বদ্ধ পরিস্থিতিতে মন ভালো রাখতে নাচের সাহায্য নিতে পারেন। এই প্রসঙ্গে আলোচনায় প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী অমিতা দত্ত। তাঁর সাক্ষাৎকারে কমলিনী চক্রবর্তী।  
নৃত্যের তালে তালে, নটরাজ              ঘুচাও ঘুচাও ঘুচাও সকল বন্ধ হে
সুপ্তি ভাঙাও, চিত্তে জাগাও               মুক্ত সুরের ছন্দ হে।।
কোভিড-১৯ মহামারী এক দমবন্ধ পরিবেশ তৈরি করেছে। সেই পরিবেশ থেকে মুক্তি চাইছি আমরা সবাই। এবং অনেকক্ষেত্রেই নৃত্যের তালে জীবনের ছন্দ ফিরে পেতে আগ্রহী হয়ে পড়ছি। নাচের মাধ্যমে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করার চিন্তাভাবনা নিয়ে ইউজিসি কত্থক নাচ নিয়ে নতুন ধরনের কোর্স তৈরি করেছে। সিবিসিএস পদ্ধতির কোর্সটির শীর্ষে রয়েছেন জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী অমিতা দত্ত। নাচের মাধ্যমে মন ভালো রাখার উপায় বাতলালেন তিনি।

অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে নাচ শেখানো কি আদৌ সম্ভব?
সব কিছুরই সুবিধে এবং অসুবিধে দুই-ই আছে। নাচের অনলাইন কোর্সও এর ব্যতিক্রম নয়। এটা একটা তুলনামূলক নতুন প্ল্যাটফর্ম। ফলে তা আয়ত্তে আনা হয়তো কখনও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি পুরো জিনিসটাকে সহজভাবে ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুলে ধরতে এবং সাড়াও পাচ্ছি।

অনলাইনে শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে একটু বলুন।
ইউজিসি যখন আমাকে এই ধরনের নাচের কোর্সের ভার নিতে বলে তখন তা নিয়ে প্রচুর ভাবনাচিন্তা করি। কোর্স তৈরি করার ক্ষেত্রে সরকারি গাইডলাইনস খুব খুঁটিয়ে মেনে চলেছি। এই কোর্সে তাই থিওরি ও প্র্যাকটিকাল দুটোই আছে। সাধারণত এই ধরনের অনলাইন কোর্সগুলো জুম বা ওই ধরনের কোনও প্ল্যাটফর্ম থেকে করা হয়। সেক্ষেত্রে অনেকের নেট কানেকশন চলে যায় মাঝপথে এবং সেই সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। তাই আমি ইউজিসি-কে প্রথমেই বলেছিলাম যাতে টেকনিক্যাল দিকটা ওরা সামলায়। আমি অ্যাকাডেমিক দিকটা দেখব। আমি খুব ছোট গ্রুপে ক্লাসটির আয়োজন করেছি। তাতে সকলের হাত ও পায়ের মুভমেন্ট খুঁটিয়ে লক্ষ করতে পারছি। এবং ভুল-ত্রুটিও ঠিক করে দিতে পারছি। হাত ও পায়ের প্লেসমেন্ট থেকে তা নাড়ার পদ্ধতি, হাতের সঙ্গে চোখ কীভাবে সামঞ্জস্য রেখে চলবে ইত্যাদি ভেবে একটা চিত্রনাট্য গোছের তৈরি করেছি। সেই স্ক্রিপ্ট প্রতিটি নাচের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীকে দিচ্ছি এবং তারা সেটা দেখে নাচ শিখছে। এইভাবে ভিডিও তৈরি করা হয়েছে। 
এই ভিডিও একবার ইউজিসির সাইটে আপলোড হয়ে গেলে ওটা সেখানে থাকছে। ফলে কেউ যদি ক্লাসের সময়টা অন্যত্র ব্যস্তও থাকেন তাহলে পরে ভিডিও দেখে নাচ শেখার সুযোগ পাবেন। কিছু আন্তর্জাতিক ছাত্রীও রয়েছে এই কোর্সে, তাদের কাছেও এই মাধ্যম বিশেষ উপযোগী। 
সপ্তাহের গোড়ায় তিনটে মডিউল এবং ভিডিও দেওয়া হয় ছাত্রীদের। সেই মডিউলে নাচের ছোট-বড় সব ধরনের  ক্লিপিংস থাকে, ভিডিও থাকে এবং থিওরি পড়ার মতো বেশ কিছু নোটস থাকে। এইগুলো মেনে চললে কোর্সটা কঠিন লাগবে না।

এই কোর্সে ভর্তি হওয়ার জন্য বয়সের কোনও নিম্নসীমা আছে কি?
 ইউজিসি অনুযায়ী ১৩ বছর এই কোর্সে ঢোকার জন্য বয়সের নিম্নসীমা। তবে আমার অনেক ছাত্রীই আছে ১৩ বছরের কমবয়সি। সেক্ষেত্রে তাদের যে শিখতে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু শেখার পর পরীক্ষায় বসা সম্ভব হবে না। ১৩ বছরের কম যাদের বয়স, তারা শুধুই শিখতে পারবে।

এই অনলাইন কোর্সের মূল্যায়ন কীভাবে সম্ভব? 
প্রতি সপ্তাহের শেষে একটা করে পরীক্ষা নেওয়া হয়। তাতে দুটো করে অবজেক্টিভ প্রশ্ন থাকে এবং একটা সাবজেক্টিভ প্রশ্ন থাকে। এইভাবে পরীক্ষাগুলো দেওয়ার পর সেরা পাঁচটি পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে রেজাল্ট বেরয়। এই রেজাল্টে যারা পাশ করে তারা ফাইনাল পরীক্ষায় বসে। সাপ্তাহিক পরীক্ষাগুলোর গড় নিয়ে যদি কেউ পাশ না করে তাহলে সে পরের কোর্সে আবারও নাম লেখাতে পারে। তাতে আরও বেশি পারফেকশন আসবে। 

বর্তমান পরিস্থিতিতে মহিলারা কি নাচের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন?
সামনাসামনি শেখার পরিপূরক কখনওই অনলাইন কোর্স নয়। তবু নাচের মাধ্যমে একটা মুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। এই পরিস্থিতিতে সকলেই মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। বাড়িতে বন্দি, ফলে মনমরা হয়ে পড়ছেন। তখন অনলাইন নাচের মাধ্যমেও যদি সামান্য মুক্তির আনন্দ পাওয়া যায় ক্ষতি কী? 

এই কোর্স করলে মেয়েদের রোজগারের সুযোগ কতটা?
এটা তো একটা ছ’মাসের কোর্স। তাই এটা শেষ করেই যে খুব রোজগেরে হয়ে ওঠা যাবে তা নয়। তবে অনেকে হয়তো এমনিতেই নাচের ক্লাস নেন, তাঁরা এই কোর্স করে নিজেদের শিক্ষা আরও সমৃদ্ধ করতে পারেন। তাতে পরবর্তীতে তাঁরা আরও ভালোভাবে নাচ শেখাতে পারবেন। তাছাড়া এই কোর্সটা তো দেশে বিদেশে সকলেই করতে পারবে। ফলে আমারই কিছু স্টুডেন্ট রয়েছে বিদেশে, যারা এই কোর্সটা করে ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতিকে বিদেশে তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে। সেটা অবশ্যই আনন্দের বিষয়। বিশেষত আজও অনেক মেয়ের স্বামীর চাকরিসূত্রে বিদেশ চলে যায়। এদের কারও কারও তখন নিজস্ব রোজগার থাকে না। সেক্ষেত্রে এমন একটা কোর্স করে কিছু মহিলা যদি নিজের রোজগারের পথ খুঁজে পান, তাহলে তা খুবই ভালো কথা।  

যুগের সঙ্গে চিন্তাভাবনারও তো পরিবর্তন হচ্ছে। সেই পরিবর্তনের নিরিখে মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও কি নাচ শিখতে আগ্রহী হচ্ছে?
নাচের গায়ে এখনও মেয়েলি তকমা লেগে রয়েছে। তাই আজও ছেলেরা নাচের প্রতি আগ্রহী হলে তাদের ‘মেয়েলি’ বলে ভাবা হয়। এই ধারণাটা প্রথমে ভাঙতে হবে। তবে আমার কয়েকজন ছাত্রও আছে। তাদের আমি বলি, নাচের দু’টি রূপ তাণ্ডব ও লাস্য। ছেলেরা তাণ্ডবের দিকটা ফুটিয়ে তুলবে, মেয়েরা হবে লাস্যময়ী। শিব যখন নেচেছিলেন, তখন তো তিনি মেয়েলি হয়ে যাননি। বরং তাঁর নাচের মাধ্যমে পুরুষালি রূপ প্রকট হয়েছিল। এই দৃষ্টান্তই আমি আমার ছাত্রদেরও দিয়ে থাকি। তাছাড়া একথা ঠিক যে একটা পারফর্মিং আর্টে নিশ্চিত রোজগারটা নেই। ফলে অনেক ছেলেই সেই নিশ্চিত রোজগারের অভাবের কারণে নাচকে পেশা হিসেবে নিতে পারে না। এখন মেয়েরাও নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, প্রচুর রোজগারও করছে। কিন্তু রোজগারের ক্ষেত্রে মেয়েদের কাছে সমাজের চাহিদা কম বলেই হয়তো তারা জীবনে এই ঝুঁকিটা নিতে পারে, ছেলেরা যা পারে না। তবে আশার কথা এই যে অনেক ছেলেই এখন নাচকে শিল্প হিসেবে দেখে তা শিখতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। তাই বলা যায় সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও ক্রমশ বদলাচ্ছে। নাচ শুধুই মেয়েলি বিভাগ হয়ে না থেকে বরং সমাজের চোখে শিল্পের মর্যাদা পাচ্ছে।