পারিবারিক সম্পত্তি ভাগাভাগিতে লাভবান হবেন । ব্যবসায়িক ক্ষেত্রটি কম বেশি চলবে। শিক্ষার্থীদের পক্ষে দিনটি শুভ। ... বিশদ
গত ১২ ফেব্রুয়ারি আমরা পেরিয়ে এলাম বাংলা তথা ভারতীয় নাট্যমঞ্চের পুরোধা অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর ৮৪তম প্রয়াণদিবস। কিংবদন্তি এই অভিনেত্রীর মঞ্চাভিনয় শুরু হয় মাত্র ১২ বছর বয়সে। অথচ শ্রেষ্ঠত্বের মধ্যগগনে পৌঁছতেই তিনি অভিনয় ছেড়ে দেন। অকস্মাৎ ধূমকেতুর মতো উত্থান এবং ধূমকেতুর মতোই নিঃশব্দে মিলিয়ে যাওয়া!
উত্তর কলকাতার কুখ্যাত ও নিন্দিত এলাকায় বেড়ে ওঠা। চরম অভাবের সংসার। বাধ্য হয়ে মাত্র ৯ বছরেই বাইজিসঙ্গে নাম লেখান। সঙ্গে চলে নাট্যচর্চা। ১৮৭৪ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষের পরিচালনায় একটি নাটকে অভিনয়ের জন্য অপ্রত্যাশিতভাবে ডাক পান। সদ্যকিশোরী, কিন্তু আবির্ভাবেই বাজিমাত! তবে অবশ্যই তাকে ঘষেমেজে আরও তৈরি করার কৃতিত্ব ছিল মুকুটহীন নটরাজ গিরিশ ঘোষের। বিনোদিনীর ভাষায়, ‘তাঁহার নবীনা ও প্রথমা ছাত্রী বলিয়া একসময়ে নাট্যজগতে আমার বেশ গৌরব ছিল।’
অভাবের তাড়নায় শৈশবেই বিয়ে হয়ে যায় বিনোদিনীর। কিন্তু তা টেকেনি। স্বামীটি ইতিমধ্যেই অন্যত্র বিয়ে সেরে রেখেছিলেন। এই প্রতিভাধর নটী তাঁর ২৯ বছরের নাট্যজীবনে মোট ৮০টি নাটকে ৯০টি ভূমিকায় মঞ্চে অবতীর্ণ হন। তার মধ্যে রয়েছে সীতা, প্রমীলা, দ্রৌপদী, রাধিকা, কৈকেয়ী, উত্তরা কৈকেয়ী, দময়ন্তী-সহ আরও বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য চরিত্র। এক মেঘনাদবধ কাব্যেই তাঁরই ভূমিকা ছিল ৬টি। একাধারে প্রমিলা, বারুণী, মায়া, মহামায়া, রতি এবং সীতার চরিত্র করেছিলেন বিনোদিনী। এমনকী একই মঞ্চে, একইসঙ্গে ১৩টি চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। আবার নেতিবাচক চরিত্রেও তিনি ছিলেন সমান সাবলীল। যেমন: কুন্দ, কাঞ্চন, চৈতন্য, বিলাসিনী, চিন্তামণি ও রঙ্গিনী। নাট্যজগতে এসে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বেরও সংস্পর্শে এসেছিলেন। নিয়মিত পেতেন গণমাধ্যমের উচ্চ প্রশংসা।
বিনোদিনী সম্পর্কে কিংবদন্তি গিরিশচন্দ্র ঘোষ নিজেই বলেছেন, ‘...আমার ‘চৈতন্যলীলা’ ‘বুদ্ধদেব’ ‘বিল্বমঙ্গল’ ‘নল দময়ন্তী’ নাটক যে সর্বসাধারণের নিকট আশাতীত আদর লাভ করিয়াছিল তাহার আংশিক কারণ আমার প্রত্যেক নাটকে শ্রীমতি বিনোদিনীর প্রধান ভূমিকা গ্রহণ। ’
বিনোদিনীর নাট্য জগতে প্রবেশ, ‘সোনার বাংলা’ নাটক দিয়ে। মুখ্য চরিত্র দিয়েই অভিনয়জীবন শুরু করেন তিনি। অভিনেত্রী হিসেবে উত্তরোত্তর উন্নতি করার নেপথ্যে ছিল বিনোদিনীর প্রচণ্ড অধ্যবসায়। অবিরাম অক্লান্ত অভিনয় সাধনা করতেন তিনি। তাঁর বহু নাটক অভিনীত হয়েছিল ন্যাশনাল থিয়েটার, গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার, বেঙ্গল থিয়েটার প্রভৃতিতে। তবে স্টার থিয়েটার (অধুনা বিনোদিনী থিয়েটার) গড়ে উঠলে তিনি নাট্যজীবনের শেষ অধ্যায় সেখানেই কাটান।
বাংলা নাট্যজগতের তাঁর একচেটিয়া একাধিপত্য অনেকেরই ঈর্ষার কারণ হয়। শুরু হয় নানা মানসিক উপদ্রব, লাঞ্ছনা। তাঁকে ‘একঘরে’ করার প্রচেষ্টা। তিনি আহত, বিস্মিত ও মূহ্যমান হয়ে পড়েন। তাঁর কথায়, ‘পরিশেষে নানা রূপ মনোভাবের ধারা থিয়েটার কার্য্য করা দুরূহ হইয়া উঠিল। যাঁহারা একসঙ্গে কার্য্য করিবার কালীন সমসাময়িক স্নেহময় ভ্রাতা, বন্ধু, আত্মীয়, সখা ও সঙ্গী ছিলেন তাঁহারাই ধনবান, উন্নতিশীল অধ্যক্ষ হইলেন। বা বোধহয় সেই কারণে বা আমারই অপরাধে নানা দোষ হইতে লাগিল। কাজেই আমাকে থিয়েটার হইতে বিদায় লইতে হইল।’
বাংলা নাট্যজগৎ হারাল এক অবিসংবাদিত প্রতিভাকে! এ ক্ষতির প্রলেপ আর আসেনি।
নীহার মজুমদার
তথ্যসূত্র: ১। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ
২। নটী বিনোদিনী-দেবনারায়ণ গুপ্ত
৩। তিনকড়ি, বিনোদিনী ও তারাসুন্দরী-উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ ১৯৮৫
৪। প্রমিলা স্মৃতিকথা-বিদিত ঘোষ, ২০১৪
৫। আমার কথাও অন্যান্য রচনা-বিনোদিনী, ১৩২৯ সাল