বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
এ শহরে ইউএস কনসাল জেনারেল হিসেবে তিন বছর কাটালেন। কলকাতা কেমন লাগল? বাঙালিদেরই বা কেমন লাগল?
কলকাতার মানুষের আন্তরিকতা এবং আতিথেয়তার কোনও তুলনা হয় না। কাজ চলাকালীন যত মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে বা যত মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে, তাঁরা আমার কাজের সময়টাকে এত অসাধারণ করে তুলেছিলেন কী বলব! শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে ওঁদের খুব মিস করব! কত মানুষ আমায় বাড়িতে ডেকেছেন, তাঁদের পরিবারের সান্নিধ্য পেয়েছি। এখানকার ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, সঙ্গীত, ফ্যাশন, হস্তশিল্প, খাবারদাবার সবকিছুর মধ্যেই আমি নিজের ফেলে আসা বাড়িটা যেন ফিরে পেয়েছিলাম। কলকাতা এবং এ শহরের মানুষ সবসময় রয়ে যাবেন আমার মনে।
মহামারীর ধাক্কা সামলাতে হয়েছে আমাদের সবাইকে। আপনি কীভাবে দেখছেন সময়টাকে?
মহামারীর মধ্যে আমরা কনস্যুলেটের তরফে নিজেদের বাড়ি থেকে সুষ্ঠুভাবে কাজ করে মানুষের কাছে পৌঁছতে চেয়েছি। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয়, তা নিয়ে আগে আমাদের সম্যক ধারণা না থাকলেও এখন সকলেই এই মাধ্যমে কাজ করতে প্রায় সড়গড়। বাড়ি থেকে কাজ করার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করেছি আমরা। এতে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রত্যন্ত এলাকার সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন সহজ হয়েছে। তবে উমপুনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্রযুক্তিগত সমস্যা হয়েছে। কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগ হওয়াটা খুব জরুরি। অফিস থেকে বেরিয়ে যে দেশের জন্য কাজ করতে এসেছি, সেই দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলা দরকার। এক্ষেত্রে ভার্চুয়াল যোগাযোগ ততটা কার্যকরী নয়। ভারতের মতো দেশের বৈচিত্র বুঝতে আমাদের নানা জেলায় যেতে হয়, মার্কিন সাহায্য সর্বত্র পৌঁছনোর কথা ভাবতে হয়। মহামারীতে সেইসব কাজ কিছুটা হলেও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। তবু ভার্চুয়াল মাধ্যমকে যতটা সম্ভব কাজে লাগিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা করে চলেছি আমরা। এখন সবার জন্যই খুব কঠিন সময়। তবে এর মধ্যেও একসঙ্গে কাজ করতে করতে এত দৃঢ় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে (যেমন আমেরিকার সঙ্গে ভারতের), সেগুলোই পরম প্রাপ্তি। কোভিড-১৯-এ গত বছর আমাদের দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যখন খুব টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল, তখন ভারত এগিয়ে এসেছিল সাহায্যের জন্য। আর এখন একইভাবে আমেরিকাও ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে। সেকেন্ড ওয়েভের সময় আমেরিকা থেকে সাতটি বিমানে জীবনদায়ী ওষুধ, রেমডেসিভিরের মতো জরুরি ওষুধ, অক্সিজেন সংক্রান্ত জরুরি সামগ্রী, এন৯৫ মাস্ক, র্যাপিড ডায়াগনিস্টিক টেস্ট সামগ্রী এসেছে। এছাড়া প্রযুক্তিগত সাহায্য এবং বিভিন্ন পণ্যের জন্য এসেছে প্রায় ১০ কোটি ডলার। বেসরকারি ক্ষেত্রে মার্কিন নাগরিক সাহায্যের জন্য দিয়েছেন অতিরিক্ত ৪০ কোটি ডলার। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল(সিডিসি) এবং ইউএসএইড মিলিতভাবে গত ৭০ বছর ধরে ভারতের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ক্ষেত্রে মজুবত সম্পর্ক তৈরি করেছে। সিডিসি ও ইউএসএইড এবং ভারত একসঙ্গে কাজের মাধ্যমে ল্যাবরেটরি, রোগের নজরদারি, জরুরি পরিষেবা, সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ, ভ্যাকসিন ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রকে আরও জোরদার করে তুলতে সমর্থ হয়েছে। তারা ১০ হাজার ফ্রন্টলাইন স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফিনান্স কর্পোরেশন ফান্ডিং-এর মাধ্যমে সুরক্ষিত এবং কার্যকরী কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ভারতীয় সংস্থা বায়োলজিকাল ই লিমিটেডকে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এতে ২০২২-এর শেষে একশো কোটি ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব হবে।
এখানে কাজের সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের নানা অঞ্চল, পূর্ব এবং উত্তর পূর্বের অনেক জায়গাতেই গিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন?
কলকাতায় দুর্গাপুজো দেখে অপূর্ব লেগেছে। বন্ধুদের বলেছি, এ রাজ্যের পুজো দেখার মতো ব্যাপার। মিস করা যাবে না। জীবনে প্রথমবার শাড়িও পরলাম এখানে এসে। কাঁথাস্টিচের দারুণ সব টেক্সটাইল কিনেছি। তবলা কনসার্ট দেখেছি। রেড রোডের প্যারেড, রবীন্দ্রসদন, আইসিসিআর এবং কলামন্দিরে নাচ-গানের অনুষ্ঠান, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এবং ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম, ফোর্ট উইলিয়াম-নেতাজি মিউজিয়াম-মাদার হাউস-মার্বল প্যালেস, বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট, কুমারটুলির শিল্পীদের কাজ, উত্তর কলকাতার বাড়ির পুজো, কালীঘাটের মন্দির— তালিকায় কী নেই!
সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল দেখেছি, বিষ্ণুপুরে টেরাকোটার মন্দির, গ্রামের লোকজনের সঙ্গে নাচ, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আরও বেশি করে জানা, দার্জিলিঙে পাহাড়, চায়ের বাগান আর মুগ্ধ হয়েছি রেড পান্ডা দেখে।অসাধারণ সব অভিজ্ঞতা হয়েছে মণিপুরের সাঙ্গাই ফেস্টিভালে, নাগাল্যান্ডের হর্নবিল ফেস্টিভালে। প্রথম হেলিকপ্টার চড়া অরুণাচলপ্রদেশ যেতে গিয়ে। তাওয়াং ফেস্টিভ্যাল দেখেছি ওখানে, তাওয়াং মনাস্টারিও ঐতিহাসিক। সিকিমের ছাঙ্গু লেকে গিয়েছি, রুমটেক মনাস্টারিতে। মেঘালয়ে ঘুরেছি রুট ব্রিজে। ত্রিপুরায় দেখেছি নীরমহল প্যালেস। অসমে ভেসেছি ব্রহ্মপুত্রে। মিজোরামে দেখেছি পাহাড়ি আইজলকে। পাটনায় বিহার মিউজিয়াম আর ঝাড়খন্ডে মার্কিন সংস্থার বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারিং সাইটে গিয়েছি। ১১টি রাজ্য ঘুরেছি সব মিলিয়ে। তবে সবকিছুর মধ্যে সেরা বলব কলকাতাকেই। এখানে এত উষ্ণতা, এত দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব পেয়েছি যে তা ভোলার নয়।
আপনি কি ফুডি? এখানে বাঙালি খাবার চেখে দেখেছেন?
আমার মনে হয়েছে ‘ইন্ডিয়ান কুইজিন’ শব্দটা ভুল প্রয়োগ। এখানে খাবারেও এত বৈচিত্র! এতরকম খাবার চেখে দেখার মজাই আলাদা। আমার বিশেষ করে ভালো লেগেছে ভেটকি মাছ, পুরি, পনির, মিষ্টি দই, আম আর চা। আমি নিজে নিরামিষাশী নই, কিন্তু এখানে নিরামিষ খাবারের এত দারুণ সব পদ, তাই ভেজ খাবারও খেয়েছি চুটিয়ে।
শাড়ি তো এখানে এসে প্রথম পরেছেন বললেন। এখন কি শাড়ি পরতে পারেন, কিনেছেন কিছু? আমেরিকায় ফিরে গিয়ে কখনও শাড়ি পরবেন? পোশাক হিসেবে শাড়ি কেমন লাগল?
আমি বিষ্ণুপুরের একজন উইভারের কাছ থেকে রয়্যাল ব্লু বালুচরি কিনেছি। পরের বছর মার্কিন স্বাধীনতা দিবসে পরার ইচ্ছে আছে। মহামারীর কারণে গত বছর মার্কিন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করা যায়নি। এবারও আমরা ৪ জুলাই, আমেরিকান ইন্ডিপেনডেন্স ডে-র ইভেন্ট করতে পারছি না, খুবই দুঃখজনক। তবে বছর দুই আগে লাল পাড় সাদা শাড়ি কিনেছিলাম, সেটা পরে সেবার দশমীতে আপনাদের মতো সিঁদুরখেলাতেও যোগ দিয়েছি। খুব মজা হয়েছিল। খুব সুন্দর দুটো কাঁথাস্টিচের শাড়িও রয়েছে আমার, কী অভিজাত দেখতে সেগুলো! স্থানীয় জুয়েলারিও কিনেছি টুকটাক। ভারতের অসাধারণ টেক্সটাইল আর উজ্জ্বল রং খুব মিস করব। তাই এবার থেকে আমার ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ডরোবে ওই ধরনের পোশাক আর জুয়েলারি অবশ্যই থাকবে। হস্তশিল্পের নানা জিনিস কিনেও ঘর সাজিয়েছি। টেরাকোটার জিনিস, ডোকরার মূর্তি সবই আছে সে তালিকায়।
মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষার জন্য মার্কিন কনস্যুলেট নানা কাজ করে। আপনি কীভাবে দেখেছেন এই বিষয়টিকে?
দেখুন নারী পাচার রোধ করা আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কমব্যাটিং ট্র্যাফিকিং ইন পার্সন (টিআইপি) একটি বিশ্বজনীন সমস্যা বলতে পারেন। অ্যান্টি-টিআইপি কনক্লেভ করে আমরা সরকার, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাজগত, ক্রীড়াজগত, স্কুল এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি। মহিলা ও কিশোরীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে পুনর্বাসন দেওয়ার চেষ্টা করি। সার্ভাইভারদের সমাজে ফেরানোই লক্ষ্য আমাদের। এই সব মেয়ের কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছি। কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেট এই মেয়েদের ক্ষমতায়নে এবং টিআইপি-র ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য কিশোরীদের যেভাবে শিক্ষা দিয়ে চলেছে, তার জন্য আমি গর্বিত। পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করে তাদের যথাযথ শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়াটি যাতে ঠিকভাবে হয়, খেয়াল রাখা হয় সেদিকেও।
এর পাশাপাশি পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মহিলা উদ্যোগপতিদের ক্ষমতাশালী করে তুলতে নানা প্রোগ্রাম রয়েছে। হোয়াইট হাউসের পরিচালনায় আছে অ্যাকাডেমি অব উইমেন অনত্রোপ্রোনার্স (এডব্লুই), এটি উত্তর-পূর্ব ভারতের ৫টি রাজ্যের ১৫০ জন মহিলাকে তাঁদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য অনলাইন লার্নিং, মেন্টরশিপের সুবিধা করে দিয়েছে। স্থানীয় মহিলা উদ্যোগপতিদের সঙ্গে বিজনেস স্টুডেন্টদের গ্লোবাল লিঙ্কে যোগাযোগ ঘটিয়ে কলকাতায় কাজের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে তিনশোরও বেশি মহিলা ও শিক্ষার্থীকে।