অত্যধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা-শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। আধ্যাত্মিক ... বিশদ
করোনার কারণে আমাদের জীবনযাপনের ধরন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। অফিস, দোকান খুলে গেলেও রোজ বাইরে যাওয়ার পাট অনেকেরই চুকেছে। বাড়ির পুরুষটিও হয়তো বা রোজগার খুইয়েছেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে। অনেকের মাস মাইনের টাকায় টান পড়েছে। আর এমন পরিস্থিতিতে বাড়ির মহিলারা সংসারের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন।
উদ্যোগের সূত্রপাত
আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা সবসময়ই পুরুষের অধীনে। বহু ক্ষেত্রে তাই তাদের ইচ্ছে থাকলেও রোজগারের উপায় ছিল না। বাড়িতে স্বামী বা শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের গৃহবধূ হিসেবেই দেখতে চাইতেন। কিন্তু সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন এনেছে অতিমারী। কিছুটা নিরুপায় হয়েই যেন মেয়েদের হাতে সংসারের অর্থনৈতিক ভার তুলে দিচ্ছেন অনেক পুরুষ! যেসব গৃহবধূ করোনাকালে হঠাৎ রোজগেরে হয়ে উঠেছেন, তাঁদের নিয়েই এক অনন্য উদ্যোগ শুরু করেছেন নিখাত সুলতানা। উদ্যোগটির নাম দিয়েছেন ‘হোমোপ্রেনর’। অর্থাৎ এমন গৃহবধূ বা হোমমেকার যাঁরা নাকি পরিস্থিতির চাপে পড়ে হঠাৎই অঁন্ত্রপ্রেনর বা ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন।
প্ল্যাটফর্ম তৈরি
শুধু উদ্যোগ থাকলেই তো আর হল না, সেই প্রয়াসকে ঠিক কাজে লাগানো চাই। আর তা কাজে লাগানোর জন্য চাই প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্মের অভাবে অনেক মহিলাই আছেন যাঁরা নিজের রোজগারের পথ হারিয়েছেন। তাঁদের গুণগুলো সমাজে তুলে ধরার সুযোগই কখনও পাননি। ফলে এই প্ল্যাটফর্ম তৈরিটাই প্রথম এবং প্রধান কাজ বলে মনে করেন নিখাত। তাঁর কথায়, ‘এই যে সুযোগ বা প্ল্যাটফর্ম তা শুধুই মহিলাদের জন্য করা দরকার। তাহলেই একমাত্র মেয়েদের সৃষ্টিশীল ভাবনাচিন্তার সঠিক বিচার হবে।’ নিখাত বলেন, ‘ঘরে-বাইরে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অনেক মহিলাই চলেন। তবু মেয়েদের গুণের উপযুক্ত বিচার হয় না আমাদের সমাজে। তাঁদের জন্য কিছু গতানুগতিক কাজ যেন নির্দিষ্ট করা রয়েছে। সেই স্টিরিওটাইপ থেকে বেরিয়ে কিছু করার সাহস দেখালে সমাজ আজও মেয়েদের কটাক্ষ করে।’ তাই এই পরিস্থিতিতে মেয়েদের গুণের সঠিক বিচার করতে শুধুই তাঁদের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার কথা ভাবেন তিনি। এইভাবে মহিলাদের উদ্যোগকে অনুপ্রেরণা দেওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি।
প্রাণবন্ত উদ্যোগ
মহিলাদের বিভিন্ন গুণের কদর করার জন্য যে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন নিখাত সুলতানা, তাতে মহিলারা বিভিন্ন ধরনের কাজ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। কেউ নিজেদের রান্না নিয়ে হাজির হন, কেউ বা নিজেদের ডিজাইন করা পোশাক বানিয়ে আনেন। কারও সম্ভারে ছিল বহু ধরনের প্রসাধনী, আবার কেউ হয়তো সাজাতে ভালোবাসেন, সেক্ষেত্রে তিনি পার্টি, ব্রাইডাল, ন্যুড লুক ইত্যাদি বিভিন্ন রকম মেকআপ নিয়ে হাজির হন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। নিখাত তাঁর ভাবনা নিয়ে আরও খানিক দূর এগিয়েছেন। তাই এই নব্য ব্যবসায়ীদের অনুপ্রেরণা জোগাতে তিনি নানারকম টক শোয়েরও আয়োজন করেন। টক শো পুরোপুরি বিশিষ্টজনদের ঘিরে। তাঁরা তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন, কীভাবে তাঁরা জীবনে সফল হয়েছেন তা বলবেন এবং সঙ্গে নতুন হোমোপ্রেনরদের কাজে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ ও টিপস দেবেন।
এগিয়ে যাওয়ার সাহস
এই যে টক শো, তাতে মোট চারজন বক্তা, সবাই মহিলা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশিষ্টও বটে। যেমন সায়রা শাহ হালিম একজন শিল্পী, লোপামুদ্রা মণ্ডল ডিজাইনার, ফারহা খান একজন ব্যবসায়ী এবং নয়না মোরে মোটিভেশনাল স্পিকার। এই ধরনের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বলে ও তাঁদের কথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই নতুন সব হোমোপ্রেনর উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এই চারজন বক্তা তাঁদের বক্তব্যে বারবার বলেছেন, মেয়েরা চিরকালই ভীষণ সৃজনশীল। তাঁদের মাথায় ভাবনাচিন্তারও অভাব নেই। কিন্তু সেই ভাবনাগুলোর বিকাশ ঘটানোর সুযোগ তাঁরা অনেক সময়ই পান না। কখনও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনও বা সংসার মেয়েদের দমিয়ে রাখে। তাদের গুণের কদর করতে পারে না। কিন্তু এখন
সুযোগ এসেছে এবং সেই সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা দরকার। সত্যি বলতে কী, মেয়েদের সবসময়ই সুযোগের জন্য তক্কে তক্কে থাকতে হবে। যখনই যেটুকু ফাঁক পাওয়া যায় তখন সেটাই লুফে নিতে হবে।
নিজস্ব জায়গা
মেয়েরা প্রচুর ধরনের কাজ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন নিখাতের মেলায়। সেখানে সব মেয়ে নিজেদের বিপুল সাফল্যে খুব খুশি। তাঁরা বলেন, নিজেদের গুণ যে এত ভালোভাবে তুলে ধরা যাবে সেটা তাঁরা ভাবেননি, ফলে নিজেদের সাফল্যে তাঁরা নিজেরাই অভিভূত। সায়রা শাহ হালিম তাঁর বক্তব্য শুরু করেছিলেন মেয়েদের স্বতন্ত্র হওয়ার উদ্যোগ দিয়ে। তিনি বলেন, ‘মেয়েদের কাজের মধ্যে একটা নিজস্বতা থাকা উচিত। এমন একটা জায়গা যা শুধুই তাদের একান্ত আপন। সংসারের চাপে পড়ে অধিকাংশ মেয়েই সেই নিজস্বতা, স্বতন্ত্র মনোভাব হারিয়ে ফেলে। অন্যের মুখ চেয়েই তখন তাদের বেঁচে থাকা। কিন্তু এই অন্যের জন্য বাঁচার আবার একটা অসুবিধেও রয়েছে। অনবরত এমন জীবনযাপন করতে করতে একসময় একটা ক্লান্তি আসে। আর সেই ক্লান্তি থেকেই আসে অবসাদ। তখনই মেয়েদের জীবনটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতি আটকাতেই নিজস্ব জগতের প্রয়োজন। আর সেই সুযোগ যদি পাওয়া যায় তাহলে তা দু’হাতে গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।’
অনুপ্রেরণা
নিখাত সুলতানা বলেন, ‘আমরা সবাই অভ্যাসের দাস। একরকম ভাবে জীবন কাটাতে কাটাতে সেই ছন্দেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। মেয়েরাও এর ব্যতিক্রম নয়। পুরুষের অধীনে থাকতে থাকতে তারাও সেই জীবনটাকেই সঠিক বলে মেনে নিয়েছে। ফলে নিজের উদ্যোগে কিছু করার সাহসটাই অধিকাংশ মেয়ে হারিয়ে ফেলে। এমনকী নিজেদের গুণের প্রকাশ করার সাহসটুকুও অনেক মেয়েরই থাকে না। মেয়েদের নিজস্ব ব্যবসার জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম এবং টক শোয়ের মাধ্যমে তাদের মনে একটা সাহস জোগানোর চেষ্টা করেছি আমরা। মেয়েদের আগে মানসিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে।’ আর সেই সাহসটাই তাদের দেওয়া হয়েছে এই কর্মশালার মাধ্যমে। যেমন যিনি ব্রাইডাল মেকআপ করেন, তিনি এই মেলায় অংশগ্রহণ করে অনেক কনট্যাক্ট পেয়েছেন। তাঁর কাজের প্রশংসা হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই যে আলোচনা, প্রশংসা ইত্যাদির ফলে তাঁর মনের জোর বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে। এছাড়া অনেকেই কসমেটিক গয়না বানিয়ে এনেছিলেন এই কর্মশালায়। সেই গয়না যত না বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি তার কদর করা হয়েছে। নকশা এবং মানের কদর পেয়ে গয়না বিক্রেতার মনের জোর বেড়ে গিয়েছে।
মহিলা ব্যবসায়ীদের কথা
বাড়িতে থেকে, বাড়ির কাজকর্ম সামলে, সংসারের পিছনে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করে অভ্যস্ত গৃহবধূরা এই সুযোগ পেয়ে দারুণ খুশি। নিজেদের কাজ অন্যের সামনে আনার সুযোগটাই একটা বড় কথা, বললেন তাঁরা। আর সেই কাজ যদি অর্থনৈতিক সাফল্য আনে তাহলে তো আর কথাই নেই। অতিমারীর সময় সংসারের ছন্দে যেটুকু ভাটা পড়েছে তা যদি গৃহিণীদের উদ্যোগে পূর্ণ করা যায় তো ক্ষতি কী? আর হোমোপ্রেনররা ভাবছেন, এতদিনে সংসারে তাদের মূল্য বাড়ল বুঝি! না হলে সব খাটনিই তো এতদিন বেকার হয়ে যেত। স্বামী ও শ্বশুরবাড়িতে হয়তো বা এরপর একটু সম্মানের চোখে দেখা শুরু হবে হোমোপ্রেনরদের।
তাঁদের মতে, সংসারে টাকাটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ফলে সাংসারিক ‘বেকার কাজের’ মধ্যে থেকেই সামান্য একটু ‘কাজের কাজ’ উঠে এলেই বা ক্ষতি কী?