মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
শুনেছিলাম স্বয়ং ঈশ্বর না টানলে তীর্থস্থান অদেখাই থেকে যায়। সম্প্রতি কেদার যেতে গিয়ে এই সারসত্যটি অনুভব করলাম। পুজোর সময় কেদার যাওয়ার হেলিকপ্টারের টিকিটের জন্য হন্যে হয়েও যখন কিছুতেই টিকিট হল না, তখন হেলিসার্ভিসে কর্মরত এক বন্ধুর দ্বারস্থ হলাম। সে অভয় দিল, টিকিট এজেন্টের যোগাযোগ নম্বরও দিল এবং বলল আমাদের জন্য নাকি টিকিট রাখা থাকবে। শিব ঠাকুরের নাম জপতে জপতে আমরাও নির্দিষ্ট দিনে রাত থাকতেই ফাটা-র উদ্দেশে রওনা দিলাম। কিন্তু ফাটা হেলি স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম বিধি বাম। দেবাদিদেব মহাদেবের ডাক আসেনি আমাদের জন্য। অগত্যা একরাশ মনখারাপ নিয়ে চোপতা অভিমুখে যাত্রা করলাম। পরের দিন সকালে উঠে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়ে গেল। রোদ ঝলমলে নীল আকাশকে সঙ্গী করে আমরা এবার নতুন অ্যাডভেঞ্চারে মেতে উঠলাম। গন্তব্য তুঙ্গনাথ।
পঞ্চকেদারের সর্বোচ্চ মন্দির তুঙ্গনাথ। ১২,১০৬ ফুট উচ্চতায় তুঙ্গনাথের মন্দিরের অবস্থান। তার ঠিক মাথায় চন্দ্রশীলা পর্বতশৃঙ্গ। তুঙ্গনাথ পৌঁছতে গেলে সাড়ে চার কিলোমিটার চড়াই ভাঙতে হয়। পায়ে হাঁটার অভ্যাস আমার মোটেও নেই। তাও মনের জোর আর সঙ্গীদের সাহসে ভর করে রওনা হলাম তুঙ্গনাথের উদ্দেশে। গাড়ি যেখানে নামিয়েছিল, মন্দিরের প্রথম প্রবেশদ্বারটি সেখানেই। মাথার উপর ঝুলন্ত ঘণ্টা বাজিয়ে পাহাড়ি পথ ভাঙতে শুরু করলাম আমরা। প্রথম কয়েক ধাপ ওঠার পরেই দোকান থেকে লাঠি জোগাড় হল একখানা। পঞ্চাশ টাকা জমা। আর কুড়ি টাকা ভাড়া। অতএব ফিরতি পথে লাঠি জমা দিলে তিরিশ টাকা ফেরত দেবেন দোকানি।
খাড়া রাস্তাটা সোজা উঠে গিয়েছে সাড়ে চার কিলোমিটার। এই পথে প্রকৃতি সারাক্ষণের সঙ্গী। এক ধারে হিমালয়ের সুউচ্চ শৃঙ্গ আর অন্য ধারে বিস্তৃত বুগিয়াল। চোপতা মালভূমির ঢাল বেয়ে তা যেন সবুজ গালিচার মতো বিছানো। বুগিয়ালের ধার দিয়ে টানা চলেছে পাইনের বন। ঘন সবুজ পাইন গাছের মাথায় টুকরো টুকরো সাদা বরফের মুকুট। ঝলমলে রোদ আর কনকনে ঠান্ডার যুগলবন্দি উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চললাম তুঙ্গনাথ দর্শনের আশায়।
গোটা পথ জুড়ে চায়ের দোকান। ফলে ঠান্ডায় উষ্ণ চুমুকের জন্য প্রাণ ব্যাকুল হলেই টি ব্রেক নিতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন হাঁটার চেয়ে থামার ভাগ বেশি হলে মুশকিল। চা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের এনার্জি ড্রিঙ্ক পাবেন। জারিকেনে ভরা টুকটুকে লাল তরলটি দৃশ্যাকর্ষক। ওটা নাকি গুরাস (রডোডেনড্রন) ফুলের রস। দেখতে সুন্দর হলেও খেতে ভরসা হয়নি।
চড়াই পথ যদি হাঁটতে না চান তাহলে ঘোড়াতেও পাড়ি দিতে পারেন। তবে ঘোড়ার কখনও লম্ফঝম্প, কখনও বা খাদের ধার ঘেঁষে ঘাস খাওয়ার প্রবণতায় অনেক আরোহীকেই ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলতে দেখলাম। সেক্ষেত্রে পথের সৌন্দর্য অধরাই থেকে যাবে। পথের ধার বরাবর অনেক জায়গায় রেলিংও লাগানো রয়েছে। হাঁটাপথের অনন্ত চড়াই ভাঙার সময় এই রেলিংগুলো খুবই উপকারী বন্ধুর মতো আপনার হাতে ধরা দেবে। বেশ খানিকটা পথ চলার পর চোখের সামনে চোপতার মালভূমির অসম্ভব সৌন্দর্য দেখলে মনে হবে পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তবে তা এখানেই। যত উপর দিকে উঠবেন ততই প্রকৃতি রুক্ষ হতে থাকবে। ঠান্ডা বাড়বে, পথের চড়াইও ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। তাই বলে হার মানলে চলে? এতটা উঠে এসেছি যখন আর তো মাত্র অল্পই পথ বাকি। ট্রেকপথে অচেনা সফরসঙ্গীদের অভয়বাণী মনের জোর বাড়াতে মহৌষধির কাজ করে।
তখনও বেশ খানিকটা পথ চড়া বাকি, মন্দিরের চূড়াটা দৃশ্যমান হল প্রথম। সঙ্গে সঙ্গে চলার গতি এক লাফে প্রায় একশো গুণ বেড়ে গেল। শিবের মন্ত্র জপতে জপতে পৌঁছে গেলাম মন্দির চত্বরে। অসম্ভব শান্ত পরিবেশ। বিস্তীর্ণ চাতালকে সমুখে রেখে উঁচু মন্দিরটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দর্শনার্থীরা প্রসাদের থালা হাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন ঠাকুর দর্শনের আশায়। মোটামুটি জনা কুড়ি লোকের লাইন ঠেলে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। আলো আঁধারে ঢাকা মন্দিরের প্রবেশদ্বারটির কিছু অংশ রুপোয় মোড়া। সামনে কষ্টিপাথরের শিব। ধূপের ঘ্রাণ আর প্রদীপের শিখায় আবৃত মহাদেব। পুরোহিত মশাই তাঁরই কাছে সামান্য পাশ করে দাঁড়িয়ে ভক্তদের একে একে পুজো করিয়ে দিচ্ছেন মন্ত্র পড়ে। নাম গোত্র জানিয়ে অনেকে বাবার পুজো দিচ্ছেন। কেউ বা শিবের স্তোত্র লেখা একফালি কাপড় মন্দির চত্বরে বেঁধে দিয়ে আসছেন মনোবাঞ্ছা জানিয়ে। এত কিছু যদি না-ও করেন তবু মন্দির চত্বরে বসে থাকলেই শান্তি মিলবে। তুঙ্গনাথে গাড়ওয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের হোটেলও আছে। চাইলে একরাত সেখানে থাকতেও পারেন। সেক্ষেত্রে পরের দিন রাত থাকতেই চন্দ্রশীলায় সূর্যোদয় দেখে ফেরার পথ ধরতে হবে। আমরা অবশ্য এতটা অ্যাডভেঞ্চার করার সাহস পাইনি।
মন্দির দর্শন ও পুজো দিয়ে দুপুর নাগাদ নামার পথ ধরলাম। একই চড়াই ভেঙে নামতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল আমার। তার উপর আবার পথে লাগাতার ঘোড়ার উপদ্রব। তাদের মর্জিমাফিক চলতে হবে আপনাকে। না হলেই গুঁতো খাওয়ার ভয়। বেলা যত গড়াতে লাগল তত আকাশের মুখ ভার। মেঘ করে বৃষ্টি নামল ঝেঁপে। অন্ধকার পাহাড়। কোনওক্রমে চায়ের দোকানে গা ঢাকা দিলাম। দোকানি বৃদ্ধা সঙ্গে সঙ্গে মুখের সামনে হাজির করলেন ধূমায়িত চায়ের গ্লাস। হিমেল বাতাস আর অঝোর বৃষ্টিতে তাই যেন অমৃত। সেখান থেকেই রেনকোটও জোগাড় হল। রেনকোট মানে পলিথিনের বড় টুকরো, তাতে মাথা আর হাত গলানোর জায়গা করা। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে তাই যথেষ্ট। গরম চা থেকে সঞ্চিত শক্তির উপর ভর দিয়ে আবারও পাহাড়ি পথে নেমে পড়লাম। চাপ চাপ অন্ধকার, অঝোর বৃষ্টি, ফাঁকে ফাঁকে বিদ্যুতের লেলিহান চমকে শিহরন জাগছিল। ভয়মিশ্রিত অসম্ভব রোমাঞ্চও ঘিরে ধরেছিল। পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছে বৃষ্টি থামল। মেঘের আড়াল থেকে সূর্যদেব প্রকট। কমলা আভা এঁকেবেঁকে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে কালো মেঘের ফাঁকে। আহা, সে কী দৃশ্য!
নিকষ কালো চোপতার আঁকাবাঁকা পথে ছুটেছে গাড়ি। আমাদের রাতের আস্তানা চোপতা মেডোস। পরের দিন রওনা হব বদ্রীনারায়ণের উদ্দেশে।