এবং তাঁর দল সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়েছিলেন জনতা পার্টির জোটের কাছে। ভারতবাসী তাঁকে শিক্ষা দিয়েছিল জরুরি অবস্থার জন্য, গণতন্ত্রকে আঘাত করার জন্য। কিন্তু সেই জনতা পার্টি আড়াই বছরও পারল না দেশশাসন করতে। সুতরাং ১৯৮০ সালের সেই ভোটে তিনি যে পুনরায় ক্ষমতাসীন হচ্ছেন, সেই আভাস পাওয়াই যাচ্ছিল। অন্ধ্রপ্রদেশের এক শিল্পপতির থেকে ভাড়া নেওয়া একটি ছোট ফকার এয়ারক্র্যাফ্টে চেপে ইন্দিরা গান্ধী সভা করছিলেন দেশজুড়ে। মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশের সভা শেষে রাত ১০টায় দিল্লি এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার পর দেখা যাচ্ছিল, ল্যাডার আসতে দেরি হচ্ছে। ল্যাডার অর্থাৎ প্লেনের দরজায় যে সিঁড়ি লাগানো হয়।
ইন্দিরা গান্ধী পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর ব্যক্তিগত সচিব যশপাল কাপুরকে ডেকে বলেছিলেন, ‘কাপুর, টারম্যাকের গ্রাউন্ড কতটা নীচে এয়ারক্র্যাফ্ট থেকে?’
কাপুর বললেন, ‘১০ ফুট ম্যাডাম!’
ইন্দিরা গান্ধী বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি আর ওয়েট করতে পারব না। মানুষ আমার জন্য এই রাতে অপেক্ষা করছে। আমি নেমে যাচ্ছি! জাম্প করে! তোমরা ল্যাডার আসার পর এসো!’
বিস্ফারিত নেত্রে কাপুর, পাইলট এবং এয়ার ক্রুরা দেখলেন, ইন্দিরা গান্ধী শাড়ি পরে লাফ দিলেন। তাঁর গাড়ি অপেক্ষা করছিল টারম্যাকের বাইরে। নেমেই দৌড়লেন। আর গাড়িতে বসে সামান্য একটু টাচ-আপ করে নিলেন মুখের। তাঁর গাড়িতে একটি পোর্টেবল টিউবলাইট রাখা থাকত। সেটি এমন একটি অ্যাঙ্গলে বসানো হতো, যাতে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে থাকে অন্ধকারে। রাতে তিনি যেখানেই যেতেন এই ব্যবস্থা থাকত, যাতে সকলে তাঁকে দেখতে পায়। ওই রাতে দিল্লির তিনটি সভায় ভাষণ দিয়ে মধ্যরাতে বাড়ি ফেরেন। পরদিন একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছিল। জনমত সমীক্ষা। ওরকম সমীক্ষার কথা ভারতবাসী আগে কখনও শোনেনি। দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের দুই প্রাক্তন ছাত্র প্রণয় রায় এবং অশোক লাহিড়ীর সেই সমীক্ষায় পূর্বাভাস দেওয়া হয়, ইন্দিরা গান্ধী বিপুলভাবে জয়ী হয়ে ফিরছেন। ১৯৮০ সালের ভোটের ফলাফল কী হয়েছিল? ইন্দিরা কংগ্রেস পেয়েছিল ৩৫৩ আসন। ১৯৭১ সালে থেকেও একটি আসন বেশি।
১৯৮০ সালের ভোটে ইন্দিরা গান্ধী ধর্মনিরেপেক্ষতা, সকলের জন্য সাম্য, উন্নয়ন—এসব কোনও ইস্যুতে জোর দেননি। তাঁর এক ও একমাত্র স্লোগান ছিল, ‘জনতা হো গঈ ফেল/কাহা গঈ চিনি অউর মিট্টি কা তেল?’ জনতা পার্টির আমলে চিনি, তেল, কেরোসিন তেল, ডাল ইত্যাদি নিত্যপণ্যের প্রবল অভাব এবং মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছিল। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন নিখুঁত রাজনীতিবিদ। তিনি বুঝেছিলেন, মানুষের প্রতিদিনের জীবনের সমস্যাকেই ইস্যু করতে হবে। তাই অন্য কোনও আক্রমণ করেননি। ১৯৮০ সালের ভোটকে তাই বলা হয়ে থাকে চিনি আর কেরোসিনের ভোট! ইন্দিরা গান্ধী রূপকথার মতো ফিরে এলেন অতল খাদের গহ্বর থেকে। একাই জিতলেন অতগুলো আসন।
ঠিক সেই নির্বাচনের আগেই একটি নতুন দল গঠিত হয় দু’জন মানুষের হাত ধরে। তাঁরা ছিলেন জনতা পার্টির সরকারের অংশীদার। তারও আগে জনসঙ্ঘের নেতা। জনসঙ্ঘের আদর্শেই তাঁরা গঠন করেন নতুন দল। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। তাঁরা হলেন লালকৃষ্ণ আদবানি এবং অটলবিহারী বাজপেয়ি। আর সেই নতুন দল— ভারতীয় জনতা পার্টি।
১৯৬৭ সালে প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। মাত্র চার বছরের মধ্যে কীভাবে তিনি এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন? ১৯৭১ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার রহস্যটা ঠিক কী? সেটা হল, একটি আশ্চর্য স্লোগান এবং ইস্যু। সবথেকে সহজ একটি কথা। অথচ তার অভিঘাত আর প্রভাব আজও শক্তিশালী। ১৯৭০ সালের ১৫ আগস্ট লালকেল্লা থেকে ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী প্রথম সেই স্লোগান দেন। ‘গরিবি হটাও’। সেটাই ১৯৭১ সালে কংগ্রেসের স্লোগান হয়ে গেল—‘গরিবি হটাও, ইন্দিরা লাও, দেশ বাঁচাও।’ ওই এক স্লোগানেই কিস্তিমাত।
১৯৫১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর লুধিয়ানা থেকে প্রথম নির্বাচনী সভা শুরু করলেন জওহরলাল নেহরু। কমিউনিস্ট নয়, কৃষক মজদুর প্রজা পার্টি নয়, সোশ্যালিস্ট পার্টিও নয়, প্রথম থেকেই জওহরলাল নেহরুর নির্বাচনী প্রচারে আক্রমণের লক্ষ্য ছিল সাম্প্রদায়িকতা। প্রথম দিন সেকথা জানিয়েও দিলেন তিনি। ২ অক্টোবর দিল্লির জনসভায় নেহরু বললেন, ‘ধর্মের নামে রাজনীতি করলে, ধর্মের জিগির তুলে বিভাজন তৈরি করে দেশের সর্বনাশ যা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আমার লড়াই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চলবে।’ ১৯৫১ এবং ১৯৫২ সাল ছিল ভারতের প্রথম লোকসভা ভোট। নেহরুর সবথেকে বড় ভরসা যিনি, সেই সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল নেই। পুরনো সঙ্গীরাও তাঁকে ছেড়ে গিয়েছে। অতএব প্রথম নির্বাচনে নেহরু ছিলেন সম্পূর্ণ একা। একাই ২৫ হাজার কিলোমিটার ঘুরেছেন। সেই নির্বাচনে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জনসঙ্ঘের স্লোগান ছিল সবথেকে চিত্তাকর্ষক... ‘জনসঙ্ঘ কো ভোট দো/বিড়ি পিনা ছোড় দো/বিড়ি মে তামাকু হ্যায়/কংগ্রেসওয়ালা ডাকু হ্যায়।’
দেশের তাবৎ শহরের থেকে কলকাতার প্রচার কতটা আলাদা ছিল সেই প্রথম লোকসভা ভোটে? সেটা এককথায় অভিনব! কংগ্রেসের কার মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল জানা নেই। তবে কলকাতায় সব মানুষের কাছে অনায়াসে পৌঁছতে এভাবে বিনা ব্যয়ে এবং বিনামূল্যে দলের প্রচার যে করা যায়, তার নমুনা ছিল ওই কৌশল। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা গোরুর শরীরে লিখে দেওয়া হয়েছিল—‘এই চিহ্নে ভোট দিন, কংগ্রেসকে ভোট দিন’। কারণ, কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক ছিল গাই বাছুর। গোরুর গায়ে পোস্টার লিখে জীবন্ত প্রতীককে মানুষের সামনে দিয়ে ঘোরাফেরা করিয়েছিল তারা।
প্রথম নির্বাচন আবার সেই অর্থে ছিল আন্তর্জাতিকও। কারণ আশ্চর্য ব্যাপার, রেডিও প্রচারে সবাইকে টেক্কা দিল কমিউনিস্টরা। তবে ভারতীয় রেডিও নয়, সেই ভোটে মস্কো রেডিও থেকে প্রচার করা হতো কমিউনিস্টদের ভোট দেওয়ার আহ্বান। তাসখন্দ রেডিও স্টেশন থেকে তখন সম্প্রচারিত হতো মস্কো রেডিওর প্রোগ্রাম। সুতরাং নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাসখন্দ রেডিও ধরা গেলেই, শোনা গিয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে ভোট দেওয়ার আবেদন। প্রত্যাশিতভাবেই সেই নির্বাচনে নেহরুর কংগ্রেসই বিপুল সংখ্যায় আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছিল।
কতটা জনপ্রিয় ছিলেন নেহরু? দেশের অন্তত চারটি প্রান্ত থেকে সংবাদ এসেছিল যে, কয়েকজন ভোটার এসেছিলেন নেহরুকে ভোট দেবেন বলে। কিন্তু তাঁদের লোকসভা কেন্দ্রে তো আর নেহরু প্রার্থী নন! এতসব তাঁরা বুঝতেন না। প্রথম নির্বাচনে মানুষের ভোটপ্রদানের অভিজ্ঞতাই তো ছিল না। সুতরাং নেহরুর নামের পাশেই যদি ভোট দিতে না পারেন, তাহলে ভোট দিয়ে লাভ কী? এই ভেবে ফিরে চলে গিয়েছিলেন সেই ভোটাররা!
১৯৫৭ সালের সাধারণ নির্বাচন আবার দু’টি কারণে ইতিহাসে অমর। প্রথম ঘটনাটি ঘটে বিহারের বেগুসরাইতে। রাচিয়ারি গ্রামের কাছারি টোলা বুথে ভোট দিতে পারলেন না কোনও সাধারণ ভোটার। কেন? কারণ, সেই বুথে ঢুকে পড়েছিল এক প্রার্থীর গুন্ডারা। সেই প্রার্থীর নাম সরযূ প্রসাদ সিং। আর ওই গুন্ডা দলের নেতৃত্বে ছিলেন এক পরাক্রমী, কামদেও সিং। স্বাধীন ভারতের ভোট প্রক্রিয়ায় সেই জন্ম হয়েছিল ‘বুথ দখল’ নামক শব্দের, যে ট্র্যাডিশন আজও চলছে। সেবার নিখুঁতভাবে বুথ দখল করার কৃতিত্ব দেখানোয়, পরবর্তী বছরগুলিতে কামদেও সিংয়ের চাহিদা বেড়ে গেল খুব। একের পর এক নির্বাচনে তাঁকে নিয়োগ করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে রাজনৈতিক দলগুলি। যে যত বেশি টাকা দেবে, কামদেও তার কন্ট্র্যাক্ট আগে নেবে—এই ছিল ব্যবস্থা! এবং ১৯৫৭ সালের ওই নির্বাচনে দ্বিতীয় রাজনৈতিক ঘটনাটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ। সেই প্রথম কংগ্রেস ছাড়া অন্য একটি রাজনৈতিক দল কোনও রাজ্যের মসনদে আসীন হয়। কেরলে সরকার গঠন করে কমিউনিস্ট পার্টি।
জার্মানি থেকে যে এইচডিডব্লু সাবমেরিন কেনা হচ্ছে, সেটার দাম কমানো সম্ভব নয়। কারণ, ৭ শতাংশ কমিশন দিতে হবে ভারতীয় কোনও এক এজেন্টকে। এই মর্মে একটি টেলিগ্রাম এসেছিল। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি পি সিংয়ের কাছে। টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। প্রতিরক্ষা সচিব এস কে ভাটনগরকে ডেকে পাঠালেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। জানতে চাইলেন, ‘কী ব্যাপার?’ ভাটনগর জবাব দিলেন, ‘দেশের প্রভাবশালী বিজনেস ফ্যামিলি এই ডিলে আছে।’ ভি পি সিং সঙ্গে সঙ্গে জানালেন, ‘ডিল আপাতত স্থগিত। তদন্ত কমিটি গড়ুন।’
৯ এপ্রিল, ১৯৮৭। শুধু তদন্ত কমিটি গঠন করা নয়। ভি পি সিং প্রেস নোট তৈরি করে বিবৃতিও দিলেন। প্রবল শোরগোল। সংসদ উত্তাল। রাজীব গান্ধীর কাছে জবাব চাইছে বিরোধীরা। দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ১০ মিনিটের মধ্যে সংসদের চেম্বারেই ভি পি সিংকে ডেকে পাঠালেন রাজীব গান্ধী। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘আপনি কীভাবে জানলেন যে এই টেলিগ্রাম জাল নয়? একটা টেলিগ্রামের উপর বিশ্বাস করে বিবৃতি দিয়ে দিলেন?’
ভি পি-র পাল্টা প্রশ্ন, ‘আপনি কীভাবে জানলেন যে টেলিগ্রাম সঠিক নয়?’
রাজীব বললেন, ‘আপনার তদন্ত কমিটির ভবিষ্যৎ কী?’
ভি পি উত্তর দিলেন, ‘আপনিই তো দু’বছর আগে নিয়ম করেছেন যে, ডিফেন্স ডিলে কোনও দালাল অথবা এজেন্ট থাকবে না। সরাসরি সরকারের সঙ্গে চুক্তি হবে অস্ত্র সংস্থার। সুতরাং দালাল থাকলে ডিল হবে না।’
রাজীব গান্ধী কোনও কথা বললেন না।
১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন ভি পি সিং। একের পর নোট পাঠাচ্ছেন। কোনও উত্তর নেই। দিল্লির সাউথ ব্লকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক,আবার সেই বিল্ডিংয়েই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। সুতরাং অপেক্ষা করছেন ভি পি সিং। উত্তর নেই। সারাদিন অপেক্ষা করলেন। কোনও উত্তর এল না। পুত্র অভয়কে নিজেদের গাড়ি নিয়ে আসতে বললেন ভি পি সিং। সরকারি গাড়ি নয়, মারুতি ওমনিতে চেপে সোজা হাজির ৭ নং রেস কোর্স রোডে। দেখা করবেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। কিন্তু রাজীব গান্ধী নেই। ভি পি আর দেরি করলেন না। পকেটে করে নিয়ে এসেছেন ইস্তফা পত্র। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেন তিনি।
ঠিক তিনদিন পরের কথা। ১৪ এপ্রিল। সুইডিশ রেডিও সংস্থা জানাল একটি বিস্ফোরক তথ্য। ১৫৫ এমএম হাউইৎজার কামান বিক্রির জন্য ভারতের বেশ কিছু মানুষকে ঘুষ দিয়েছে সুইডেনের সংস্থা বোফর্স। যাঁদের ঘুষ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে একজনের নাম ‘কিউ!’
কে এই ‘কিউ’? সন্দেহ করা হল তাঁর নাম কাত্রোচ্চি। অত্তাভিও কাত্রোচ্চি। সোনিয়া গান্ধীর পারিবারিক বন্ধু। ব্যস, বিরোধীদের আর কিছুর দরকার পড়ল না। ১৯৮৯ সালের লোকসভা ভোট হল যে ইস্যুতে, তার নাম ‘বোফর্স চুক্তি!’ মাত্র ৫ বছর আগে যিনি চারশোর বেশি পেয়ে সরকার গঠন করেছিলেন, সেই রাজীব গান্ধী মুখ থুবড়ে পড়লেন মাত্র একটি ইস্যুতেই! অথচ সেই বোফর্স কাণ্ডে ঘুষ সত্যিই কাকে দেওয়া হয়েছিল? তার উত্তর আজও জানা যায়নি। তদন্ত সমাপ্ত করতে না পেরে সিবিআই ফাইলই ক্লোজ করে দিয়েছে।
স্বাধীন ভারতের প্রতিটি লোকসভা নির্বাচনেই যে একটি করে ইস্যু ভোটকে প্রভাবিত করেছে, এমনটা নয়। ১৯৯১ সালের ভোটে যাদের কাছে কোনও ইস্যু ছিল না, সেই কংগ্রেসই সবথেকে বেশি আসন পেয়ে জয়ী হয়েছিল। অথচ তাদের বিরোধীপক্ষে ছিল মণ্ডল এবং মন্দির। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের ওবিসিদের ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ ইস্যুর পাশাপাশি উঠে এসেছিল মহাশক্তিমান একটি স্লোগান, ‘রামমন্দির।’ লালকৃষ্ণ আদবানির ১৯৯০ সালের অযোধ্যা যাত্রা যে আলোড়নের জন্ম দিয়েছিল, সেই রাজনীতির প্রভাব মাত্র একটি ভোটে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং তারপর থেকে লাগাতার প্রতিটি ভোটে বিজেপির কাছে তা আরও তীব্র ও জোরদার এক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
ভারতীয় জনতা পার্টি ১৯৮৪ সালে দু’টি মাত্র আসনে জয়ী হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে ক্রমবর্ধমান তাদের উত্থান। অন্য সব দলের আদর্শ বদলে গিয়েছে। পাল্টে গিয়েছে প্রচারের অভিমুখ। এক ও একমাত্র বিজেপি প্রবল হিন্দুত্বকে কখনও পিছনের সারিতে রাখেনি। দলের মুখ যিনিই হোন, বিজেপির কাছে এক ও একমাত্র প্রধান ইস্যু বরাবর থেকেছে ‘হিন্দুত্ব’। শুধু কৌশলটা পাল্টে গেল ১৯৯৯ সালের পর থেকে। অটলবিহারী বাজপেয়ি থেকে নরেন্দ্র মোদি। বাজপেয়ি উন্নয়ন এবং হিন্দুত্বকে পৃথক উচ্চারণে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন। আর নরেন্দ্র মোদি সরিয়ে দিলেন সেই পৃথক উচ্চারণকে। অত্যন্ত নিপুণভাবে প্রচারের সিংহাসনে বসালেন ‘হিন্দুত্ববাদী উন্নয়ন’কে।
ভোটে জেতার জন্য যে ইস্যু নয়, স্লোগানই প্রধান— এটাই যেন নরেন্দ্র মোদি প্রমাণ করে দিচ্ছেন অবিরত। ১৯৯৮ সালে বিজেপি ভোটের স্লোগান করেছিল ‘আব কি বারি/অটলবিহারী।’ কিন্তু ছ’বছরের মধ্যে ব্যক্তিপুজো থেকে তারা সরে এল। ২০০৪ সালে ভারতের উন্নতির স্বপ্ন ফেরি করল বিজেপি। গ্রে ওয়ার্ল্ডওয়াইড নামক একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই সংস্থা স্লোগান তৈরি করল, ‘ইন্ডিয়া শাইনিং!’ সেই সময় প্রচারে ৭০০ কোটি টাকা খরচ করেছিল গেরুয়া শিবির। পাল্টা অভিনব কৌশল নিয়েছিল কংগ্রেস। প্রতিটি ইন্ডিয়া শাইনিং স্লোগান ও পোস্টারের নীচে ব্যানার ও পোস্টার লাগিয়েছিল, ‘আম আদমি কো কেয়া মিলা? কংগ্রেস কা হাত, আম আদমি কে সাথ।’ তাতেই ঘটে যায় আশ্চর্য ফলাফল। বাজপেয়ি সরকার যে ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে, কল্পনাই করা যায়নি।
রাজনীতি, নির্বাচন, জনপ্রিয়তা এবং ভোটে জয়—এই প্রত্যেকটি বিষয় যে একমাত্র স্লোগান, স্লোগান এবং স্লোগানই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তার প্রমাণ দিলেন নরেন্দ্র মোদি। অগিলভি সংস্থার হাত ধরে ২০১৪ সালে ‘আচ্ছে দিন’ এবং ‘আব কি বার, মোদি সরকার’ স্লোগান এনে। তাতেই সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলেন মোদি। প্রশান্ত কিশোরকে দিয়ে তৈরি হল, ‘চায়ে পে চর্চা’! সেই রেকর্ড জয়ের ধারে কাছে দাঁড়াতে পারেনি বিরোধী কংগ্রেস। ২০১৯ সালে একটি বিদেশি অ্যাড এজেন্সির হয়ে বিজেপির পক্ষে স্লোগান তৈরি করেছিল বিখ্যাত এক বিজ্ঞাপনী সংস্থা। স্লোগান ছিল, ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ এবং ‘ফির একবার মোদি সরকার’! ২০১৯ সালের পর থেকেই বিজেপি নিজেদের সম্পূর্ণ মোদির দলে পরিণত করেছে। বিজেপি নামটাই আর স্লোগান বা প্রচারের ক্যাচলাইনে ব্যবহার করা হয় না। বিজেপি মানেই মোদি, মোদি মানেই বিজেপি!
২০২৪। দেশ ও বিদেশের চারটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা। একঝাঁক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কর্পোরেট। এসবের যোগফল হল বিজেপির নতুন স্লোগান—‘মোদি কি গ্যারান্টি!’ ঠিক তার বিপক্ষে কংগ্রেস এনেছে দু’টি শব্দ, ‘হিসাব দো!’ অর্থাৎ জনতা যেন জানতে চায়, ‘আমি কী পেলাম, তার হিসাব দাও!’ জনতা হিসেব চাইবে? নাকি মোদির গ্যারান্টিতে বিশ্বাস করবে?
১৯৫১। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, এক বাঙালি আইসিএস অফিসার সুকুমার সেনের হাত ধরে ভারতের গণতন্ত্র এক অলীক যাত্রা শুরু করেছিল। তার নাম নির্বাচন। ১৭ কোটি ভোটার। যাঁদের ৮৫ শতাংশই নিরক্ষর। সেই অলৌকিক কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল সুষ্ঠুভাবে। ৭৩ বছর পর আবার একটি নির্বাচন পর্ব হাজির। ৯৭ কোটি ভোটার স্থির করছে একঝাঁক দলের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ! একঝাঁক ব্যক্তির ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ! গণতন্ত্রের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ! এবং ভারতের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ!