পারিবারিক সম্পত্তি ভাগাভাগিতে লাভবান হবেন । ব্যবসায়িক ক্ষেত্রটি কম বেশি চলবে। শিক্ষার্থীদের পক্ষে দিনটি শুভ। ... বিশদ
মহিলা শেরপা। শব্দ দুটো যেন খাপ খায় না। পর্বত আরোহণ, শৃঙ্গ জয়, এসবে মহিলারা পিছিয়ে নেই। কিন্তু শেরপা হিসেবে তাঁরা নেহাতই সংখ্যালঘু। আজ যে মহিলার কথা বলব তিনি এই পুরুষকেন্দ্রিক পেশাতে আছেন তো বটেই, রীতিমতো রাজত্ব করছেন সেখানে। পাহাড় আরোহীদের কাছে লাখপা শেরপা বেশ বিখ্যাত নাম। মোট দশবার এভারেস্ট আরোহণের খেতাব রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। মহিলা শেরপা হিসেবে তিনি ইতিহাস তৈরি করেছেন। নেপালের এই কন্যাটি এখন মার্কিন দেশে বাস করেন। লাখপা বললেন, পাহাড় শুধুমাত্র তাঁর ভালোবাসা বললে ভুল হবে। পাহাড় তাঁর আশ্রয়, তাঁর দেবতা। সুখে দুঃখে তাই বারবার পাহাড়ের কাছেই ফিরে যান। তাঁর কথায়, ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, এভারেস্ট যে দশবার চড়েছি, তা শুধু ভালোবাসা দিয়ে সম্ভব হতো না। একটা জেদও কাজ করেছিল মনে।’
ঘর পালিয়ে পাহাড়ে
নেপালের মাকালু পর্বতের কোলে ছোট্ট একটি গ্রামে এক চমরী গাইপালকের পরিবারে জন্ম লাখপার। বাবা-মায়ের এগারোতম সন্তান। ছোট থেকেই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চিন্তা মায়ের। ‘দাদারা পড়াশোনা শিখলেও আমার জন্য শুধুই বরাদ্দ ছিল ঘরের কাজ শেখা। আর মাঝেমধ্যেই আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্র খুঁজতেন মা। যেই না কোনও ছেলেকে পছন্দ করে মেয়ে দেখার আমন্ত্রণ জানাতেন, অমনি পাহাড়ে পালিয়ে যেতাম। জানতাম বাড়ি ফেরার পর হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধবে। বকুনি-মার কিছুই বাদ যাবে না। তবু পাহাড়ের টান কোনওমতেই কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বড় দুঃসময়েও পাহাড়ের কোলে নিজেকে সমর্পণ করে শান্তি পেতাম,’ বললেন লাখপা।
লাখপার বাবা কিন্তু মেয়ের এই টান অনুভব করতে পারতেন। একদিন মাকালু পর্বতের নিচু ঢালে তাঁদের চমরী গাইগুলো চড়ে বেড়াচ্ছিল, সন্ধে মুখে বাবা লাখপাকে বললেন তাদের তাড়িয়ে ঘরে ফেরাতে। পাহাড়ে অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাবার সাবধানবানীটা কানে বেজে উঠেছিল লাখপার। বাবা বলেছিলেন, ‘শ্বেত ভল্লুক যেন ইয়াকগুলোকে খেয়ে না নেয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের নজর এড়াতে গলা চড়িয়ে ডাকাডাকি করা যাবে না।’ খুব সন্তর্পণে গলা নামিয়ে খানিক গায়ের জোরে, খানিক ভুলিয়ে ভালিয়ে পাহাড়ের চড়াই থেকে চমরীগুলোকে বাড়ি ফেরাতে সক্ষম হয়েছিলেন সেদিন লাখপা। আর সেই পথেই দেখেছিল পর্বত আরোহীদের। কেমন দড়ি, ক্ল্য হ্যামার, অ্যাঙ্কর ইত্যাদি কোমড়ে বেঁধে পাহাড় বেড়ে উঁচু থেকে উঁচুতর পথে উঠছে তারা। লাখপা তো খালি পায়েও পাহাড়ে বেয়ে উঠেছে, মনে মনে ভেবেছিল এমন প্রশিক্ষণ যদি তারও থাকত।
গ্রাম থেকেই এভারেস্ট
উচ্চতার হারে বিশ্বের পঞ্চম শৃঙ্গ মাকালু। সেখানেই লাখপাদের গ্রাম। মাকালুতে নাকি খালি পায়েও উঠেছেন লাখপা। বরফে পা জমে গিয়েছে, কেটে গিয়েছে গোড়ালি। তবু থেমে থাকেননি। এটা ছিল নেশা। মায়ের রক্তচক্ষু এড়িয়ে, বাড়ির কাজের ফাঁকে পাহাড়ই ছিল তাঁর আশ্রয়। মনকেমন করা কৈশোরেও পাহাড়কেই কাছে পেয়েছেন তিনি। বাড়ি থেকেই এভারেস্ট দেখা যেত। দূরে মাথা উঁচু করে ঋজু দাঁড়িয়ে রয়েছে এভারেস্ট। মনে মনে শপথ নিয়েছিলেন একদিন তিনি ওই শৃঙ্গ জয় করবেন।
চোখে পড়া
একদিন শেরপা বাবু ছিরির চোখে পড়লেন লাখপা। লম্বা-চওড়া গড়ন দেখেই দলে পোর্টার (মালবাহক) হিসেবে লাখপাকে নিয়েছিলেন বাবু ছিরি। পরে অবশ্য কিচেন বয় (গার্ল নয়, এমন পেশায় মেয়েদের স্থানই ছিল না) হিসেবেও কাজ করাতেন । পর্বতারোহীদের মাল নিয়ে এক ক্যাম্প থেকে অন্যত্র গিয়ে সন্ধেবেলা সকলের জন্য রান্না করতেন লাখপা। তবু ক্লান্ত লাগত না। পাহাড়ের অমোঘ টানে বুঁদ হয়ে থাকতেন। ‘শেরপা বাবু ছিরির কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। উনি না থাকলে আমার স্বপ্ন সার্থক হতো কি না, বা কবে হতো জানি না। দলে লোকের অভাবেই হোক, তবু সুযোগ তো দিয়েছিলেন’, বললেন লাখপা।
এভারেস্ট জয়
২০০০ সালে প্রথম এভারেস্ট সামিট করেন লাখপা। বললেন, ‘অত উঁচুতে উঠে মনে হয়েছিল পৃথিবীর ছাদের উপর দাঁড়িয়ে আছি বুঝি। ভালোলাগার সীমা ছিল না। খুশিতে আমার চোখে জল। এভারেস্টের কানে কানে বলেছিলাম, আবার ফিরব।’ পরের বছরই সুযোগ এল। এভারেস্ট আরোহণের সময় দ্বিতীয় ক্যাম্পের কাছে একটা ক্রিভাসে পড়ে মারা গেলেন দলনায়ক বাবু ছিরি। লাখপাই তখন গোটা দলের দায়িত্বে। চূড়ায় উঠে পর্বতের সামনে হাত জোড় করেই আবারও নামা শুরু করলেন তিনি। সবাইকে বেস ক্যাম্পে ফেরাতে হবে। ক্লান্ত লাগলে চলবে না, পথে বসতে ইচ্ছে করলেও চলবে না। আবহাওয়ার কোনও ঠিক নেই। হঠাৎ বিগড়ে গেলেই মুশকিল। মনকে এমন বুঝ দিতে দিতে নেমেছেন। পাশাপাশি দলের সবাইকে পথ দেখিয়ে, সাহস জুগিয়ে নিয়ে এসেছেন।
গৃহদ্বন্দ্ব মারপিট
মায়ের পছন্দে বিয়ে করলে শখটাই মাঠে মারা যাবে। তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে এক পর্বতারোহীর সঙ্গে ঘর বাঁধলেন তিনি। মার্কিন নিবাসী রোমানিয়ার যুবক জর্জ দিমারেস্কু লাখপাকে বিদেশে ঘরকন্নার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ঘর পালিয়ে বিয়ে, দু’টি সন্তান। শেষরক্ষা হল না। ক্রমশ দিমারেস্কু দানবীয় হয়ে ওঠে। মারধর করত বউকে। একবার তো এভারেস্ট চড়ার সময় আবহাওয়া খারাপ হলে মেজাজ হারিয়ে লাখপাকে এমন মারধর করে যে জ্ঞান হারান তিনি। কোনওক্রমে তাঁকে নামিয়ে এনে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বললেন, ‘আমি তো স্বর্গ দেখেছি। সেবার মার খেয়ে জ্ঞান হারালাম। চারদিক অন্ধকার হতে হতেও হঠাৎ আলো হয়ে গেল। রঙিন প্রকৃতি, পাখির ডাক, মিষ্টি গন্ধ...। তারপরেই মনে পড়ল মেয়ে দুটো একা। ব্যস, স্বর্গ দর্শন আর হল না। মর্তে ফিরে এলাম। জ্ঞান আসতেই ভাবলাম, অনেক হয়েছে আর নয়। এবার স্বামীর ঘর ছাড়তে হবে।’
কাজের মাঝে পাহাড়
মেয়েদের মানুষ করতে টাকা চাই। সুপারমার্কেটে কাজ নিলেন লাখপা। মাল বওয়া, বাসন মাজা, খাবারের পেটি তোলা কী না করেছেন! ফাঁকে ফাঁকে দল নিয়ে পাহাড়ের ডাকেও সাড়া দিয়েছেন। বললেন, ‘আমার করুণ গল্প শুনে সহকর্মীরাও সাহায্য করত। পাহাড়ে যেতে অসুবিধে হয়নি। তবে দশম অভিযানটা সারা জীবন মনে থাকবে। ২০২৩ সাল, এভারেস্টে দশমবার পা রাখার নেশায় শেষ পর্যন্ত চাকরিটা ছেড়েই দিলাম। দশবার এভারেস্ট চড়ার নজির পুরুষমহলেও বিরল। মহিলাদের মধ্যে তো নেই-ই।
দশম অভিযান
২০২৩ সালের মে মাসে এভারেস্টের দশম অভিযানটি করেন লাখপা শেরপা। রাত তখন দেড়টা। আবহাওয়া ওই সময় খানিকটা শান্ত। বেস ক্যাম্প ছেড়ে এভারেস্ট আরোহণের পথে রওনা দিলেন লাখপা। আবহাওয়ার ভালোমন্দ সামলে পথের দুর্গম ঠেলে এভারেস্টের মাথায় উঠলেন সকাল সাড়ে ছটায়। মাথার উপর গনগনে সূর্য পায়ের তলায় এভারেস্ট। দশম অভিযান সম্পূর্ণ।
লাখপা বললেন, ‘একটা স্বপ্ন সফল হওয়ার পাশাপাশি অন্য স্বপ্নকে লালন করতে হয়। আমার কাছে এভারেস্টের দশম অভিযান ছিল কে টু পর্বতারোহণের গ্রিন কার্ড। মহিলা হিসেবে একবার দু’বার নয়, দশবার এভারেস্ট চড়ার পর লোকমুখে প্রচার কম হয়নি। সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার থেকে ডকু ফিচার সবই হয়েছে আমায় নিয়ে। সেই সম্মান তো অবশ্যই শিরোধার্য। কিন্তু আরও মহিলা শেরপার পাহাড়ে চড়ার স্বপ্নটাকে খানিকটা এগিয়ে দিতে পারার গৌরবও নেহাত কম নয়। পাহাড়ে অন্দরেকন্দরেও মেয়েরা নিজেদের স্বাক্ষর রাখুক। আরও পর্বত-কন্যার জন্ম হোক, এটুকুই আশা।’
কমলিনী চক্রবর্তী